‘গরু পাচার’ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়া অনুব্রত মণ্ডলের পাশে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী।
‘এক কেষ্টকে ধরলে লক্ষ কেষ্ট আছে’ (১৫-৮) শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনটি পাঠ করে স্তম্ভিত হলাম। দুর্নীতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘জ়িরো টলারেন্স’-এর কথা বার বার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু যখন দেখি ‘গরু পাচার’ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়া তাঁর দলের অনুব্রত মণ্ডলের পাশে এসে মুখ্যমন্ত্রী দাঁড়ান, তখন কি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় যে, দুর্নীতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানটা ঠিক কোথায়?
অথচ, এই দুর্নীতিরই প্রশ্নে তাঁর দলের আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও গ্রেফতার হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তখন তাঁর পাশে দাঁড়াননি। বরং বলেছিলেন, আইন আইনের পথে চলবে। তা হলে একই দুর্নীতির প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান কেন? এটা কি দুর্নীতির প্রশ্নে দ্বিচারিতা নয়? অনুব্রতের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “কী করেছিল কেষ্ট (অনুব্রত)? কেন গ্রেফতার করা হল কেষ্টকে?... বিচার তো এক দিন হবে। কেঁচো খুঁড়তে গোখরো বেরিয়ে যাবে।” তা-ই যদি হয়, তা হলে গোখরোকে বেরিয়ে আসার জন্য আইনকে আইনের পথে চলতে দেওয়া উচিত নয় কি?
রাজনৈতিক পেশিশক্তির আস্ফালন দেখিয়ে যে ক্ষমতা বেশি দিন ধরে রাখা যায় না, তা তো বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার ঘটনার মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া যে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর দল আগামী দিনে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর, সেখানে এমন দ্বিচারিতা কি তাঁর ভাবমূর্তিকে কলুষিত করবে না? দেশবাসীর কাছেও তা কি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে?
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
সন্ত্রাসীর আশ্রয়
“পাক জঙ্গিকে ‘রক্ষা’, দিল্লির প্রস্তাবে বাধা” (১২-৮) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের প্রতিবেশী চিনও যে সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে, এই তথ্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহারের ভাই আব্দুল রউফ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীরূপে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত দাবি জানিয়েছিল। তেরোটি সদস্য দেশ উক্ত প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও বাদ সেধেছিল চিন। কন্দহর বিমান ছিনতাই, ভারতীয় সংসদে হামলা, পঠানকোট বায়ুসেনার উপরে হামলার ঘটনার মূল চক্রী এই কুখ্যাত জঙ্গির উপর অনুকম্পা প্রকাশ করে প্রকারান্তরে চিন নিজেদের সন্ত্রাসের প্রতি নরম মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছে। ভারতকে শত্রু মনে করে যারা আজ সন্ত্রাসকে সমর্থন করছে, এক দিন এর কুফল তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। ওসামা বিন লাদেনকে জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দিয়ে শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে কেমন নাজেহাল হতে হয়েছিল, তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তাই সন্ত্রাসে মদত দানকারী রাষ্ট্রগুলির সংযত থাকা প্রয়োজন।
আরও একটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন যে, যেখানে তেরোটি রাষ্ট্র বিষয়টিকে সমর্থন করেছে, সেখানে তৎক্ষণাৎ চিনের উচিত ছিল বিষয়টিতে সমর্থন জানানো। সেটা না করার কারণে চিনের উদ্দেশ্য সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সন্ত্রাস বর্তমানে বিশ্ববাসীর মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সন্ত্রাসে মদত দানকারী একটি রাষ্ট্র কেমন করে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, এক সময়ের অপরিহার্য বস্তুও বর্তমানে অকেজো বলে বিবেচিত হচ্ছে। তা হলে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের নিয়ম পরিবর্তন করা হবে না কেন? ভেটো দান নয়, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনেই নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হোক।
নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ, কলকাতা-১২২
শূন্য প্রতিশ্রুতি
‘নতুন প্রতিশ্রুতি’ (১৮-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের বিষয়বস্তু সাধারণ জনগণকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের স্বরূপ চেনাতে সাহায্য করবে। শুধু তা-ই নয়, এর সারমর্মের আলোচনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। সঠিক কথা যেটা বলা হয়েছে তা হল, ২০১৪ সাল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছর নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন, যা একেবারেই তিনি পূরণ করেননি এবং করেন না। অথচ, পরের বছর আবার তিনি প্রতিশ্রুতির ঝোলা নিয়ে জনগণের দ্বারস্থ হন। ভোটের আগে কোনও রাজনৈতিক মিটিঙে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির ঝড় তুললে আমরা তাঁর স্বভাবগত বিশেষত্ব হিসেবে ধরে নিতাম। কিন্তু তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে এই কথা বললেন? ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে।
এমন ফাঁপা বক্তৃতার কি প্রয়োজন ছিল? ‘চিরকুমার সভা’-র এক স্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “যারা কাজ করতে চায় না তারাই উদ্দেশ্যকে ফলাও করে তোলে। যথার্থ কাজ করতে গেলেই লক্ষ্যকে সীমাবদ্ধ করতে হয়।” কথাটি যথার্থ। ২০১৪ সালে তিনি বলেছিলেন, পাঁচ বছরে পনেরো লক্ষ টাকা সব ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে। তা হলে ২০১৫-তেই তাঁর খবর নেওয়ার কথা, সকলের অ্যাকাউন্টে তিন লক্ষ ঢুকেছে কি না। অর্থাৎ, তিনি এক বছরের লক্ষ্যপূরণ করতে পারলেন কি না! নতুন করে অন্য প্রতিশ্রুতির দরকার ছিল না। সুতরাং, কবির কথায় চেনা গেল, প্রধানমন্ত্রীর মুখে এত প্রতিশ্রুতির বন্যা— এটা তাঁর একটা কৌশলমাত্র।
স্বাধীনতা দিবসের আর একটা মাইলস্টোন পেরোনোর দিনে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম মূল্যায়ন করা দরকার ছিল, দেশের গণতন্ত্রের আদৌ কোনও ব্যাপ্তি ঘটল, না কি আরও সঙ্কুচিত হল। উক্ত সম্পাদকীয়ের শেষের দিকে যাকে বলা হয়েছে, ‘বিরুদ্ধ মত প্রকাশের, সত্য কথা বলার পরিসরসমৃদ্ধ প্রকৃত গণতন্ত্র’। ১৯৪৭ সালের আগে বিপ্লবীদের প্রত্যেকটা আন্দোলন, তথা লড়াইয়ের প্রথম উদ্দেশ্যই ছিল গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এর সঙ্গে যুক্ত হল দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে রক্ষা করার লড়াই। কিন্তু গত ছয়-সাত বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার বুলডোজ়ার দিয়ে ভারতের গণতন্ত্রকে বারে বারে পিষে দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৫০তম। দীর্ঘ এবং লাগাতার আন্দোলনের পর অবশেষে কুখ্যাত কৃষি বিল বাতিল হয়েছে বটে, কিন্তু এর আগে লোকসভায় এই বিলটি পাশ করানোর সময় মার্শাল ডেকে বিরোধী সাংসদদের বার করে দিয়ে একতরফা ভাবে জোর করে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এই কি গণতন্ত্রের ব্যাপকতা?
সংসদে শব্দবিধির নামে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। এই সরকার যে সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, এমন তকমা তথা যুক্তিসঙ্গত ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দুষ্কৃতীর গুলিতে নিহত হলেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। গ্রেফতার হলেন তিস্তা শেতলবাদ, মহম্মদ জ়ুবের। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে এক ন’বছরের দলিত শিশুকে এক জন উচ্চবর্ণের শিক্ষক খুন করলেন জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে। ওই একই রাজ্যে দলিত শিক্ষিকাকে পুড়িয়ে মারা হল। দুষ্কৃতীরা জানে, আইন তাদের বিপক্ষে যাবে না।
ভারতকে দু’শো বছর পরাধীন করে রাখতে ব্রিটিশের প্রধান অস্ত্র ছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রধান হাতিয়ারও এটাই। তবুও এরা মুখে গণতন্ত্রের ঢক্কানিনাদ করে। দাবি করে, এরাই যেন গণতন্ত্রের প্রবক্তা।
প্রবীর চক্রবর্তী, জয়নগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা