কোনও দেশের সরকারের কুশাসন ও বিভেদনীতি একটি দেশ ও জাতিকে কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারে, সেটা বোঝা যায় কৌশিক বসুর ‘বাংলা এ বার পথ দেখাক’ (৫-৪) প্রতিবেদনটি পাঠ করে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারত আগে কখনও নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকারের মতো সরকার দেখেনি, যা সংবিধান-প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলিকে প্রতি দিন উপেক্ষা করে ধর্ম, জাতপাতের নামে সংখ্যালঘু, দলিত ও প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকাকেই দুর্বিষহ করে তুলছে। দেশের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে সরিয়ে, এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের সংস্কৃতি জোরপূর্বক বলবৎ করার লক্ষ্যে এই সরকার অবিচল। নারীদের প্রতিনিয়ত অপমান, কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের অধিকার খর্ব করে দেশ জুড়ে যে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, তাতে দেশের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন।
এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। একদা স্বস্তিদায়ক আর্থিক উন্নতি এই সরকারের ভ্রান্ত নীতি— নোট বাতিল ও তড়িঘড়ি জিএসটি চালু করার সিদ্ধান্তে কার্যত পঙ্গু হয়ে পড়েছে। সরকার কখনও তার ব্যর্থতা মানবে না। সব দোষ এই অতিমারির। এখন রাজকোষ ঘাটতি পূরণ করার সহজ উপায়, দেশের সম্পদ বিক্রি করা। এই সরকারের আমলে পরম সুবিধা হয়েছে শুধুমাত্র বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির। সরকারি সুযোগ-সুবিধার দৌলতে এদের মুনাফা অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়ে চলেছে, যা বিশ্বের বিস্ময়। সমস্ত স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম প্রভৃতিকে করায়ত্ত করে এক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে এরা আগুয়ান। এখন বিজেপি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে। বিধানসভা নির্বাচনে রং-বেরঙের প্রতিশ্রুতির ফানুস উড়িয়ে আর বাংলার মনীষীদের জয়গান গেয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছে। বাংলার সামনে আজ দেশকে পথ দেখানোর কঠিন পরীক্ষা।
দেবকী রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়, উত্তরপাড়া, হুগলি
অবিশ্বাস্য
কৌশিক বসুর নিবন্ধে জানতে পারলাম, তদানীন্তন ইউপিএ সরকারের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে লেখকের বাম মতাদর্শের তোয়াক্কা না করেও তাঁকে উপদেষ্টার পদে পেতে চেয়েছিলেন। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ নির্বাচনে যে কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের এটিই তো সঠিক সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বর্তমান বিজেপি সরকারের সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে উর্জিত পটেল কিংবা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতিবিদদের রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদ ছাড়তে হল, কারণ সরকারের সঙ্গে তাঁদের চিন্তা মেলে না। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারও কিন্তু এই অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পারে না। আমাদের রাজ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির নিজেদের কৃতকর্মের মূল্যায়ন করার অভ্যেস শুরু থেকে একেবারেই নেই। তাই যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তারা কার্যত বিরোধী দলগুলিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। রাজ্যের উন্নয়নের জন্যে সমস্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে সৌজন্য ও সমন্বয় প্রয়োজন, তা ক্ষমতাসীন সরকার কখনও উপলব্ধি করতে পারে না। ফল মেলে ৩৪ বছরে কিংবা ১০ বছরে।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার কথাই শুনে আসছি, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের মতো কেন্দ্রের কাছ থেকে রাজ্যের বরাদ্দ আদায় করা বা রাজ্যের উন্নয়নের কোনও সমাধান এই ৪৪ বছরেও সম্ভব হল না কারও পক্ষে। ডবল ইঞ্জিনেও যে তা সম্ভব হবে না, সেটা বোঝা গিয়েছে লোকসভা ভোটের ফলের পর। বাংলার ১৮ জন সাংসদের এক জনের ভাগ্যেও পূর্ণমন্ত্রীর শিকে ছিঁড়ল না। ‘রেজিমেন্টেড’ দলে শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই শিরোধার্য। এটা কংগ্রেস দল নয় যে, ইচ্ছে করলেই যে কোনও নেতা দলে থেকেও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতে পারবেন। বিধানচন্দ্র রায়ের পর বাংলার উন্নয়নে পথপ্রদর্শক আর কারও কথা মনে পড়ছে না। তাঁকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের ডবল ইঞ্জিনের অংশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলায় শিল্পস্থাপনের জন্যে অনেক কসরত করতে হয়েছিল। আর এক জন ডবল ইঞ্জিনের ভাগীদার না হয়েও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের কাছ থেকে মেট্রো রেল প্রকল্প নিয়ে এসেছিলেন কলকাতার জন্যে। তিনি বরকত গনি খান চৌধুরী। পশ্চিমবঙ্গে তখন বাম জমানা হলেও পূর্ণ সহযোগিতা ছিল কংগ্রেস সাংসদের সঙ্গে। এটাই রাজনৈতিক সমন্বয় এবং সৌজন্য। এর পরের আমলে সবটাই রাজনীতি। বাংলার রাজনীতিকরা উন্নয়নের পথ হারিয়েছে রাজনীতির চোরাগলিতে, তাই যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বাংলা দেশকে পথ দেখাবে— এ কথা বিশ্বাস হয় না।
পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪
বেশ স্বচ্ছ
সম্পাদক (‘অস্বচ্ছ’, সম্পাদকীয়, ৫-৪) আশ্বাস দিয়েছেন, “আপাতত স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমিতেছে না।” এতে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। বরং যে পদ্ধতিতে সুদ হ্রাসের সংবাদ প্রকাশিত হল এবং আপাতত প্রত্যাহৃত হল, তা দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলল আরও। সম্পাদকীয় নিবন্ধটির শিরোনাম ‘অস্বচ্ছ’ হলেও এ পদ্ধতি ভয়ঙ্কর ভাবে স্বচ্ছ। এর নেপথ্যে আছে সাধারণ আমানতকারীর দাবি উপেক্ষা ও অবহেলা করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদ এড়িয়ে যখন খুশি সরকারি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত কার্যকর ও প্রত্যাহার করার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা। আগে মনে হত, সরকার কী আর এই বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেবে? হয়তো ঘুরপথে কার্যকর করবে ধীরে ধীরে। কিন্তু নোট বাতিল, লকডাউন ঘোষণা ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার জেনে গিয়েছে, বিরোধিতাকে পাত্তা না দিলেও চলে।
বামপন্থীরা এ মুহূর্তে সবচেয়ে দুর্বল, অতএব সাঙাততন্ত্রের পরামর্শে সরকার চলছে। সরকারের ক্ষতি, জনগণের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি কিন্তু সাঙাততন্ত্রের লাভ। স্বচ্ছ হিসেব। কৌশিক বসু ‘বাংলা এ বার পথ দেখাক’ নিবন্ধে লিখেছেন, ২০১৬ সালের পর থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হারের নিরিখে ভারত এখন দুনিয়ায় ১৬৪তম স্থানে। এই ক্রমিক অধঃপতনই উন্নয়ন।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
এত সন্ত্রাস
পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে নিজের লজ্জা লুকানোর জায়গা পাওয়া গেল না। সমগ্র ভারত যা পারে, কেন আমরা সেটা পারি না? কেন এত সন্ত্রাস? ভোটের আগে নির্বাচন কমিশন যে সাত-আটশো কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এল, বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করল, তাতে হলটা কী? এঁরা তো প্রার্থীকেই নিরাপত্তা দিতে পারছেন না, তা হলে সাধারণ মানুষকে কী নিরাপত্তা দেবেন? উল্টে এঁদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ উঠছে। কোথাও নাবালিকার শ্লীলতাহানি, তো কোথাও নিরীহ গ্রামবাসীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠছে।
টিভিতে দেখা গেল, আরামবাগের রাস্তায় এক রাজনৈতিক দলের মহিলা প্রার্থীকে বাঁশ, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে তাড়া করেছে কিছু রাজনৈতিক উন্মাদ। প্রার্থীর মৃত্যুও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কী জবাবদিহি করত? আবার উলুবেড়িয়ায় দেখলাম আর এক মহিলা প্রার্থীকে সপাটে চড় মারতে। আরও দু’তিন জায়গায় প্রার্থীরা আক্রান্ত হয়েছেন, বা প্রার্থীর প্রতিনিধি নিগৃহীত হয়েছেন। কেন এমন হল? এর শেষ কোথায়?
১৯৭২ সালে আমি স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। সেই বছর সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গড়ল। কিন্তু চারিদিকে আওয়াজ শুনতাম যে, ভোট সুষ্ঠু ভাবে হয়নি। ভয়ানক সন্ত্রাস হয়েছে এবং ছাপ্পা ভোট পড়েছে। বিরোধী পক্ষকে বুথে বসতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বামপন্থীরা পাঁচ বছরের জন্য বিধানসভা বয়কট করল। এর মধ্যে মূল যে বিষয়টা উঠল সেটা হল, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এই বারের বিধানসভা নির্বাচনেও তো সেই অশনিসঙ্কেত।
সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি