Evolution Theory

সম্পাদক সমীপেষু: অপরিহার্য ডারউইন

আজ শিক্ষার নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা মানুষ নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মানসিকতার অধিকারী না হলে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদে মুখর হতে হবে সাধারণ শিক্ষিত মানুষকেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৩ ০৫:৪৩
Share:

বিবর্তনবাদ আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার একটি প্রধান স্তম্ভ। ফাইল চিত্র।

এনসিইআরটি নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে জৈব বিবর্তন তত্ত্ব ও ডারউইনবাদ আর রাখবে না, এটা বড় আশ্চর্য সংবাদ (ডারউইন বাদ কেন, সরব বিজ্ঞানী মহল, ২৩-৪)। বিজ্ঞান তথা জীববিজ্ঞানের বইতে অভিব্যক্তি তত্ত্ব রাখার দরকার নেই, এমন অদ্ভুত কথা আধুনিক জগতে যাঁরা ভাবতে পারেন, তাঁরা শিক্ষার কোন আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চান? বিবর্তনবাদ আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার একটি প্রধান স্তম্ভ। এই তত্ত্ব নিখিল জগতের এক বৃহৎ সত্যকে ধারণ করছে। এটা পাঠ্যবিষয় থেকে বাদ গেলে, শিক্ষার্থীরা কতটুকু বিজ্ঞান শিখবে? কেন্দ্রীয় বোর্ডের ছাত্র-ছাত্রীরা ও অন্য পড়ুয়ারা তা হলে মাধ্যমিক স্তরে অসম্পূর্ণ ও অনাধুনিক শিক্ষা লাভ করে জ্ঞানে ও মেধায় দুর্বল হয়েই থাকবে। সেটা কি কোনও রাষ্ট্রের কাম্য হতে পারে? জনসমাজে কুসংস্কার নির্মূল করে বৈজ্ঞানিক চেতনা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোই সব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। সে কথা ভুলে না গেলে ডারউইনতত্ত্ব কেউ বিজ্ঞান বই থেকে বর্জন করার কথা এই যুগে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারে না। অতীতে কিছু প্রাচীনপন্থী গোঁড়া মানুষজন বিবর্তনবাদের নিন্দা ও বিরোধিতা করতেন। আজ শিক্ষার নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা মানুষ নিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মানসিকতার অধিকারী না হলে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদে মুখর হতে হবে সাধারণ শিক্ষিত মানুষকেই।

Advertisement

রাষ্ট্রীয় স্তরে শিক্ষানীতিতে আজকাল ‘ভারতীয় জ্ঞান-তন্ত্র’ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতের জ্ঞানসাধনার প্রাচীন ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক। কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এটা হতে পারে না যে, বিবর্তনবাদ বিজ্ঞান শিক্ষায় এ দেশে অপ্রয়োজনীয় বা গৌণ বলে গণ্য হবে। বিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে খামখেয়ালিপনা চলতে পারে না। এবং শিক্ষা বিষয়েও যুক্তিরহিত কার্যকলাপ মেনে নেওয়া যায় না। আশা রাখব যে, কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ভুল পদক্ষেপটি সংশোধন করে নেবে।

শতদল ভট্টাচার্য, কলকাতা-৯১

Advertisement

আপত্তির কারণ

সিলেবাসের বোঝা কমানোর নামে কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদ (সিবিএসই) দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি থেকে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব বাদ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে নিন্দা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানী মহল এর প্রতিবাদে খোলা চিঠি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বিজ্ঞানের এই মৌলিক আবিষ্কারের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে এবং এই কাজ তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-পদ্ধতি গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হবে। কারণ, জীবজগৎ যে নিয়ত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে, এবং বিবর্তন যে একটি নিয়ম নির্ধারিত প্রক্রিয়া, কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা যে এখানে নেই, এই চিন্তা ডারউইনের সময় থেকে যুক্তিবাদী চিন্তার অঙ্গ।

ডারউইন ছিলেন আপাদমস্তক বিজ্ঞানী। ১৮৩১-১৮৩৬ সালে বিগল জাহাজে ভ্রমণের সময় তিনি বিশাল তথ্যভান্ডার সংগ্রহ করেন। তার পরও তথ্য সংগ্রহ চালিয়েছেন। ১৮৪৪ সালে তিনি বিবর্তন সংক্রান্ত ধারণার খসড়া প্রস্তুত করেন। একশো ভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরে ১৮৫৯ সালে অন দি অরিজিন অব স্পিসিস বইটি প্রকাশ করেন।

মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী সত্যপাল সিংহের একটি বক্তব্য। তিনি বলেন, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভুল’। কারণ, আমাদের পূর্বপুরুষরা কোথাও উল্লেখ করেননি যে, তাঁরা কখনও কোনও বাঁদরকে মানুষ হতে দেখেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের লেখা কোনও বই বা গল্পগাথায় এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ নেই। তাই বিজ্ঞানের বই থেকে এই তত্ত্বকে বাদ দিতে হবে। সে দিন অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি (দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, নিউ দিল্লি; ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, বেঙ্গালুরু; এবং দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, প্রয়াগরাজ) এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল— মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিবর্তনবাদের তত্ত্ব, যাতে ডারউইনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তা দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। বিবর্তনের তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। এটি এমন একটি তত্ত্ব, যার ভিত্তিতে এমন বহু অনুমান করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো পরবর্তী কালে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

মন্ত্রীর মন্তব্যকে সে দিন অনেকে ব্যক্তিগত অজ্ঞতার বিষয় বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা যে তা ছিল না, মন্ত্রী যে কেন্দ্রে শাসন পরিচালনায় নিযুক্ত একটি গোষ্ঠীর মতকেই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন, তা সিবিএসই’র ঘোষণার মধ্য দিয়ে এখন প্রকাশ পেল।

কিন্তু কেন এই পদক্ষেপ? এর মূল কারণ হল, ডারউইনের বিবর্তনবাদ সৃষ্টির পিছনে কোনও এক অজানা-অচেনা, অথচ শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ভূমিকাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্ব প্রমাণ করেছে যে, এক প্রজাতি থেকে আর এক প্রজাতির সৃষ্টি একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়াই প্রাকৃতিক নিয়মে তা ঘটে। ফলে ধর্মতাত্ত্বিকরা ভীষণ বিপদে পড়ে গেলেন। কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের পরে ধর্মতাত্ত্বিকদের আশ্রয় ছিল জীবজগৎ, বিশেষ করে মানুষের সৃষ্টি। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়— এই বিশ্বাসই ছিল তাঁদের শক্তির শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ জীবজগৎ সৃষ্টির পিছনে প্রাকৃতিক নিয়মের কথা প্রমাণ করে দেওয়ায় তা ধর্মতাত্ত্বিকদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। তাই ডারউইনের জীবদ্দশাতেই তীব্র আক্রমণ শুরু হয়েছিল, এখনও যা অব্যাহত আছে।

আজ এটা স্পষ্ট যে, মন্ত্রীর সুপারিশ এবং সিবিএসই-র সিদ্ধান্ত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ডারউইনের জীবদ্দশায় যে ধর্মতন্ত্র বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিয়েছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরাই বিবর্তনবাদকে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পাঠ্যক্রম সঙ্কোচনের কথাটা নেহাতই অজুহাতমাত্র। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী।

সুব্রত গৌড়ী, কলকাতা-১২

অপবিজ্ঞান

নবম দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে ডারউইন তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন ১৮০০-রও বেশি বিজ্ঞানী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানকর্মীরা। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বোঝার এক অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিবাদী পথ। নাগপুরের কর্তাব্যক্তিরা বহু দিন ধরেই তা মুছে দিতে চান। ঠিক যে ভাবে চেয়ে এসেছেন ভারতের ইতিহাস থেকে ইসলামি শাসন মুছে দিতে। বিবর্তনবাদ না শিখে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে এক জন শিক্ষার্থী যে প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হবে, সে বিষয়ে শাসক দলের আদৌ কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা চায় সনাতন হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় লালিত এক ছাঁচে ঢালা নাগরিক।

বিবর্তন তত্ত্ব যুগে যুগে সমালোচিত। নিজের জীবদ্দশায় ডারউইনকে অনেক প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়েছিল। স্কুলে ডারউইনবাদ পড়ানোর অপরাধে এক শতাব্দী আগে আমেরিকায় বিজ্ঞান শিক্ষক টমাস স্কোপসকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। দীর্ঘ দিন পাঠ্যসূচির বাইরে রাখা হয়েছিল বিবর্তনবাদকে। নোবেলজয়ী জিনতত্ত্ববিদ হারম্যান মুলার আমেরিকায় তার সমালোচনা করার পর, পাঠ্যসূচিতে ফিরে এসেছিল ডারউইনবাদ।

মানুষ ও বানরের পূর্বপুরুষ যে একই— এর সপক্ষে বহু প্রমাণ আছে, যা অস্বীকার করার চেষ্টা গা-জোয়ারি মনোভাব। তাই, বিজ্ঞানকে হটিয়ে সুকৌশলে অপবিজ্ঞানের রাষ্ট্রীয় আবাহনের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল নাগরিকের আজ সরব হওয়ার সময়।

সরিৎশেখর দাস, কলকাতা-১২২

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement