Society

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম গৌণ, মুখ্য ভোট

ভারতীয় সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার ‌‌উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দিক রাজনৈতিক দলগুলি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৪:৪৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘ধর্ম-কাঁটায় গণতন্ত্র’ (২৫-১) শীর্ষক প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বলা আছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কোন‌ও ধর্মের সুবিধা করে দেবে না, বা কোনও ধর্মের বিরোধিতাও করবে না। অথচ, ধর্মের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সমর্থন টানার একটা প্রতিযোগিতা যেন রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলের কোনও জননেতা বা জননেত্রী ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে কোনও ধর্মীয় স্থলে বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন, এটা কি যুক্তিযুক্ত? তা সে একটা ধর্মেরই হোক বা সব ধর্মেরই হোক। জননেতা বা জননেত্রীকে যদি ধর্মস্থানে যেতে হয় বা ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান পালন করতে হয়, তা হলে তা একান্ত ব্যক্তিগত স্তরেই পালন করা উচিত, এবং প্রচারের আলোকে না এসেই। অন্যথায় সাধারণ মানুষ তাতে প্রভাবিত হতে পারেন।

Advertisement

যা ঘটে চলেছে, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষ আজ বিভ্রান্ত। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, দৈনন্দিন চাহিদা, তা সে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা নিত্যদিনের জিনিসপত্রের মূল্য ও জোগান, পেট্রল, ডিজ়েল, রান্নার গ্যাসের চড়া দাম, বেকারত্ব, যোগ্য প্রার্থীদের চাকরির প্রত্যাশায় দিনের পর দিন প্রতীক্ষা, শ্রমিকের এবং কর্মচারীদের যথাযোগ্য মজুরি ও প্রাপ্যের সংস্থান প্রভৃতি সঙ্কট আজ রাজনৈতিক দলগুলির কাছে গৌণ হয়ে গিয়েছে। মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কী করে মানুষকে সম্মোহিত করে ভোটটা নিজের দলের বাক্সে সংগ্রহ করা যায়। এবং সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।

ভারতীয় সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে মানুষকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার ‌‌উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দিক রাজনৈতিক দলগুলি। পাশাপাশি, মানুষের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিসগুলির চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন, দায়িত্ববান রাজনৈতিক দলগুলিকে সে সবের জোগানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

Advertisement

সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া

প্রভুত্ববাদ

‘রাজসূয় পর্বের পরে’ (২৩-১) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ঘোর কলিতে বিচরণ করেও দেশের প্রজারা রাম রাজত্বের স্বপ্নে বিমোহিত হলেন। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা দেশের প্রধানমন্ত্রী এগারো দিনের ব্রত পালন শেষে দেশবাসীকে শোনালেন দেব থেকে দেশ এবং রাম থেকে রাষ্ট্রের চেতনা উন্মেষের কথা। ‘অচ্ছে দিন’-এর কারিগর অযোধ্যার রাজসূয় যজ্ঞে বসে রামলালার পদযুগলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন।

নব্বইয়ের দশকে আডবাণীজির হাত ধরে শুরু হওয়া মন্দির আন্দোলন শেষ অবধি নরেন্দ্র মোদীর হাতেই বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। সত্যিই কি আদর্শ সনাতন ভক্তিবাদে এত ঐশ্বর্য, আড়ম্বরের কোনও স্থান আছে? না কি দেব দ্বিজে ভক্তি প্রকাশ্যে একটা দেখানোর জিনিস! মন্দির স্থাপনের পর ধর্মীয় আস্থার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলেও ভবিষ্যতের ‘রামরাজত্ব’-এ কতটা সুস্থ, নিরাপদ বাতাসে ভারতীয় জনগণ বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন? না কি এ সবই কথার কথা হয়ে শুধুমাত্র ভোটযুদ্ধ জয়ের হাতিয়ার হিসাবেই রয়ে যাবে? সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র ভারত আজ যেন এক হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠার স্বপ্নে মশগুল, তা অযোধ্যা মন্দিরে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্যেই পরিস্ফুট হয়।

১৯৯৯ সালের ২২ জানুয়ারির রাতে দুই শিশুপুত্র-সহ ওড়িশার মিশনারি গ্রাহাম স্টেনসকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। বজরং দলের হাত থাকা সেই হত্যায় শ্রীরামের নামে জয়ধ্বনিও দেওয়া হয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে একই দিনে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনেও বহুত্ববাদের ভারত প্রায় ঢাকাই পড়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের উদ্দেশে বলেছেন যে, এক দল মানুষ এক সময় বলতেন, রামমন্দির নির্মাণ করলে দেশে আগুন লেগে যাবে। তিনি বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখে, ভাবাবেগের জয়কে প্রাধান্য দিয়ে, আইন মেনে মন্দির স্থাপনের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত এ প্রসঙ্গে মনে হয়, দেশবাসী আইনে যে আস্থা রেখে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্ররোচনায় পা দেয়নি, সেটাই কুর্নিশের যোগ্য। এবং তা বহুত্ববাদের আস্থার প্রতীক হিসাবেই প্রতিফলিত হয়।

সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে যে, মন্দিরময় ভারতে অযোধ্যার মন্দিরও এক স্থাপত্যকীর্তি হিসাবেই দেখা হবে। দেশ জুড়ে বহু দেবালয়ই স্থানীয়, আঞ্চলিক, এবং বৃহত্তর পরিসরে মানুষের পরম আশ্রয়স্থল হিসাবে বন্দিত। কিন্তু সেই ধর্মীয় ভারতকে যখন কোনও রাজনৈতিক দল রাজনীতির অঙ্গ করে নেয়, বিরোধী দল নরম হিন্দুত্বের দাবিদার হয়েও অনেকাংশে ধর্মীয় রাজনীতির বেসাতি করে চলে, তখন বোঝা যায় রাজনীতি কেবলই বিভাজনের চিন্তায় আক্রান্ত। সম্পাদকীয়তে ভারতের যে সত্য ধর্ম জীবনের গতিরেখার কথা বলা হয়েছে, তা অবশ্য রাজনীতি আর ধর্মকে আলাদা রাখার কথাই বলে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বস্ত সহকারী আবিদ হাসানকে বলেছিলেন, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়, এক ব্যক্তি ও তাঁর বিশ্বাসের মধ্যে। ধর্মকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে টেনে আনা উচিত নয়।

অসমাপ্ত মন্দিরেই রামলালাকে প্রতিষ্ঠা করে লোকসভা ভোটের বৃহত্তর মঞ্চকে সামনে রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চলেছে কেন্দ্রের শাসক দল। মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যকে সুচারু কৌশলে দল এবং রামমন্দিরের মঞ্চে রাখা হয়নি। হিন্দুত্বের কান্ডারি নরেন্দ্র দামোদর মোদীই যে বর্তমান ভারতের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, এ কথা সর্বস্তরের মানুষই বিলক্ষণ জানেন-বোঝেন।

সঞ্জয় রায়, হাওড়া

উঠুক ছাড়

‘ছাড়-পত্র’ (২৭-১) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে এই পত্রের অবতারণা। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্যোক্তা গিল্ডের তরফে প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের জানানো হয়েছিল মেলায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ছাড়ে বই বিক্রির জন্য। বইমেলায় চিরকালই এই ১০ শতাংশ ছাড়ের নিয়ম বলবৎ আছে। এই বছরেও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু কলকাতারই কলেজ স্ট্রিটে কমপক্ষে কুড়ি থেকে শুরু করে চল্লিশ শতাংশ ছাড়েও নতুন বই বিক্রি হয়। বইমেলায় যাতায়াতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হিসাবি পাঠক তথা ক্রেতা সহজে মেলার স্টল থেকে বই কেনেন না। কিন্তু তাঁরা প্রতি বারেই মেলায় আসেন এবং নিয়ম করে পছন্দের স্টলগুলি থেকে প্রকাশকের তরফে দেওয়া বিনামূল্যের পুস্তক-তালিকার বুকলেটটি সংগ্রহ করেন। তার পরে তালিকা ধরে পছন্দের বইগুলি সারা বছর ধরে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান থেকে অনেক বেশি ছাড়ে কিনে নেন।

তবে সম্পাদকীয়তে যথার্থই লেখা হয়েছে— এক শ্রেণির প্রকাশক বইয়ের দাম মুদ্রণ খরচ অপেক্ষা অনেক বেশি বাড়িয়ে লিখে রাখেন এবং ক্রেতাদের বেশি ছাড়ে তা বিক্রি করেন। ছাড়ের ক্ষেত্রে সাম্যও থাকে না। ফলত এই ধরনের লোভনীয় ছাড়ে আখেরে ক্ষতিই হয় বই-প্রেমিক ক্রেতাদের। তাই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় এবং বইমেলাতেও ‘ছাড়-সংস্কৃতি’র বর্জন কাম্য। বই বিক্রিতে ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ উঠে গেলে প্রকাশকেরাও আর অহেতুক বইয়ের দাম বেশি রাখবেন না। বই যে-হেতু ভোগ্যপণ্য নয়, তাই অর্থনীতির চাহিদা-জোগানে ভারসাম্য ও সেই কারণে মূল্যবৃদ্ধির প্রচলিত নিয়ম এখানে খাটে না। বইয়ের মুদ্রণসংখ্যা ও সংস্করণ বেশি হলে, অর্থাৎ বই বিক্রি বেশি হলে বইয়ের দামও কম হবে। দাম কম হলে বইও সকল শ্রেণির পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।

তাই বইয়ের উপর সব রকম মূল্য ছাড় উঠে যাক। এতে রক্ষিত হবে পাঠক ও প্রকাশক উভয়েরই স্বার্থ। সাম্য বজায় থাকলে সুস্থতার দিশা পাবে বাঙালির বই-সংস্কৃতি। খুশি হবেন ক্রেতারা, বাঁচবেন প্রকাশকও।

অনামিকা পাল, আমতা, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement