প্রতীকী ছবি।
‘সমাজমাধ্যমের সাগরতীরে’ (৬-৬) শীর্ষক নিবন্ধে মৈত্রীশ ঘটক প্রতীকী সৈকতে জনমিলন দেখালেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর উল্লিখিত ‘সুযোগের সাম্য’-এর পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে থাকে সুযোগের অপব্যবহারও। ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকেই সমাজমাধ্যমের প্রতি প্রাথমিক মুগ্ধতা থেকে সরে এসেছি। কাজেই, সাগরতীরে কেবলই যে মিলন হবে এমনটা নয়; সেখানে প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেটও ছড়ানো থাকবে।
প্রথাগত মাধ্যমে লেখা, চিঠির দীর্ঘ উত্তর-প্রত্যুত্তর নিয়ে লেখক কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন। কিন্তু তা কি সব ক্ষেত্রে সত্য? সম্পাদিত কলামে নিজের লেখা প্রকাশ করার জন্য যে অপেক্ষা, নিজেকে বার বার শ্রমে নিযুক্ত করা, তাতে কি ধৈর্য হারান সকলেই? যাঁদের মূল জীবিকাই লেখালিখি, তাঁরা প্রথাগত, মূলস্রোতের পত্রপত্রিকার বিকল্প অনলাইন বা অফলাইন প্রতিষ্ঠানে লিখছেন। কিন্তু সম্পাদনার পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া এড়াতে যাঁরা অসম্পাদিত লেখাই চালাতে চাইছেন সমাজমাধ্যমে, তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এখানেই সমাজমাধ্যমের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বহু ক্ষেত্রে মতের অমিল হলে সম্পাদিত গঠনমূলক সমালোচনার বদলে উঠে আসছে অসম্পাদিত গালিগালাজ। কাজেই, এক দিকে যেমন মানুষকে দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার বা অতিমারির সময় গৃহবন্দি অবস্থাতেও বন্ধুসঙ্গের সুযোগ করে দিয়েছে সমাজমাধ্যম, অন্য দিকে তা কিন্তু বিপদও ডেকে আনতে পারে।
শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
কলকাতা-৩১
বিকল্প কই?
‘সমাজমাধ্যমের সাগরতীরে’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। অস্বীকার করার জায়গা নেই, সমাজমাধ্যমের দৌলতে মধ্যবিত্ত খানিকটা প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হয়েছে। এখন এই বৈদ্যুতিন মাধ্যম অতি সাধারণ মানুষও অনায়াসে ব্যবহার করতে পারছেন, এটি আত্মবিশ্বাসের জায়গাও বটে। ব্যাঙ্ক, টেলিফোন, এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থার নিজস্ব সমাজমাধ্যমে অভিযোগ জানালে দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। প্রয়োজনে নেতা-মন্ত্রীদের সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে আর একটু সাহসী পদক্ষেপ করা যাচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের সঙ্গে অনায়াসে যোগাযোগ রাখা যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ববিধি সমাজমাধ্যমকে অপরিহার্য করে তুলেছে।
এ দেশে আত্মসমালোচনার কোনও অভ্যাস মানুষের মধ্যে নেই, তাই অন্যের সমালোচনা মেনে নেওয়ার মানসিকতাও আমাদের তৈরি হয়নি। নেতা-মন্ত্রীরাও ব্যতিক্রম নন। তাই তাঁরা সমাজমাধ্যমে সমালোচনা মাথা পেতে মেনে নেবেন, আশা করা যায় না। অথচ, তাঁরাই এই মাধ্যমটিকে নিজেদের ঢাক পেটানোর আদর্শ জায়গা করে নিয়েছেন এবং অবশ্যই সমালোচকদেরও এক হাত নেওয়ার কাজটি সারছেন সুনিপুণ ভাবে। তা সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্ন সমাজমাধ্যমের উপর হুলিয়া জারি করার পরিকল্পনা করছেন, সমাজমাধ্যম এবং তার ব্যবহারকারীদের মধ্যে ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’-এ নাক গলাতে চাইছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার হঠাৎ জনসাধারণের স্বাধীন মতামত জানানোর জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না, যত ক্ষণ না তারা সমতুল্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্য একটি মাধ্যম জনগণের হাতে তুলে দিতে পারছে। দুর্ভাগ্যবশত, কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাপগুলি জনমানসে তেমন কোনও প্রভাব ফেলেনি। সুতরাং, নেতা-মন্ত্রী বা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গিরও বিশেষ পরিবর্তন প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে এই সমাজমাধ্যমগুলোর কাজে নাক গলানো এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ দেবে না। কৃতকর্মের জন্যে বিশ্ব জুড়ে সরকারের সমালোচনা যখন এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই, তখন দেশের অভ্যন্তরে সমালোচনা সহ্য করার সহনশীলতা সরকার দেখাতে পারবে না কেন?
পিনাকী রুদ্র
কলকাতা-১২৪
সুযোগের সমতা
সমাজমাধ্যম বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে এক ধরনের মিশ্র মাধ্যম। শুধুমাত্র সংগঠিত বৃহৎ বাণিজ্যিক মিডিয়া নয়, এক জন সাধারণ মানুষও এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ‘মিডিয়া’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেতে পারেন। নীরব দর্শক থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠার এই ‘সুযোগের সমতা’ই সমাজমাধ্যমকে দিয়েছে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা। বিভিন্ন তথ্য ও তার নানামুখী বিশ্লেষণ, নানা ধরনের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি সমাজমাধ্যমের দর্পণে প্রতিফলিত হয়। যে কেউ চাইলে বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য যাচাই করে নিজের মতামত গড়ে তুলতে পারেন। এ ভাবেই সজাগ ও সন্ধানী মানুষের হাত ধরে আপাত-বিরোধী তথ্যের মধ্য থেকে প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর রাস্তা খুলে যেতে পারে। একই বিষয় নিয়ে একাধিক স্বরের সহজ সহাবস্থান এখানে সম্ভব।
এক জন মানুষ কোন মতবাদটির প্রতি আকৃষ্ট হবেন, তা নির্ধারিত হয় তাঁর আর্থ-সামাজিক অবস্থান, তাঁর চিন্তা-চেতনার স্তর ইত্যাদির দ্বারা। তাই সমাজমাধ্যম জনমত গঠনে ঠিক কী ভূমিকা নেয়, ব্যক্তিগত রুচি ও গোষ্ঠীগত প্রবণতাকে কী ভাবে প্রভাবিত করে, তা আগামী দিনে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে চলেছে।
সমাজমাধ্যমই প্রথম একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে। ভুল হোক, ঠিক হোক, অসম্পূর্ণ হোক বা একপেশে— কিছু একটা মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে। তথাকথিত শিক্ষিত এলিট সমাজের বাইরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস গড়ে উঠছে। সেই সঙ্গে সর্বসাধারণের জন্য সৃজনশীলতা-চর্চার একটি বিশাল পরিসর উন্মুক্ত হয়েছে। সীমিত আকারে হলেও, বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি মত আদান-প্রদান করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। হুজুগপ্রিয়তা, গুজব, বিভ্রান্তি, ফেক নিউজ়, বাণিজ্যিক, কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে জনমতকে বিকৃত করা— এই সব কিছু মাথায় রেখেও বলা যায়, প্রথাগত মাধ্যমগুলির আপাত-সীমাবদ্ধতার অনেকখানি পূর্ণ করতে সক্ষম হচ্ছে সমাজমাধ্যম।
তবে সমাজমাধ্যমে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরটিও ভেসে ওঠে, যা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিতে পারে। কিন্তু সচেতন ভাবে ব্যবহার করতে পারলে, ব্যক্তি-মানুষের অবিশ্বাস্য ক্ষমতায়ন ঘটানো সম্ভব সমাজমাধ্যমের হাত ধরে। তা ছাড়া, এই প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে যে রক্তদান শিবির, বনসৃজন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা ও চিকিৎসার জরুরি পরিষেবার মতো সমাজ-কল্যাণমূলক কাজ পরিচালিত হতে পারে, তা করোনাকালে ও ইয়াস-পরবর্তী সময়ে সকলের নজর কেড়েছে। নিবন্ধের শেষাংশে লেখকের মন্তব্য— “এই আপাত-বাস্তবের পৃথিবীতেও তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কিছু আচরণবিধি ও রীতিনীতি তৈরি হতে থাকে...।” সমাজমাধ্যমের সদর্থক সম্ভাবনাগুলোকে সফল করতে হলে এটাই একমাত্র শর্ত।
অপূর্ব সৎপতি
সারেঙ্গা, বাঁকুড়া
বিচার করবে কে
কবি-সাহিত্যিকের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথাগত মাধ্যম আর সমাজমাধ্যমের ভূমিকার মধ্যে অনেক তফাত। প্রথাগত মাধ্যমে, অর্থাৎ পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠালে সে লেখা নির্বাচকমণ্ডলীতে পঠিত-আলোচিত হয়। তাঁরা যোগ্য বলে বিবেচনা করলে তবেই রচনা প্রকাশের মুখ দেখে। অন্য দিকে, সমাজমাধ্যমে এক জন নিজের রচনা নিজেই ‘পোস্ট’ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে, সেই গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ জনপাঠ্যের উপযুক্ত হয়েছে কি না, তা বিচার করার কর্তা লেখক স্বয়ং, যা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। ফলস্বরূপ, সোশ্যাল মিডিয়া ভরে থাকে এমন সব লেখাজোখায়, যার বেশির ভাগই লঘু, নিম্ন স্তরের।
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর