রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন শক্তি, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, বিশ্বমানবের কল্যাণ করা তাঁর কাজ নয়। ফাইল চিত্র।
সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কবিতায় খোঁজা সময়ের মুখ’ (১৭-১২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। পঞ্চাশের দশকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন লেখালিখি শুরু করেন, তখন রবীন্দ্র-অনুসারী কবিরা সাহিত্য রচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন। নতুন কিছু সৃষ্টির বদলে পৌনঃপুনিকতায় আক্রান্ত। অন্য পক্ষে, আধুনিকের দল পৃথক হওয়ার সাধনায় ক্রমশ বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিলেন। সেই সময়ে নতুনের দল অতি নিরাবরণ ভাবে, আন্তরিক সততার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন তাঁদের প্রতি দিনের জীবনের ছবি। বহু তরুণ পাঠক-পাঠিকা সেগুলির মধ্যে দেখতে পান নিজেদের জীবনের প্রতিফলন। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা কবিতা আবারও জনপ্রিয় করে তোলার কান্ডারি ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এ ব্যাপারে তাঁর কৃতিত্ব অনেকখানি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মরণে কবি শঙ্খ ঘোষ লেখেন, “...যে বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, সেই বিশ্বের বিরুদ্ধে তখন জেগে উঠতে থাকে একটা বালকোচিত অভিমান, সহ্য করতে না পারার অভিমান। এই বিরূপতার সামনে এসে তার শূন্যতার ব্যাপ্তি দেখে তার ব্যাপক আঘাতে তখন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কেউ, কেউ হতে পারে আত্মঘাতী, আর কেউ-বা এর সামনে এসে দাঁড়াতে পারে-দাঁড়াতে চায়— আরেকটা কোনো প্রত্যাঘাত নিয়েই।” (‘এই শহরের রাখাল,’ শঙ্খ ঘোষ, দেশ, ২০ মে, ১৯৯৫)।
এই নিবন্ধে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, সেই প্রত্যাঘাতের অস্ত্র কখনও হয়ে দাঁড়ায় রাগ বা বিদ্রুপ, কখনও নিবিড় কোনও বোধি, আবার কখনও অস্ত্র করতে চায় কেবল ভালবাসাকে। “ছেলেটি বলতে চেয়েছিল সেইটুকুই, সেই ভালোবাসা দিয়েই শহরের অনড় বিন্যাসটাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল সে, কেননা ভালোবাসাই তার কাজ, কেননা ‘ভালোবাসা ছাড়া কোনো যোগ্যতাই নাই এ দীনের।’ এটাই তার আত্মার ধর্ম।” শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে শঙ্খ ঘোষ আর এক জায়গায় বলেছেন, “সংসারের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে, তাঁর নিজস্ব কোনো ঈশ্বরের মধ্যে নিজেকে খুঁজে বেড়ানোই তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা।” রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন শক্তি, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে, বিশ্বমানবের কল্যাণ করা তাঁর কাজ নয়। কবিতার কোনও ‘বাস্তবিক উদ্দেশ্য’ আছে, তা তিনি ভাবতেন না। তা সত্ত্বেও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মধ্য দিয়ে সমাজকে, সময়কে ছুঁতে পারার একটা পথ পাওয়া যায়।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এক একান্ত কথোপকথনে বলেছিলেন— তাঁর এক-এক সময় মনে হয়, এই যে তিনি এত লিখেছেন, তা কি হয়েছে কিছু? এই পদ্যগুলো টিকবে? আবার এক-এক দিন মনে হয়েছে, তিনি মন্দ লেখেননি। কী করে যে লিখেছেন, তিনি নিজেও জানেন না। যেন ম্যাজিকের মতো শব্দ এসেছে, তিনি লিখে গিয়েছেন। নিজের পদ্যগুলোই তাঁর নতুন, অচেনা মনে হয়েছে।
নিজেকেই মাঝেমধ্যে নিজের অচেনা লাগা কবির কবিতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অশ্রুকুমার সিকদার লিখেছিলেন, “যারা নিরতিশয় প্রকৃতিস্থ তাদের চোখে সত্য ধরা দেয় না— বহিরাবরণের পর্দা কোনো দিব্য দৃষ্টি দিয়ে ভেদ করতে না পারলে চূড়ান্ত খবর অজানা থেকে যায়।”
তবুও চূড়ান্ত খবর আনতে মূল্য চোকানো কবি আগামীর লক্ষ্যে শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে আবার কৃত্তিবাস বার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কাদের জন্য পত্রিকা বেরোবে, প্রশ্ন করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “তরুণদের জন্যে। এখন যারা নতুন লিখছে। তাদের তো কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই।” আগামী দিনের মুখগুলিকেও খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন হৃদয়পুরের কবি।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
কবির শ্রম
সুমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন ‘কবিতা লেখা, লিখতে পারা এক অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ।’ এ ক্ষেত্রে পরিশ্রম অর্থে মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহারকেই বুঝতে হবে। মেধা বলতে বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি, ধীশক্তি— এ সমস্ত কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তবে, ইচ্ছাশক্তি এবং সম্বিৎ-এর যে দ্বৈততা, তার প্রকাশ না ঘটলে কবিতা লেখার মুহূর্ত তৈরি হয় না।
বেসুরো-বেখাপ্পা এক অন্ধকারময় জগৎ কিংবা রহস্যের স্তরভূমি থেকে এক জন শিল্পীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। কবিমনের স্বরূপ প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়। আবার, আক্ষরিক অর্থে পরিশ্রমের যে উদ্যোগ, তা ব্যতিরেকেও কবিকে কখনও কখনও দেবতাদের সন্ধানে তৎপর হতে হয়। দার্শনিক হাইডেগার কবিমনের ভাব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সুরার দেবতা (ওয়াইন গড) এবং পলায়নপর দেবতার (ফিউজিটিভ গড) কথা লিখেছেন। রিক্ত সময়কালের কবি মাদকাসক্তির টানে উজ্জীবিত হতে চান বলেই সুরাদেবতার পশ্চাদ্ধাবন করেন, এবং এ কৌশলেই পলাতক দেবতাকে অনুসরণ করেন।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
তীক্ষ্ণ কলম
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘরের মানুষ’ (রবিবাসরীয়, ১১-১২) শীর্ষক প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ও বৈচিত্র রূপায়ণে রমাপদ চৌধুরী ছিলেন অতুলনীয়। অরণ্যের আদিমতা থেকে শহুরে মধ্যবিত্ত মানস, ও তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন নিপুণ, নির্মম। পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ‘দরবারী’ নামক গল্প লিখে। বিষয়বস্তু এবং উপস্থাপনার গুণে পাঠক মহলে জোরালো ছাপ ফেলেছিল তাঁর ‘বিবিকরজ’, ‘রুমাবাঈ’ প্রভৃতি গল্প। মধ্যবিত্ত সঙ্কীর্ণতা, অন্তঃসারশূন্যতা, স্ববিরোধিতা ও ভ্রান্ত মূল্যবোধের চূড়ান্ত শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে ‘উদয়াস্ত’, ‘মনবন্দী’, ‘শুধু কেরানী’, ‘জ্বালাহর’, ‘ডাইনিং টেব্ল’, ‘ড্রেসিং টেব্ল’-এর মতো নানা গল্পে। আবার সাংসারিক একঘেয়েমির আবর্তে লুকিয়ে থাকা হৃদয়ব্যথার প্রকাশের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে ‘ঝিনুকের কৌটো’ গল্পটি। কোলিয়ারি ও সাঁওতাল জনবসতির পরিবেশ পটভূমিতে লেখা জীবনের ট্র্যাজিক বিষণ্ণতার মর্মস্পর্শী কাহিনি তাঁর ‘রেবেকা সোরেনের কবর’ গল্পটি, যা এক অদ্ভুত মাদকতায় পাঠকের মন বার বার ছুঁতে চায়। অতীতের মোহময়তা ও কামনার নগ্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে তাঁর ‘মাধবিকা’ নামক গল্পটি। অন্য দিকে, আবেগধর্মী, কাব্যিক উপস্থাপনায় আজও জ্বলজ্বল করছে তাঁর ‘তিতিরকান্নার মাঠ’ এবং ‘করুণকন্যা’ শীর্ষক গল্প দু’টি।
বৈচিত্রপিয়াসি রমাপদ চৌধুরী খারিজ, লজ্জা, হৃদয়, বা বাড়ি বদলে যায়-এর পাশাপাশি লিখেছিলেন এখনই, পিকনিক-এর মতো উপন্যাসও। সেখানে যুবক-যুবতীর হতাশা, অস্থিরতা, স্বপ্ন এবং আত্মময়তা নিয়ে মনস্তত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে। এ কালের বিভ্রান্ত যুবমানস মনে করে “আজকের জীবনে ছোট ছোট সুখ আছে, আনন্দ নেই। দুঃখ আছে, গভীর বিষাদ নেই। আজকের জীবন ট্র্যাজেডিও না, কমেডিও না” (এখনই উপন্যাস)। তাঁর বনপলাশির পদাবলী-র সূত্র ধরে মনে পড়ে ভুবনেশ্বরের এক হোটেলের বহু বিচিত্র চরিত্র নিয়ে লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস, এই পৃথিবী পান্থনিবাস-এর কথা। তবে উঁচুতলার প্রতিপত্তি ও ঈর্ষাতুর নীচমনা ডাক্তার সমাজের চক্রব্যূহে বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনি ‘অভিমন্যু’ রমাপদ চৌধুরীকে আলাদা ভাবে চেনায়।
ভাষার সাবলীলতা ও সমকালীন জীবনের শৈল্পিক প্রকাশে রমাপদ চৌধুরীর অনেক রচনাই আজও অত্যন্ত আদরণীয়।
সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি
অকারণ বৃদ্ধি
জঙ্গিপুর রোড-শিয়ালদহ (৭৩১৫২) ‘ডেমু’ ট্রেনটি বর্তমানে ‘স্পেশাল’ ট্রেন হিসেবে চলাচল করছে। কোভিডের পর এই ট্রেনটিকে স্পেশাল ট্রেন হিসেবে পরিবর্তিত করা হয়। কিন্তু এর জন্য ভাড়া ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকা হলেও ট্রেনের গতি বা অন্য সুযোগ-সুবিধা কিছুই বাড়েনি। স্পেশাল ট্রেন হিসেবে সময়েরও বিশেষ পার্থক্য নেই। তবে শুধু শুধু ভাড়া বৃদ্ধি কেন?
শান্তনু সিংহ রায়, জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ