অলক রায়চৌধুরীর ‘বাংলা গানের প্রতিমা গড়তেন যে শিল্পীরা’ (৩-১০) শীর্ষক নিবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। মনে পড়ে, অসাধারণ কিছু গানের আরও কয়েক জন কারিগর ও সুরের জাদুকরের কথা। রেকর্ড সংখ্যক গানের রেকর্ডের অধিকারী কৃষ্ণচন্দ্র দে’র অনেক গানের গীতিকার ছিলেন শৈলেন রায়। তাঁর লেখা ‘নয়ন থাকিতে নয়নে এলে না’ এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। শচীনদেব বর্মণের গাওয়া ‘এই পথে আজ এসো প্রিয়া করো না আর ভুল’ বেরিয়ে এসেছিল শৈলেন রায়ের কলম থেকেই। আবার ‘আয় সখি আয় ঢেলে দি হোলি, পিচকারিতে রং ভরে’র গীতিকার হেমেন্দ্রকুমার রায়কে (ছবিতে বাঁ দিকে) আমরা ঠিক ভাবে চিনতে পারলাম কই! নিজস্ব ধারায় অননুকরণীয় এই কথাকারের ‘সই লো আমার গঙ্গাজল’ যৌবনের বনে মন হারিয়ে বসেছিল। আবার বহু বছর আকাশ বাতাস মাতিয়ে রেখেছিল দেবদাস ছবিতে কৃষ্ণচন্দ্র দে’র গাওয়া ‘ফিরে চল আপন ঘরে/ চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিছে’ গানটি। যেটি লিখে অবশ্য স্মরণীয় হয়ে আছেন সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়।
গীতিকার রামেন্দু দত্তকে আমরা ক’জন মনে রেখেছি! গানের জগতে শব্দচয়নের বিশেষত্বে ছিল তাঁর বিরাট জায়গা। তাঁর ‘আবেশ আমার যায় উড়ে কোন ফাল্গুনে, কোন ফুলবনে’ এক সময় বেশ নজর কেড়েছিল। সুর ও বাণীর আশ্চর্য সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল যাঁর অজস্র গান, সেই দিলীপ কুমার রায়কেও আজ আর সে ভাবে স্মরণ করি না। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের (ছবিতে ডান দিকে) ‘কাস্তেটারে জোরে দিও শান’ও আজ আর শোনা যায় না। অথচ, প্রতিবাদী বাংলা তেভাগা আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল এ গানে। মনে রাখিনি কৃষক আন্দোলনে গুলি খাওয়া (১৯৪৮) চন্দনপিড়ির অহল্যাকে নিয়ে গান বাঁধা বিনয় রায়কেও। বিস্মৃতপ্রায় গীতিকার ও সুরকারের তালিকা যত দীর্ঘ হবে, বাংলা গানের দীনতা তত প্রকট হবে।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
সম্প্রীতির পুজো
মুরারই রেল স্টেশনের পশ্চিমে প্রায় ৪ কিমি দূরের একটি প্রাচীন জনপদ বালিয়ারা। বর্তমানে বীরভূম জেলার মুরারই থানার অধীন ডুমুরগ্রাম মৌজায় অবস্থিত বালিয়ারা গ্রামটি মিঁয়াপাড়া, মালপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মোমিনপাড়া ও চাঁদপাড়া— এই পাঁচটি পাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে। একদা হিন্দুপ্রধান গ্রাম হলেও এখন একঘর ব্রাহ্মণ, একঘর গন্ধবণিক এবং কয়েকটি মাল পরিবার ছাড়া গ্রামের ৭৫ শতাংশ বাসিন্দা ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
২০০৬ সালের দুর্গা একাদশীর দিন বালিয়ারা গ্রামের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ইকবাল আহমেদ (তখন রামপুরহাট মহকুমা পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার) গ্রাম থেকেই নিত্যদিন অফিস যাতায়াত করতেন। রোজকার মতো সে দিনও তিনি সন্ধ্যার ট্রেনে মুরারইয়ে নেমে বাড়ি ফিরছেন। সেই সময় দেখেন তাঁর গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলির বেশ কিছু মানুষ তাঁদের পরিবার নিয়ে কাদা-মাটির পথ ধরে কষ্ট করে হেঁটে চলেছেন। ইকবাল সাহেব জানতে পারেন, তাঁরা দুর্গা প্রতিমা দর্শনের উদ্দেশ্যে মুরারই গিয়েছিলেন। এটা শুনে ইকবাল সাহেব ভাবতে থাকেন, যদি গ্রামেই দুর্গাপূজার আয়োজন করা যায়, তা হলে ওঁদের এতটা পথ যেতে হয় না।
পরের বছর দুর্গাপূজার কয়েক মাস পূর্বে ইকবাল আহমেদ গ্রামের কয়েক জন বাসিন্দার সঙ্গে দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে একটি বৈঠক করেন। স্থির হয় পুজোর জায়গার জন্য গ্রামের দত্ত পরিবারের মালিকানাধীন বেলপুকুর-সংলগ্ন নিমতলার একটি অংশ ব্যবহারের অনুমতির জন্য আবেদন জানানো হবে। সেই আবেদন জানানো হলে উক্ত পরিবারের অন্যতম সদস্য নিত্যরঞ্জন দত্ত আনন্দের সঙ্গে তাঁদের জায়গা ব্যবহারের অনুমতি দেন। তবে শর্ত দেন, অন্তত তিন বছর এই পূজা চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর শর্ত উদ্যোক্তারা মেনে নেন। কিন্তু এই পুজোর জন্য মুরারই থানায় দরবার করলে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক অনুমতি দিতে রাজি হন না। এই সময় ইকবাল আহমেদের সুহৃদ অজিত রায় তাঁকে মহকুমা শাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। ইকবাল সাহেব পরের দিনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এক জন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পরধর্মের প্রতি এহেন শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিক উদ্যোগে প্রীত হয়ে মহকুমা শাসক তাঁকে পূজা শুরু করার মৌখিক সম্মতি দেন এবং বলেন আইনগত দিক দিয়ে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা তিনি দেখবেন।
অতঃপর হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ তাঁদের সামর্থ্যমতো চাঁদা দিয়ে পুজো শুরু করেন। বালিয়ারা সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির প্রথম সভাপতি হন ইকবাল আহমেদ। ২০০৮ সালেও তিনিই সভাপতি থাকেন। তবে ওই বছরই তিনি নতুন একটি কমিটি গড়ে দেন। উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক বছরই নতুন কমিটি তৈরি হয় এবং নবপ্রজন্মের যুবকদের বেশি বেশি করে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৮ সাল থেকে গ্রামের প্রত্যেকটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে ধান ওঠার সময় এক মন করে ধান চাঁদা হিসাবে নেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং সেই সময় মুরারই পোস্ট অফিসে পূজা কমিটির নামে একটা অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, যেখানে বিক্রিত ধানের টাকা জমা রাখা হত। কিন্তু বর্তমানে সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন আর ধানও নেওয়া হয় না। প্রতিটি হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে বছরে ১০০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এ ছাড়াও ইকবাল সাহেব ও গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ও পূজার খরচের একটা অংশ জোগান দেন। প্রতিমা বিসর্জনের সময় গ্রাম প্রদক্ষিণ ও বেলপুকুরে প্রতিমা নিরঞ্জনের প্রক্রিয়া যাতে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য গ্রামের সকলে বিসর্জন পর্বে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। ২০১৮ সালে গ্রামের উভয় সম্প্রদায়ের অর্থসাহায্যে পূজার স্থানটিতে একটি পাকা মন্দির নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের সৌন্দর্যায়নে দত্ত পরিবারের দান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
বালিয়ারাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা পীঠস্থান বলা যেতে পারে। গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পরবে এবং পরবকে কেন্দ্র করে আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই সমান ভাবে অংশ নেন।
অনির্বাণজ্যোতি সিংহ
মুরারই, বীরভূম
শীতের কাঁথা
শীতের হাত থেকে মায়েরা নবজাতকদের রক্ষা করেন হাতে তৈরি শীতের কাঁথা জড়িয়ে। নরম কাঁথায় শুয়ে নবজাতক পায় মায়ের কোলের ওম। কাঁথা কথাটা এসেছে সংস্কৃত শব্দে ‘কন্হা’ থেকে, যার অর্থ হল জীর্ণবস্ত্র দিয়ে তৈরি শীতের পোশাক। অনেক সময় আমাদের ফেলে দেওয়া পুরনো, ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে নতুন শাড়ি সহযোগে তৈরি হয় এই কাঁথা। বিভিন্ন নকশা এঁকে এই কাঁথাকে বাহারি নকশি কাঁথায় পরিণত করা হয়।
কাঁথায় নানান সেলাই ও সুতো বদল করে কাঁথার নামকরণ করা হয় সুজনি কাঁথা, কদমফুল কাঁথা, গোলকধাঁধা কাঁথা, পাঙ্খা কাঁথা ইত্যাদি। নকশি কাঁথা মুসলিম সমাজ ও গ্রামবাংলার জনপ্রিয় লোকশিল্প। মুসলিম সমাজে কাঁথা ব্যবহারের খুব চল আছে। অতিথি বাড়িতে এলে বিছানায় নানান ধরনের কাঁথা বিছিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। বিয়েতে কাঁথা যৌতুক হিসাবে উপহার দেওয়া হয়। গ্রামবাংলার অনেক মহিলা ও মুসলমান মহিলা কাঁথা তৈরি করাকে পেশা হিসাবে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পে পরিণত করেছেন। সংসারের কাজ সেরে মহিলারা শীতের দুপুরে ছাদে কিংবা বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে কাঁথা তৈরির কাজ চালিয়ে যান।
একটি ভাল নকশি কাঁথা তৈরি করতে বেশ সময় ও শ্রম লাগে। সে তুলনায় পারিশ্রমিক তেমন ভাল জোটে না বলে আজ কাঁথাশিল্প মৃতপ্রায়। উপরন্তু, শিশুদের কাঁথার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে ন্যাপি। এ ছাড়া বাহারি হালকা কম্বল, লেপ কাঁথাকে দেশছাড়া করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আজ তাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প-হস্তশিল্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি। তবুও নকশি কাঁথা আমাদের বড় অহঙ্কার। নানা দেশে তা সমাদৃত। শৌখিন পণ্য হিসাবে বিদেশে রফতানিও হচ্ছে।
প্রদীপ কুমার দাস
শ্রীরামপুর, হুগলি