টেলিভিশনের পর্দায় তালিবানি নৃশংসতা দেখতে দেখতে আতঙ্ক হয়। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই বর্বরতা মেনে নেওয়া কঠিন। এই তালিবানকেই এক সময় সোভিয়েট ইউনিয়নের আধিপত্য খর্ব করতে আমেরিকা ব্যবহার করেছে, অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ দিয়ে দিনের পর দিন সাহায্য করেছে। আজ তালিবানি অত্যাচার দেখেও চিনের মতো কমিউনিস্ট দেশ চুপচাপ বসে আছে। তারা চায়, যে ভাবেই হোক আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার আধিপত্যবাদের অবসান। তা হলে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ন্যায়নীতির প্রশ্নটা বড় নয়, মূল বিষয় হল ক্ষমতা পাওয়া। সমাজমাধ্যমে কারও কারও মধ্যে আবার তালিবানি বর্বরতা দেখে পুরো একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই দোষ দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদ, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, খারাপ। এক জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের উদ্ভব হলে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত হয়। সেই রকম, আফগানিস্তানে নারীদের যে ভাবে দমন করা হচ্ছে, সেটা দেখে অন্যান্য ধর্মের মাতব্বররা বলতে শুরু করেছে, আমরা এর থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা দিই নারীদের। যেন স্বাধীনতার প্রশ্নে পুরুষ ও নারীদের অবস্থান দাতা ও গ্রহীতার। পুরুষ যতটা দেয়, নারী ততটাই স্বাধীনতা অর্জন করবে, এটাই যেন নিয়ম। এই ধারণা যত দিন থেকে যাবে, তত দিন নারীকে ‘স্বাধীন’ বলা যাবে না। ‘পুরুষ স্বাধীনতা’ কথাটা শুনেছে কেউ? কারণ, পুরুষরা জন্মগত ভাবেই স্বাধীন। আজ তালিবানরা নারীদের ব্যাপারে যে নরম নীতির কথা বলছে, এটা পুরোপুরিই ভেক। মৌলবাদের কখনও আধুনিক-প্রাচীন হয় না। তাদের ক্ষেত্রে একটা কথাই প্রাসঙ্গিক, সেটা হল ‘বিপজ্জনক’। তালিবানরা আরও অধিক মাত্রায় নারীদের অত্যাচারের পন্থা বার করবে।
তবে এক জায়গায় মৌলবাদের উত্থান হলে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার জাতীয় সরকার চুপচাপ বসে থাকতে পারে না, কারণ মৌলবাদী কার্যকলাপের ঢেউ শান্তিপূর্ণ দেশেও আছড়ে পড়ে। প্রতিবাদের ব্যাপারে এখন দেখছি মানুষ খুব হিসেবি। ইজ়রায়েল যখন গাজ়া ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে মেরেছে, তখন যাঁরা প্রতিবাদ করেন, তাঁরাও এখন চুপ করে বসে রয়েছেন। এঁরা আসলে অন্যায়কেই প্রশ্রয় দেন।
সুভাশীষ দত্ত
চাকদহ, নদিয়া
আফগান শরণার্থী
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন এবং তৎপরবর্তী অস্থির পরিস্থিতি এ দেশের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (সিএএ)বাতিলের দাবিকে আরও জোরদার করল। তালিবান শাসনের ধর্মীয় উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতার কারণে বেশ কিছু মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে আসবেন, এটা নিশ্চিত। আফগানিস্তানের শিখ সম্প্রদায়ের প্রধান ইতিমধ্যেই অভিযোগ করেছেন, তালিবানরা বন্দুক দেখিয়ে গুরুদ্বার থেকে পবিত্র নিশান সাহিব পতাকা নামিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, অত্যাচারিত হচ্ছেন অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও। কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মানবিক কারণে আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের ‘ফাস্ট ট্র্যাক’-এ নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি তুলেছে। ভারত সরকারও ইতিমধ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য ই-ভিসা দেওয়া শুরু করেছে। এই মানুষগুলোর মধ্যে হিন্দু যেমন থাকবেন, তেমন থাকবেন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষও।
এঁদের একাংশ যদি ভবিষ্যতে এ দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে চান, সিএএ-র কারণেই সেটা সম্ভব হবে না। ওই আইনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অমুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এ দেশে এলে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তাঁরা চাইলে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে পারবেন। কিন্তু সেটা কেবল ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যাঁরা ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’ বা ‘পাসপোর্ট অ্যাক্ট’-এ ছাড় পেয়েছেন, তাঁরাও ওই ২০১৪-র মধ্যে এসে থাকলে তবেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের যোগ্য হবেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যে ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত বা অত্যাচারিত হয়ে আসছেন, সেই প্রমাণ তাঁদের দিতে হবে। কাজেই আজ ২০২১ সালে আফগানিস্তানের এই গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে যাঁরা আশ্রয়প্রার্থী হয়ে ভারতে ঢুকবেন, তাঁদের আবেদন নাগরিকত্বের জন্য বিবেচিত হতেই পারবে না।
সিএএ-র বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলনের মূল কারণ ছিল, আইনটি মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি, তাই আইনটি সংবিধান-বিরোধী। মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। এই আইন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি, এই ধর্মের প্রতিবেশী দেশের মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বললেও মুসলমানদের বিষয়ে নীরব থেকেছে। অথচ, মুসলমানদের মধ্যে এক ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে অন্য গোষ্ঠীর নিপীড়নের ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। শিয়া-সুন্নি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও তার জন্য দেশত্যাগ নতুন কিছু নয়। তা সত্ত্বেও প্রতিবেশী পাকিস্তানের অত্যাচারিত আহমদিয়ারা এ দেশে আশ্রয় নিয়ে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। একই সমস্যা তালিবানদের ভয় বা অত্যাচারে ভারতে আসা মুসলমানদেরও। একই সঙ্গে তিন জন আফগান নাগরিক যদি ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসেন, এবং তাঁদের মধ্যে যদি এক জন হিন্দু, এক জন শিখ এবং এক জন মুসলমান হন, এবং তাঁরা যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তা হলে হিন্দু ও শিখ ব্যক্তি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারলেও, মুসলমান ভদ্রলোক পারবেন না। ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে এই বৈষম্য ভারতীয় সংবিধানের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বৈষম্যকে বৈধতা দিয়ে কোনও আইন হলে সেই আইন সংবিধানসম্মত হবে, হতে পারে না। সে জন্যেই সুপ্রিম কোর্টে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রায় দেড়শো মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
ভারতের কোনও উদ্বাস্তু নীতি নেই। আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু কনভেনশনেও ভারত স্বাক্ষর করেনি। ফলে, আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থী মানুষের মনে কিছুটা ভরসা জাগিয়ে অবিলম্বে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ বাতিল করুক ভারত সরকার। বাতিল করুক ২০১৪ সালের সীমারেখা। শুধু ধর্মীয় নিপীড়ন নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থকরী জীবিকা ও মানসিক শান্তির খোঁজে আসা ভিন্দেশি মানুষদেরও নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। আতিথ্য সময়ের সঙ্গে নাগরিকত্বে পরিণত হোক। সমান অধিকার নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বাঁচুক সব মানুষ।
রঞ্জিত শূর
কলকাতা-৭৫
কাবুলের মুক্তি
বাঙালির সঙ্গে কাবুলের মানুষের পরিচয় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ছোট গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’, এবং ওই একই নামে তপন সিংহ-কৃত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পটি পড়া না থাকলেও ছবি বিশ্বাস-এর অভিনয়ের মাধ্যমে ‘কাবুলিওয়ালা’র জন্য আবেগ, হাসি-কান্নার অশ্রুসজল কাহিনি বাঙালি-মননে অম্লান। সেই কাবুল, আফগানিস্তান এখন খবরের শিরোনামে। তালিবানদের হাত থেকে রেহাই পেতে বিমানে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টার ছবি ভাইরাল হয়েছে। ‘আফগান আকাশে বিপদের আশঙ্কা’ (১৭-৮) প্রতিবেদনটি থেকে জানলাম, আফগানিস্তানের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আকাশ-এলাকায় নিষেধ না থাকলেও জরুরি অবতরণে পাওয়া যাবে না এটিসি পরিষেবা। শক্তিধর দেশগুলি-সহ ভারত এই পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ করে, সে দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ যেন তালিবানি অপশাসনের হাত থেকে রেহাই পান, সেই প্রার্থনা করি।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫