ছবি: সংগৃহীত
জহর সরকারের ‘বহুত্ব, শেষ পর্যন্ত’ (২৭-১২) নিবন্ধ একটু আশার আলো দেখায়। ইদানীং চলার পথে বা বৈঠকি আড্ডায় সহযাত্রী বা বন্ধুদের কথাবার্তায় অনেকটা জুড়ে থাকে ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কিত আলোচনা। বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় বা কোনও একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায় ‘ভারতীয়’ জনগণের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর সেই আলোচনা। আলোচনার কিছুটা এ রকম— ‘দেশভাগের সময় আমরা দেখেছি (বা শুনেছি) রায়ট কী, ওরা কতটা উগ্র।’ জীবনে কোনও দিন কোনও অনুপ্রবেশকারীকে চোখে দেখেননি এবং জীবনের চলার পথে কোনও দিন কোনও অনুপ্রবেশকারীর অবৈধ হস্তক্ষেপ হয়নি, এ রকম বহু লোক প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে অনুপ্রবেশ নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত এবং একটা বিহিত চান।
বেকারত্ব, আর্থিক উন্নতির ক্রমহ্রাসমাণ সূচক এবং সর্বোপরি হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়ে জনসাধারণ ততটা উদ্গ্রীব নয়, যতটা অন্য ধর্মের লোকদের ‘টাইট’ দেওয়া নিয়ে। রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ বলছেন। তাতে কারও কোনও হেলদোল নেই, অথচ তাঁদের সন্তানেরা কোনও দিন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেলে ওঁরা নির্দ্বিধায় অনুমতি দেবেন। এই যে ধর্মীয় বিভাজন নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা হল এবং ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে, প্রায় শূন্য শিক্ষার এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে পরোক্ষ ভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলা হচ্ছে, এটা অশনি সঙ্কেত।
কিছু দিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজ়েশন’-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ পায়, ভারতীয়দের গড় মাসিক খরচের পরিমাণ ২০১১-১২-র তুলনায় ২০১৭-১৮’তে প্রায় ৪৫ টাকা কমে গিয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয়েরা আর্থিক ভাবে দুর্বল হচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে বাড়ছে ধর্মীয় বিভাজনের প্রতি আগ্রহ। যদি কোনও পরিকল্পনায় আর্থিক সঙ্কটের সঙ্গে বিধর্মী জনগণের সংখ্যাধিক্যকে জুড়ে দেওয়া যায়, তা হলে তো কেল্লা ফতে। আমরা নিজেরাই আমরা-ওরা করতে করতে লড়ব, আর পিছন দিকে এগিয়ে চলব। নেতারা ক্ষমতার স্থায়িত্বের নিশ্চয়তায় মুচকি হাসবেন।
এই সময়ে যদি সত্যিই ছাত্রদের হাত ধরে ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন বহুত্ব সকল ভারতবাসীর পথ চলাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়, এই পর্বে রক্ষা পাই। ওটাই আশা।
প্রতিম বয়াল
কলকাতা-১০৯]
রাজধর্ম
রাজভবন ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে, কিংবা জেলার প্রশাসনিক বৈঠক ডেকে জেলায় গেলে, রাজ্যপাল রাজধর্ম পালন করছেন না বলে যুক্তি দেখানো হচ্ছে। কারণ তিনি জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত নন, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা মনোনীত সাংবিধানিক প্রধান। যখন নির্বাচিত প্রশাসনিক প্রধান, দফতর ছেড়ে ধারাবাহিক ভাবে শাসক দলের মুখ হয়ে কাঁসর-ঘণ্টা নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন, সেটা কি রাজধর্ম পালন?
দেবব্রত সেনগুপ্ত
কোন্নগর, হুগলি
আশাকর্মী
‘স্বেচ্ছাসেবী’ (২৫-১২) শীর্ষক মর্মস্পর্শী সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা। ২০০৫ সালে ১২ এপ্রিল কেন্দ্রের প্রথম ইউপিএ সরকার ন্যাশনাল রুরাল হেলথ মিশন (এনআরএইচএম) ‘আশা’ প্রকল্প গ্রহণ করে। ‘আশা’ জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্যমিশনের তৃণমূলস্তরের কর্মিবাহিনী, সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী, ২৫-৪৫ বছরের গৃহবধূ, বিধবা, ডিভোর্সি। কর্মীদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু কেউই চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত নন। নিয়োগ করার সময় বলা হয়েছিল, কাজ বেশি কিছু নয়, মূলত গর্ভবতী মা ও শিশুদের কাছে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। এখন ৪৩টি দফায় বিভাজিত কাজের প্রতিটি প্রতি দিন এক জন কর্মীর করণীয়।
এলাকায় ১০০০-১২০০ জনসংখ্যা পিছু এক জন কর্মীকে শুধুমাত্র তাঁদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয় নয়, অন্য বহু রকমের তথ্য সংগ্রহ করে তা সুনির্দিষ্ট ভাবে সাজিয়ে নির্দিষ্ট আধিকারিকদের কাছে জমা করতে হয়। এ সবের পর তাঁকে প্রসূতি মা নিয়ে ছুটতে হবে হাসপাতালে। এক দিনে ভর্তি না হলে পরের দিন যেতে হবে, না হলে আবার তার পর দিন। গভীর রাত হলেও আশাকর্মীকে সঙ্গে যেতে হবে। কিন্তু তিনি কী ভাবে যাবেন, কী ভাবে ফিরবেন, সে দায়িত্ব তাঁর নিজের। সরকারি নিয়মে, কর্মীর শ্রম কী ভাবে পুরোপুরি কাজে লাগানো হবে তার সব নীতি ঠিক করা আছে, কিন্তু কর্মীর নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হবে, সে কথা লেখা নেই।
এক জন আশাকর্মী ৯ মাস ধরে যিনি গর্ভবতী মাকে ধারাবাহিক পরিষেবা দিলেন, কোনও অনিবার্য কারণে শেষ মুহূর্তে সঙ্গে না থাকতে পারলে, তাঁর প্রাপ্য ৩০০ টাকা কেটে নেওয়া হবে। শুধু একটি ক্ষেত্রেই এমন শর্ত নয়, প্রতিটি বিষয়ে সারা মাস দীর্ঘ শ্রম দিয়ে যখন এক জন কর্মী প্রত্যাশা করেন, এ বার তাঁর টাকা একটু বেশি উঠবে, তখন দেখা যায় একেবারে শেষে এ রকমই নানা শর্তের আবর্তে— করণীয় কাজ সবই শেষ হল, কিন্তু কর্মীটির পারিশ্রমিক আর পাওয়া হল না।
সরকারি নিদান হল, গর্ভবতী মাকে বাধ্যতামূলক ভাবে সরকারি ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হাসপাতালগুলিতে ডাক্তার-নার্সদের অপ্রতুলতা, সামগ্রিক পরিকাঠামোর দুর্বলতা— এই নিদানের সহায়তা করে না। হয়রানির ভয়ে বহু মা ব্লক হাসপাতালে যেতে চান না। তাই আর্থিক দুরবস্থা থাকা সত্ত্বেও, অজানিত আশঙ্কায় গর্ভবতী মা নার্সিং হোমে চলে যান। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে যে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন এখনও প্রসবের সময় হয়নি, তাঁর অধীনেই নবজাতক ভূমিষ্ঠ হল কোনও এক নার্সিং হোমে। এই ভাবে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি পরিষেবা থেকে, আর আশাকর্মী বঞ্চিত হন তাঁর ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে। সরকারি গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ঠিক না থাকার দায় শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে আশাকর্মীর উপর।
কাজের বোঝা বাড়তে বাড়তে আজ এমন অবস্থা— খেলা, মেলা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সারা দিন বাইরে বসে ডিউটি দেওয়া, নির্মল বাংলা, শৌচমুক্ত বাংলা, সবুজশ্রী, ডেঙ্গি নিধনে জঙ্গল সাফ করা, কে কোথায় বাইরে শৌচকর্ম করছে তার ছবি তুলে পাঠানো, বিডিও প্রদত্ত কাজ, পঞ্চায়েতের কাজ, কী না করতে হচ্ছে। যে হেতু আশা ‘স্বেচ্ছাসেবী’, তাই তাঁকে এই সব ‘স্বেচ্ছায়’ বিনা পারিশ্রমিকে করতে হবে।
আশার নয়া বিড়ম্বনা দিশা। সরকারি হাসপাতালে এক মাস করে ডিউটি দিতে হবে প্রত্যেককে। তাতে যাতায়াত ভাড়া বাবদ মোট ৩০০ টাকা, আর পারিশ্রমিক ১৭০০ টাকা, মোট ২০০০ টাকা মাসে। অথচ দূর থেকে হাসপাতালে যাতায়াত এবং খাওয়া-খরচ মিলিয়ে ওই কর্মীর খরচ হয়ে যায় কমপক্ষে ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সারা রাজ্যে প্রায় কোনও হাসপাতালে রাতে ডিউটি করে থাকার মতো নির্দিষ্ট ঘর, বাথরুম প্রভৃতি ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই। এই অবস্থায় ডিউটি না করতে চাইলে ভয় দেখানো তো আছেই, তার উপর স্বাস্থ্যকর্তা বলেছেন, অসুবিধা যা-ই হোক, সরকারি কাজ সবই করতে হবে। না পারলে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে। প্রসঙ্গত, রাতদিন পরিশ্রম করে মাসের শেষে আশাকর্মীরা যা পান, তা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির থেকেও অনেক দূরে।
২০১৭-র ১৮ ডিসেম্বর রাজ্যের ২৫-৩০ হাজার আশাকর্মী কলকাতায় তাঁদের নিজস্ব সংগঠনের এক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধ’-এ ৫০,০০০ আশাকর্মীকে শো-কজ়ের নোটিস ধরানো হয়েছিল, শো-কজ় করা হয়েছিল রাজ্যের সমস্ত ডিএএফ, বিএএফ-দেরও। তা নিয়ে আশাকর্মীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। এত রকমের বঞ্চনার সঙ্গে সেই ক্ষোভ তাঁদের মধ্যে আজও অটুট।
ইসমত আরা খাতুন
সম্পাদিকা, পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়ন
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।