বিষাণ বসু তাঁর প্রবন্ধে মানুষের জীবনে বার্ধক্যের অতি বাস্তব ও করুণ দিকটি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন (‘নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের অপেক্ষায়’, ৪-৭)। বার্ধক্যের নিঃসঙ্গ ও অসহায় জীবনের কথা ভাবতাম না আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে হলে। কিন্তু আমার বয়স এখন ষাট ছুঁই-ছুঁই। একমাত্র কন্যাসন্তান ডাক্তারি পাশ করে শীঘ্রই সংসার জীবনে প্রবেশ করবে। বাড়িতে পড়ে থাকব আমি আর আমার স্ত্রী। যত দিন দু’জন শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকি, তত দিন তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু দু’জনেই অসুস্থ হয়ে পড়লে, অথবা এক জন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে, অন্য জন চূড়ান্ত অসহায় হয়ে পড়বে। প্রবন্ধকার এই লেখায় টোকিয়োর উপকণ্ঠে অতিকায় এক হাউজ়িং কমপ্লেক্সের জীবন নিয়ে রচিত এক প্রতিবেদনে বর্ণিত আবাসন জীবনের করুণ একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবাসনের এক রান্নাঘরে বেসিনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা এক ব্যক্তির কঙ্কাল প্রায় তিন বছর পর উদ্ধার হয়। জানা গেল, নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া এক ভদ্রমহিলার কথা, যিনি পাশের ফ্ল্যাটের এক বাসিন্দাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন শুধু তাঁর ঘরের জানলার দিকে লক্ষ রাখতে, কারণ তিনি রোজ রাতে জানলার পর্দা টেনে দেন, আর সকালে উঠেই সেই পর্দা সরিয়ে দেন— ব্যতিক্রম মানে কোনও অঘটন ঘটেছে। বর্তমানে মুম্বই বা কলকাতার মতো ব্যস্ত শহরে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়।
একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার মূল কারণ একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া। মাদার টেরিজ়া নোবেল ভাষণে বলেছিলেন, অনেক সময় সন্তানেরা বৃদ্ধ মাতাপিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন এবং তাঁদের কথা ভুলে যান। কোনও কিছুর অভাব না-থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ মাতা-পিতা বিষণ্ণ মুখে দিনের পর দিন দরজার দিকে চেয়ে থাকেন সন্তানদের দেখার জন্য।
নিঃসঙ্গতা ও অসহায়তা বর্তমান সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধি। বয়স্কদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখার জন্য পাড়ায় পাড়ায় ‘বয়স্ক সহায়ক সঙ্ঘ’ বা এই ধরনের কিছু সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। বয়স্কদেরও আরও বেশি মানুষের সাহচর্যে আসতে হবে। বুঝতে হবে, মানুষ মানুষের জন্য। শুধু বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ, বিদেশ ভ্রমণের জন্য নয়। আর প্রবন্ধকারের ভাষায় এই চূড়ান্ত সত্য মেনে নেওয়া যে, মানুষের জীবনের “ভবিষ্যৎ মানে বুড়ো হওয়া, ভবিষ্যৎ মানে নির্ভরশীল হওয়া।”
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
গিরীন্দ্রশেখর
মনোরোগের অন্যতম পুরোধা চিকিৎসক, এ দেশের ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েড’ বলে যিনি পরিচিত, তিনি গিরীন্দ্রশেখর বসু, গিরীন্দ্রশেখর রায় নন (‘মনের অসুখ জয়ীদের আলোয় ফেরার ঠিকানা’, ৮-৭)। বিশিষ্ট কেমিস্ট, খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও অভিধান প্রণেতা রাজশেখর বসুর ভাই ছিলেন গিরীন্দ্রশেখর। রাজশেখর বসুর দান করা বাড়িতেই গিরীন্দ্রশেখর ১৯৪০ সালে তিন-শয্যাযুক্ত তাঁর মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলেন। এটিই বর্তমানে লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল নামে পরিচিত। এর অনেক আগে, ১৯২২ সালে কলকাতার ১৪ নম্বর পার্সিবাগান লেনে নিজের বাড়িতে তিনি ‘ভারতীয় মনঃসমীক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ফ্রয়েড ও আর্নেস্ট জোনস্-এর সহযোগিতায় এটি ‘ইন্টারন্যাশনাল সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর অনুমোদন লাভ করে।
ভারতের ফ্রয়েড বলে পরিচিত হলেও গিরীন্দ্রশেখর ফ্রয়েডকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্যের পরিচয় তাঁর ‘থিয়োরি অব অপোজ়িট উইশ’-এ পাওয়া যায়। তাঁর পিএইচ ডি গবেষণা ‘দ্য কনসেপ্ট অব রিপ্রেশন’ আসলে ফ্রয়েডীয় ভাবনার ভারতীয় প্রত্যুত্তর। মানুষের যাবতীয় চিন্তা ও কর্মের পিছনে যেখানে ফ্রয়েড দেখেছেন আমাদের অবচেতন মন ও ইচ্ছার তাড়না, সেখানে গিরীন্দ্রশেখর দেখেছেন আমাদের ভগবদ্গীতা-র ‘ধর্ম’ ও ‘অধর্ম’ বোধের প্রেরণা। চিন্তার এই ব্যবধান তাঁদের সম্পর্কের উপর ছায়া ফেলেনি। ফ্রয়েডের সঙ্গে গিরীন্দ্রশেখরের সশ্রদ্ধ ও হার্দিক সম্পর্ক দীর্ঘ কুড়ি বছর ব্যাপী পত্রালাপে সজীব ছিল।
অরবিন্দ সামন্ত, কলকাতা-১১৫
গণিকাবৃত্তি
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের এক বেঞ্চ গণিকাদের উপর পুলিশি হেনস্থা বন্ধ করা এবং অন্যান্য অধিকারের প্রসঙ্গে একটি নির্দেশ দিয়েছেন (‘যৌনকর্মীরও আছে সাংবিধানিক অধিকার’, ২৬-৬)। এই সিদ্ধান্তকে আমরা সমর্থন করছি। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা এই দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এই নির্দেশ দিতে গিয়ে তাঁরা যে এই কাজকে ‘পেশা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বসেছেন, তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
শীর্ষ আদালত বলেছে যে, গণিকাবৃত্তি মেয়েদের সম্মতির ভিত্তিতেই ঘটে। এর বিপরীতে আমরা দৃঢ় ভাবে বলছি, এই কাজকে ‘পেশা’ হিসেবে দেখা, বা এটিকে মেয়েদের স্বেচ্ছামূলক বৃত্তি হিসেবে ভাবা, বাস্তবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। এর প্রমাণ মেলে নারীপাচারের বাজারের দিকে তাকালে। বিপুল সংখ্যায় মেয়েরা প্রতি দিন পাচার হচ্ছে। তাদের পরিণতি কী হয়, বিচারপতিদেরও অজানা থাকার কথা নয়। মেয়েদের উদ্ধার করার অল্প যে ক’টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই মেয়েদের উদ্ধার করা হয় গণিকালয় থেকে। একই সঙ্গে খবর পাওয়া যায়, তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। কাজেই এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারিদ্র-ক্ষুধা, কর্মহীনতা, পিতৃতান্ত্রিকতায় পিষ্ট ও অনন্যোপায় মেয়েদের এই বৃত্তিতে আনা হয় নানা অবৈধ উপায়ে, মিথ্যাচার, প্রতারণা ও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে এবং শারীরিক ও মানসিক পীড়নের মধ্যে দিয়ে। এক বার এই জগতে ঢুকে পড়লে সেখান থেকে বার হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, এলেও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে সেখানেই ফিরে যেতে বাধ্য করে। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পিছনে সমাজের ক্ষমতাশালী অংশের ভূমিকাকে নির্দ্বিধায় দায়ী করা যায়। যদি বা কোনও মেয়ে স্বেচ্ছায় এই বৃত্তি বেছে নেয়, তা নিঃসন্দেহে কোটিতে গুটিক, তাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখা উচিত, সাধারণ প্রবণতা হিসেবে নয়। বিচারপতি তথা রাষ্ট্র ব্যতিক্রমকে ভিত্তি করে একে পেশার স্বীকৃতি দিলে তা মেয়েদের কল্যাণ তো করবেই না, বরং তাদের জীবনকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের একটা বড় অংশ শিশু ও কিশোরী। এই বৃত্তিকে পেশার স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এই শিশু-কিশোরীদের ভবিষ্যৎকে চোরাবালিতে ঠেলে দেওয়ার দায়ও কিন্তু নিতে হবে রাষ্ট্রকে। আমরা লক্ষ করছি, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে নয়া অর্থনীতি গ্রহণ করার সময় থেকে এই পাচারের ব্যবসার পাশাপাশি ড্রাগের ব্যবসাও ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে, যে কাজেও এই গণিকালয়ের মেয়েদের যুক্ত করা হচ্ছে। এই সামাজিক অবক্ষয়কে তা হলে পরোক্ষ ভাবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
লকডাউন-পরবর্তী সময়ের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মেয়েরা কাজের বাজার থেকে ক্রমেই আরও হটে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের উচিত প্রত্যেক মেয়ের জন্য সুস্থ-মর্যাদাপূর্ণ কাজের ব্যবস্থা করা। গণিকাবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে, সুস্থ কাজ দেওয়ার কর্তব্য থেকে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলে অসহায় মেয়েদের আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া নয়।
এই মেয়েদের উপর পুলিশি হয়রানি বন্ধ করার জন্য, এই মেয়েদের ও তাদের সন্তানদের যে মানুষের সম্মান প্রাপ্য, এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বিচারপতিদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা বিশ্বাস করি, যৌনসম্পর্ক বিনিময়যোগ্য পণ্য হতে পারে না। তাই আমরা দাবি জানাচ্ছি, এই অমানবিক জীবনযাত্রার অবসান ঘটুক, সুস্থ যৌনতা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত পরিসরকে সুন্দর করুক।
চন্দনা মিত্র, শ্রমজীবী নারীমঞ্চ