Refugees

সম্পাদক সমীপেষু: হৃদয়ে স্বদেশ

এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট সকালে তাঁর বাবা ধরা গলায় বলছিলেন, ভারত স্বাধীন হলেও তাঁরা নিজেদের দেশ হারিয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৭
Share:

লক্ষ লক্ষ বাঙালি ও পঞ্জাবি নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। প্রতীকী ছবি।

সেবন্তী ঘোষের ‘হারানো ভিটার খোঁজ’ (১৭-৩) পড়তে পড়তে রক্তাক্ত হৃদয়ে বার বার মনে পড়ছিল আমার পরলোকগত বাবা-মা’কে। ভিটেমাটি হারিয়ে এক কাপড়ে ‘দ্যাশ’ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার উদ্‌যাপন এ দেশেই করেন তাঁরা। তথাপি অনেক সময়ই কথায় কথায় হারানো ‘দ্যাশ’-এই ফিরে যেতেন। এক সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট সকালে তাঁর বাবা ধরা গলায় বলছিলেন, ভারত স্বাধীন হলেও তাঁরা নিজেদের দেশ হারিয়েছেন। র‌্যাডক্লিফ-এর ছুরি উপমহাদেশের মানচিত্র পাল্টে দিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ও পঞ্জাবি নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। পড়শি মুসলমান সোলেমান ভাই, বশির চাচা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চাপিয়ে দিয়ে ‘দ্যাশ ছাড়তে’ যে সাহায্য করেছিল, সে কথা বলতে গিয়ে গলায় কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ত আমার মায়ের। কুয়াশা-মাখা ভোরবেলায় খেজুর রসের সঞ্জীবনী সুধা পানের স্মৃতি বাবাকে নস্টালজিক করে দিত। সঙ্গী-সহচরদের কথা কত বলতে শুনেছি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বোলপুরের কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতরের এক কর্মী কোনও ভাবে জানতে পারেন ‘দ্যাশ’-এর পড়শি আমার বাবার কথা। খুঁজেপেতে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। আবেগ যেন বাধ মানে না। দেশ-হারানো মানুষের কাছে তখন দু’মুঠো ভাতও ছিল অনিশ্চিত। কে আর যন্ত্রণার দিনলিপি মনে করতে চায়! তবু এ দেশে এসেও তাঁরা হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন তাঁদের ফেলে আসা দেশ। নেতাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের মূল্য দিতে হয়েছিল এঁদের। নিশ্চিত জীবন ছেড়ে প্রতি পদক্ষেপে অনিশ্চয়তার হাতছানি মেনে নিতে বাধ্য হলেও, বরিশালের ঝালকাঠি বা কুমিল্লা তাঁদের স্মৃতিতে সদা বিরাজমান।

Advertisement

দেবাশিস দাস, বোলপুর, বীরভূম

মিলনের সেতু

Advertisement

সেবন্তী ঘোষের ‘হারানো ভিটার খোঁজ’ পড়ে মনটা ভাল লাগায় ভরে গেল। বড় নরম করে তিনি লিখেছেন দু’বাংলার ভিটেছাড়া মানুষের আর্তি যেখানে আছড়ে পড়েছে, সেই ‘বঙ্গভিটা’ গ্রুপের কথা। সত্যি, কথা ছাড়া দুই বাংলার মধ্যে মুক্ত বাতাসের চলাচল আর কিসেই বা হতে পারত! পাঁচ বছর আগে এই পেজ-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। আসলে ভিটেমাটি, ঘরবাড়ি তো শুধু স্থাবর-অস্থাবর কিছু জিনিস নয়, এর সঙ্গে জুড়ে থাকে স্নেহ, প্রীতি, মায়ার টান, আত্মার বন্ধন। তাই ভিটেহারা মানুষ যখনই সমাজমাধ্যমে এই গ্রুপের খোঁজ পেয়েছেন, তখনই যুক্ত হয়ে গেছেন। মাঝে দু’বছর করোনা অতিমারির জন্য কিছু ছেদ পড়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল কিছু গোষ্ঠী, যারা ইচ্ছা করে দুর্গাপুজোর মণ্ডপে কোরান রেখে দাঙ্গা বাধিয়েছিল, তাদের জন্যও অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছিল। অনেক সদস্য অভিমানভরে লিখেছিলেন, “বাংলাদেশে পূর্বপুরুষের ভিটে দেখার সব ব্যবস্থা করেছিলাম, কিন্তু সে আশায় ছাই পড়েছে, কখনও যাব না ওপার বাংলায়।” সে দুঃসময় কেটে গেছে। নবীন প্রজন্মের অংশগ্রহণ কথোপকথনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একটি মেয়ে তার দিদিমার থেকে পাওয়া বাংলাদেশের কোনও একটি অঞ্চলের স্বর্ণকারের গড়া সোনার নেকলেসের ছবি দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওপার বাংলা থেকে মন্তব্য এল, হ্যাঁ, এটি অমুক অঞ্চলের সোনার কারিগরদের কাজের বিশেষত্ব। ‘বঙ্গভিটা’য় যোগাযোগের পরে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশে তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটে দেখতে যাচ্ছেন এবং সেখানকার বন্ধুদের আতিথেয়তায় আপ্লুত হচ্ছেন। এক বয়স্ক ভদ্রলোক খুলনার সেনহাটিতে তাঁদের পৈতৃক ভিটে দেখতে গিয়েছিলেন। সেনহাটির বিখ্যাত স্কুল, যার ছাত্ররা ব্রিটিশ আমলে আইসিএস হত, সেখানে তাঁর বাবা পড়েছিলেন। সেই স্কুল দেখতে গিয়ে তিনি সংবর্ধনা পেলেন, অভিভূত হলেন মানুষের ভালবাসায়। সে বন্ধুত্ব এমনই যে ওপার বাংলার সেই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এখন দিল্লি, আগরা ভ্রমণ করছেন। এমনই অসংখ্য গল্প সমাজমাধ্যমের এই পেজের পাতায় পাতায়।

শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১

চাষির সঙ্কট

চাষিরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলান, এটা সবার জানা। কিন্তু এই পরিশ্রমের মাত্রা যে কতখানি, সেটা সবার জানা নেই। লাঙলের জায়গায় ট্র্যাক্টর, পাওয়ার টিলার এসেছে, কিন্তু অন্য শ্রমগুলি প্রায় একই আছে। জমিটা তৈরি হওয়ার পর শুরু হয় বীজ বপন। কোন ধান, কতখানি জলে কত সময় থাকলে সুস্থ অঙ্কুরোদ্গম হবে, অভিজ্ঞ চাষি তা জানেন। সেই ধান মাঠে নিয়ে গিয়ে নিয়ম মেনে তিনি বপন করেন। বীজ সবাই সঠিক ভাবে বুনতে পারে না। এক জায়গায় অধিক বীজ দিয়ে ফেললে গাছ ভাল বার হয় না, চারা দুর্বল হয়। যন্ত্রের সাহায্যে বীজ বপনের সুবিধা পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় নেই। যন্ত্রের দাম চড়া, ভাড়াও অনেক। অতএব, নিজের হাতই ভরসা। দীর্ঘ সময় জলে দাঁড়ানোর ফলে পায়ে-হাতে হাজা, চুলকানি, জ্বর-সর্দি-কাশি কৃষকের নিত্যসঙ্গী। শরীর খারাপ নিয়েও মাঠে যেতে বাধ্য হন। ধানের চারা বার হওয়ার কত দিন পরে সেটা স্থায়ী রোপণের উপযুক্ত হবে, সেটা জানতে হয়। অনভ্যস্ত লোক চারা রোপণ করতে গেলে গাছ দাঁড়াবে না, একটু পরই হেলে পড়বে। কীটনাশক প্রয়োগও কঠিন কাজ। জলে দাঁড়িয়ে মশা, কীটপতঙ্গের কামড় খেতে খেতে নাক-মুখ চাপা দিয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছড়াতে হয়। বহু কৃষকের মৃত্যু হয় কেউটের কামড়ে। অতঃপর ধান পাকলে মাঠে নেমে ধান কাটা, ঝাড়াই, পরিষ্কার করা, বস্তাবন্দি করা— প্রতিটি কাজই পরিশ্রমসাপেক্ষ। একই মেহনত আলু, আনাজ, গম-যব, ডাল, পাট, চা, আখ, তৈলবীজ, ফল চাষেও। তবেই ফসল ঘরে আসে।

কিন্তু এই প্রাণান্তকর পরিশ্রমের মূল্য কি কৃষকরা আজও পান? হ্যাঁ, এটা ঠিক, কৃষকদের অবস্থার আগের চেয়ে, অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল পশ্চিমবঙ্গে, তার চেয়ে উন্নতি হয়েছে। আগে দিনে এক বারই হয়তো গোটা পরিবারের আহার জুটত, কৃষক বধূ গিঁট দিয়ে কাপড় পরতেন, শিশুরা উলঙ্গ ঘুরে বেড়াত। খাল-বিলে জাল দিয়ে চুনো মাছ ধরতে পারলে তেলমশলা বিহীন শুধু ঝাল রান্না হত। তেল কেনার পয়সা কোথায়? তুলনায় বর্তমান কৃষকরা একটা চোখে দেখার মতো মজুরি এখন পান। তবে পশ্চিমবঙ্গের বহু কৃষক এখনও প্রায়, কিংবা সম্পূর্ণ রূপেই, ভূমিহীন।

আনাজপাতি চাষ যাঁরা করেন, তাঁরা যদি নিজেদের ফসল নিজেরাই বাজারে নিয়ে গিয়ে বসেন বিক্রির জন্য, তাতে লাভবান হন। কিন্তু সেটা একমাত্র সম্ভব ক্ষুদ্র চাষির পক্ষে। তবে তাঁদের জিনিসপত্রের পরিমাণও থাকে কম। কাজেই, দরিদ্রই থেকে যান তাঁরা। তুলনায় বড় চাষিকে সেই দালাল, ফড়ে, মহাজনের হাত ধরতেই হয়। এই সুযোগের অপেক্ষাতেই থাকেন ফড়েরা। নিতান্ত স্বল্পমূল্যে জিনিস খরিদ করে, চাষিকে ঠকিয়ে বস্তাবন্দি জিনিস নিয়ে চলেন মুনাফা অর্জনের পথে। তার পর, কোনও কোনও বছর ফলনের পরিমাণ অধিক হওয়ার পাইকারি বাজারে ফসলের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে যায়। ফলে চাষের খরচ ওঠে না। ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পেরে বহু চাষি আত্মহননের পথ বেছে নেন। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে রাজ্য ও কেন্দ্র— উভয় পক্ষকেই মানবিক এবং কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। চাষি একান্তই ঋণশোধে অপারগ হলে, তাঁকে রক্ষার দায়িত্ব প্রশাসনের।

সুগত ত্রিপাঠী, মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement