Mallikarjun Kharge

সম্পাদক সমীপেষু: কংগ্রেসের নবপর্যায়

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা সাংসদ মল্লিকার্জুন খড়্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তিরুঅনন্তপুরমের সাংসদ শশী তারুরকে হারালেন বিরাট ব্যবধানে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ ০৬:০৯
Share:

মল্লিকার্জুন খড়্গেই এই নির্বাচনে অঘোষিত ভাবে ‘অফিশিয়াল’ প্রার্থী ছিলেন। ফাইল চিত্র।

Advertisement

১৯৯৮ সালে জিতেন্দ্র প্রসাদকে হারিয়ে সনিয়া গান্ধী নির্বাচিত হওয়ার ২৪ বছর পর কংগ্রেস সভাপতি পদে আবারও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, এবং সীতারাম কেশরীর পর আবার গান্ধী পরিবারের বাইরের এক নেতা এই পদে বসলেন। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা সাংসদ মল্লিকার্জুন খড়্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তিরুঅনন্তপুরমের সাংসদ শশী তারুরকে হারালেন বিরাট ব্যবধানে। সনিয়া ও রাহুল এই ভোটে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও, মল্লিকার্জুন খড়্গেই এই নির্বাচনে অঘোষিত ভাবে ‘অফিশিয়াল’ প্রার্থী ছিলেন, তাই নিশ্চিত ছিল তাঁর জয়। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে রাহুল গান্ধী ফিরে না আসার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার পর যখন সভাপতি নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ল, তখন থেকেই রাজনৈতিক মহলে একটা গুঞ্জন শুরু হল যে, যিনিই কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন না কেন, তাঁকে চলতে হবে গান্ধী পরিবারের নির্দেশেই। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে তাঁর সামনে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ। গুজরাত ও হিমাচলপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে দলকে ভাল ফলের মুখ দেখাতে হবে। দু’দশকেরও বেশি গুজরাতে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সে রাজ্যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ ভোট কেটে বিজেপিকে ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ করে দেবে কি না, সে নিয়ে কংগ্রেস যথেষ্ট চিন্তায় আছে। হিমাচলেও কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা খুব একটা পোক্ত নয়। খড়্গের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হল ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের জন্য দলের সংগঠনকে মজবুত করা। সারা দেশেই এখন কংগ্রেসের সংগঠনের বেহাল দশা। ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থান ছাড়া কংগ্রেস আর কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। কংগ্রেসের ক্ষয়িষ্ণু সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করে মজবুত করা তাই একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ।

খড়্গের সামনে তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হল— কংগ্রেসের কাঠামোগত সংস্কার, তথা পার্টিকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করে তোলা। কংগ্রেসের কাঠামোগত সংস্কার না হলে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানো সম্ভব নয়। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ— রাজ্যে রাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ পার্টিকে এককাট্টা করা। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ প্রমুখ নেতা কংগ্রেস ছেড়েছেন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে। আবার দলের বর্তমান নেতাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রবল। যেমন— অশোক গহলৌতের সঙ্গে সচিন পাইলটের বিরোধ সুবিদিত। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ দলে একতা আনা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। খড়্গের সামনে পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হল, আগামী লোকসভা নির্বাচনের দিকে লক্ষ্য রেখে বিরোধীদের বৃহত্তর জোট সফল ভাবে গড়ে তোলা।

Advertisement

আর গান্ধী পরিবারের বাইরের এক জন নেতা হিসেবে খাড়্গের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হল— নিজের ভাবমূর্তি এমন ভাবে গড়ে তোলা যাতে কংগ্রেস-বিরোধীরা, বিশেষত বিজেপি, তাঁকে গান্ধী পরিবারের রাবার স্ট্যাম্প, কাঠপুতুল কিংবা রিমোট কন্ট্রোল সভাপতি হিসেবে দেগে দিতে না পারে। এই সব বাধাকে এই প্রবীণ নেতা নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে চূর্ণ করতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে।

অঞ্জন চক্রবর্তী, কেন্দুয়াডিহি, বাঁকুড়া

গণতন্ত্রের পরীক্ষা

শেষ পর্যন্ত নয়া ‘অধিনায়ক’ হিসেবে মল্লিকার্জুন খড়্গেকে বেছে নিল কংগ্রেস। সাত হাজারেরও বেশি ভোট গিয়েছে খড়্গের ঝুলিতে। প্রতিদ্বন্দ্বী শশী তারুর পেয়েছেন মাত্র ১০০০ ভোট, যা অবশ্যই তাঁর কৃতিত্ব। কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য গত কয়েকটি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা এত ভোট পাননি। একবিংশ শতাব্দীতে জাতীয় কংগ্রেসে জাতীয় সভাপতি পদের নির্বাচন কিন্তু অন্য দলের কাছেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় স্তরে গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ফল এতটাই খারাপ যে, বিরোধী দলের নেতা পদের সম্মান থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছে। বিধ্বংসী পরাজয় রাহুল গান্ধীকে সভাপতি পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। ফলে অসুস্থ সনিয়া গান্ধীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ফের এগিয়ে আনা হয়। পার্টির এই ভরাডুবির কারণে পার্টির অভ্যন্তরেও ধীরে ধীরে দলীয় নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টি হয়।

কংগ্রেস যে অন্য দলগুলির সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গণতন্ত্রের দাবি, সব দলের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক নির্বাচন হতে হবে। দলের সভাপতির এই নির্বাচন কেবল কংগ্রেস দলে নতুন সতেজতা আনার সম্ভাবনাই দেখাচ্ছে না, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য তা একটি সূচনা বিন্দুও হতে পারে। এগুলো দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে, এবং এ ধরনের সাংগঠনিক নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্য দলগুলোর উপর ইতিবাচক চাপ সৃষ্টি করেছে।

অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর

পুনশ্চ পাঠ

এ বছর দুর্গোৎসব উপলক্ষে, বামফ্রন্ট ‘উৎসবের মরসুমে দিনবদলের বর্ণপরিচয়’ ব্যাখ্যা দিয়ে লড়াইয়ের সহজ পাঠ নামে একটি প্রচার-পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। নন্দলাল বসুর লিনোকাটের নকলে সাদা-কালো ছবি দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের দু’ছত্রের ছড়ার আদলে লেখা হয়েছে প্রতিবাদের নানা ছড়া। কয়েকটি নমুনা— “ছোটো খোকা শেখে অ আ/ হক কথা সোচ্চারে কওয়া।” “মুঠো হাতে এ ঐ/চাকরিটা আনবই।” “খুকি ঞ, খিদে পায়/ ফসলের দাম চায়।” রাজনৈতিক বাতাবরণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঠেস, “ম চালায় ডাকাতদল/ রাজ্য জুড়ে কলরোল।” আর সম্ভবত বামফ্রন্টের বর্তমান অবস্থা তথা অবস্থানের প্রেক্ষিতে উঠে আসে— “য র ল ব বসে ঘরে/ প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত করে” এবং “শ ষ স বাদল দিনে/ মিছিলে যায় দাবি চিনে।”

আমরা যদি একটু পিছিয়ে যাই, তা হলে দেখব, ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী সত্যপ্রিয় রায়ের ঘোষণা অনুসারে, ১৯৭০ সালের শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগকে পাঠ্যতালিকায় আনা হয়। এর পর ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সহজ পাঠ বাদ দিয়ে এক নতুন শিশুপাঠ্য গ্ৰন্থ চালুর কথা ওঠে। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। পরিশেষে প্রবল বিরোধের মুখে সরকারি সিদ্ধান্তে ১৯৮১-এর শিক্ষাবর্ষে নতুন বই কিশলয় আসে এবং সহজ পাঠ-ও থাকে।

রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি অনিলা দেবী, প্রমোদ দাশগুপ্তরা তখন সহজ পাঠ-এর বিকল্প গ্ৰন্থ আনাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন সুকুমার সেন, প্রবোধচন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, প্রমথনাথ বিশী, সোমেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণা কৃপালনী, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত, অম্লান দত্ত প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি। বিরোধিতা করেছিল যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকা, তাদের ভূমিকাও স্মরণীয়।

সহজ পাঠ বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে বামফ্রন্ট যুক্তি দেয় যে, সহজ পাঠ-এ যথেষ্ট সমাজ সচেতনতা নেই। আছে এক সামন্ত-সমাজের ছবি। সেই সময় অনিলা দেবী বলেন, পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থার উপযোগী বৈচিত্র, এই বইয়ে নেই। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ দে বলেছিলেন যে, সহজ পাঠ শিশুদের গঠনে যথেষ্ট নয়। প্রবল বিরুদ্ধতার সামনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু রসিকতা করে বলেছিলেন— এত রবীন্দ্রভক্ত রয়েছে তিনি জানতেন না।

চার দশকের ব্যবধানে সময়ের কী অসামান্য পরিহাস, রবীন্দ্রনাথের সেই সহজ পাঠ, যার মধ্যে বামেরা সেই সময় কোনও রকম ‘সমাজ সচেতনতা’ খুঁজে পাননি, ‘সামাজিক অবস্থার উপযোগী বৈচিত্র’ না-পেয়ে সে দিন যে বইকে খারিজ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, সেই সহজ পাঠ-ই এখন তাঁদের বিশল্যকরণী। তাঁদের ‘দিনবদলের বর্ণপরিচয়’ হয়ে জনসমর্থন আদায়ের প্রচার পুস্তিকা।

আবীর কর, রঘুনাথপুর, ঝাড়গ্ৰাম

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement