শ্রীমন্তী রায় তাঁর ‘আহা রে, বেচারা পুরুষ’ (২৮-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, পুরুষালি ও মেয়েলি ছাঁদগুলো ভাঙছে। যার পিছনে বর্তমানের নারীবাদী রাজনীতির প্রভাব তো আছেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে বাজারের প্রভাব। কেননা আজকের রোজগেরে নারীরা বাজারের প্রত্যক্ষ ক্রেতা বলে বাজারের বিজ্ঞাপন এখন আর শুধু পুরুষের সঙ্গে কথা বলে না, মেয়েদের সঙ্গেও বলে। এখানে কারসাজিটা প্রবন্ধকার চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন— কারও বর তাকে সকালে উঠে কফি করে খাওয়াচ্ছে, কোনও ছেলে তার মায়ের জন্য বা স্ত্রীর জন্য রান্না করছে, কারও প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্মদিনে নিজে হাতে কেক বানাচ্ছে, বা পিরিয়ড চলাকালীন এগিয়ে দিচ্ছে গরম জল, ওষুধ। চূড়ান্ত স্বাভাবিক এ সব, তবু এ সব কাজ নিতান্তই নারীর ছিল, পুরুষ সেগুলো করছে। পুরুষের মহত্ত্বই শেষ পর্যন্ত ঘোষিত হচ্ছে।
তবু ভাল, ছকটা তো ভাঙছে। হয়তো এ ভাবেই পুরুষালি-মেয়েলি ছকটা ভাঙতে হবে। পুরুষ আচমকা পুরুষত্বের অসারতা বুঝে যাবে— এমনটা হওয়ার কথা নয়। মাতৃমহিমার কৌশলী প্রচারে কার্যত পুরুষরাই মহিমান্বিত হয়। নারীদের প্রতি সমানুভূতিশীল কিছু পুরুষ এটা না চাইলেও পিতৃতান্ত্রিকতায় বশীভূত হওয়ার সুবাদে সবাই এই কৌশল ধরতে পারে না। মায়েরা কম খেয়ে, প্রয়োজনে না খেয়ে সন্তানকে বড় করেন। জীবজগতে এটা খুবই সাধারণ কথা, প্রকৃতির অভিপ্রায়। কিন্তু মানুষের সমাজে সাধারণ কথা নয়। সেখানে বাবাদেরও সমান অংশীদার হওয়ার কথা। অথচ, বাবারা সমান অংশীদার না হয়ে মায়েদের মহিমা প্রচার করতেই ব্যস্ত। এই প্রচারে কি আদৌ মায়েদের পেট ভরে? প্রশ্ন উঠবে, মায়েদের এই মহিমা প্রচার তো তাঁদের স্বীকৃতি দান, যাতে পরবর্তী কালে সন্তানেরা মায়েদের উপযুক্ত যত্ন নেয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয় কি? বিশেষত অর্থের জোরটুকুও না থাকলে দুরবস্থার শেষ থাকে না।
হাতে পড়ে থাকে মাতৃত্বের অসহায় অহঙ্কার।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
আত্মঘাতী
দিল্লিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে সিটিজ়েনশিপ সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কারাগারে প্রায় চার মাস বন্দি দুলাল কান্তি শীল। পশ্চিমবঙ্গেও কি তৈরি হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস থেকে বামপন্থী সব ক’টি দলের তাবড় নেতারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, এ দেশে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা তো ভারতীয়। তাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, জমির দলিল আছে। তাঁরা আবার নতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করবেন কেন? এ দিকে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম থানার গুসকরা পুরসভার এক দম্পতিকে গত জানুয়ারি মাস থেকে গ্রেফতার করে রেখেছে। দুলাল কান্তি শীল ও স্বপ্না শীল নামে এই প্রৌঢ় দম্পতি অবৈধ বাংলাদেশি অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে আছেন বর্ধমানের জেলা সংশোধনাগারে।
অভিযোগকারী আধিকারিক পূর্ব বর্ধমানের জেলা গোয়েন্দা দফতরের সাব-ইনস্পেকটর জ়ুলফিকার আলি। গত ৩১ জানুয়ারির তাঁর টাইপ করা অভিযোগে তিনি লিখেছেন, স্থানীয় ভাবে তদন্ত করে দেখা গিয়েছে যে, এই দম্পতি ন’বছর আগে বাংলাদেশের কক্সবাজারের বড় মহেশখালি উপজেলার হিন্দুপাড়া থেকে ভারতে এসেছেন। এখানে ক্ষৌরকার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। অভিযোগে পুলিশ স্বীকার করেছে যে, তাঁদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, এমনকি ভারতীয় পাসপোর্টও আছে। মজার ব্যাপার হল, অন্য সব পরিচয়পত্রে না থাকলেও পাসপোর্টে ধারক ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিক বলে উল্লেখ করা থাকে। পাসপোর্ট দেওয়ার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন অবশ্যই হয়েছে। এ বার এই দম্পতিকে কী করা হবে? ‘ডিটেক্ট’ করে ‘ডিটেনশন’ পর্যন্ত তো হয়ে গিয়েছে, এ বার শুধু ‘ডিপোর্ট’ করাটাই বাকি।
যদি পুলিশ জানুয়ারি মাসে এঁদের গ্রেফতার না করত, আর রাজ্য জুড়ে একটি চক্র মানুষকে বিভ্রান্ত না করত, তা হলে শীল দম্পতি তাঁদের কাগজপত্র নিয়ে সিএএ-তে আবেদন করতেই পারতেন। কে বলতে পারে, আজ হয়তো তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শংসাপত্রও পেয়ে যেতেন।
সকলেই জানেন যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত হিন্দু অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আসছেন। তাঁরা মায়ের সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মা’কে গণধর্ষিতা হতে দেখেছেন। ২০২১ সালের দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে বাংলাদেশের হিন্দু গণহত্যার স্মৃতি তো এখনও দগদগে হয়ে আছে। দুলাল কান্তি শীলের মতো পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা দু’-দু’টি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য রক্ত দিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুরের মতো অকাতরে প্রাণ বলিদান করেছেন পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত, নিহত, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে পূর্ববঙ্গের হিন্দুসমাজ। কে বলতে পারে, দুলাল কান্তি শীলের পূর্বপুরুষদের কেউ এমন রক্ত দিয়েছেন কি না। তাঁদের বলিদানে স্বাধীন হওয়া দু’টি দেশের টানাপড়েনে জেলের ঘানি টানছেন এই গরিব অসহায় দম্পতি।
পুলিশের করা অভিযোগপত্রে লেখা আছে, দুলাল কান্তি শীল অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ‘ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস’ কিন্তু অন্য কথা বলে। ইউএনএইচসিআর-এর ১৯৫১ সালের জেনিভা কনভেনশন আর ১৯৬৭ সালের উরুগুয়ে প্রোটোকল অনুসারে, যিনি ধর্মীয়, ভাষাগত ইত্যাদি কারণে ভীত হয়ে অন্য দেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এবং ভয়ে প্রথম দেশে ফিরে যেতে চাইছেন না, তিনি উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, কিন্তু অনুপ্রবেশকারী নন। আন্তর্জাতিক আইন থেকে বর্তমান দেশের আইন— সব কিছুই পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত হিন্দুর পক্ষে। কিন্তু দুলালবাবুর বিধি বাম।
এই ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়। মানা ক্যাম্প থেকে মরিচঝাঁপি— সর্বত্রই এই অনাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন পূর্ববঙ্গের তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। কে বা কারা যেন চায় না যে এঁরা সত্যি কথা বলে সম্মানজনক নাগরিকত্ব পান। তাঁদের পরিকল্পনাই হল, এই মানুষগুলি যেন রাজনৈতিক দলের পদলেহন করে বা পুলিশকে সন্তুষ্ট করে ভারতে বসবাস করতে বাধ্য হন। যাঁরা কোনও অপরাধই করেননি, তাঁরা শাস্তি পেয়ে যাবেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। রাজনৈতিক কারণে আজ দেশের বিরোধী দলগুলি দুলাল শীলদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।
ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেস হয়েছিল ২০১২ সালের ৪-৯ এপ্রিল কোঝিকোড় শহরে। সেই সম্মেলনে বাঙালি উদ্বাস্তুদের নিয়ে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল। “মূলত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের একটি বড় সংখ্যার তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষ (বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে) ভারতের বিভিন্ন অংশে থাকতে বাধ্য হয়েছেন।” স্পষ্ট ভাবেই তফসিলি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের জন্যই তৈরি হয়েছিল সিপিআইএম-এর সে দিনের দাবি সনদ। কিন্তু আজ দুলাল কান্তি শীলের পাশে এঁরা কেউ নেই।
পশ্চিমবঙ্গে নিকারাগুয়া থেকে গাজ়া ভূখণ্ড— সকলের মানবাধিকারের প্রশ্নে সরব হওয়া যায়। কিন্তু দুলাল কান্তি শীলের মতো লক্ষ লক্ষ পূর্ববঙ্গের হিন্দুর কোনও মানবাধিকার নেই।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। কত বড় ক্রান্তদর্শী মানুষ ছিলেন।
জিষ্ণু বসু, কলকাতা-৬৪
বন্ধ পথ
লোকসভা ভোটের মুখে প্রায়ই শহরের গুরুত্বপূর্ণ পথ আটকে জনসভা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে এই কারণে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের অনেকটা অংশ বন্ধ থাকে। অন্য উপায় কি ভাবা যায় না?
তৃপ্তি মিত্র, কলকাতা-৩৩