মহেন্দ্রলাল সরকার।
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞানসভা থেকে রামকৃষ্ণদেব, কাঠখোট্টা এক ডাক্তারের কথা’ (পত্রিকা, ২০-৬) খুবই সময়োপযোগী এক জীবনকথা। মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন বিরল এক ব্যক্তিত্ব, যিনি যশ, খ্যাতি, অর্থ সমস্ত ছুড়ে ফেলে শূন্যে এসে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল, তা বোঝানোর জন্য একটা ঘটনার কথা বলছি।
চন্দননগরের অত্যন্ত ধনী জমিদার ছিলেন বাবু জে এন বসু। মহেন্দ্রলাল ছিলেন তাঁর গৃহচিকিৎসক। তিনি তখন দেশের বিখ্যাত হোমিয়োপ্যাথ। চিকিৎসা ছাড়াও দেশবাসীকে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ দিতে ১৮৭৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতেন। এক দিন ক্লাস চলার সময়ে জমিদারবাবুর এক কর্মচারী এসে হাজির। তিনি মহেন্দ্রলালকে তখনই জমিদারবাড়ি যাওয়ার অনুরোধ করেন। বিজ্ঞানের কোনও এক জটিল বিষয় নিয়ে মহেন্দ্রলাল তখন সবে আলোচনা শুরু করেছেন। তাই বললেন, আরও মিনিট কুড়ি পর তিনি এখান থেকে বেরোবেন। কর্মচারী তো রেগে আগুন। এটা নাকি জমিদারবাবুকে অপমান! তিনি চলে গেলেন। এই ঘটনার পর জমিদারের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যদিও সে দিনের ডাক্তার ডাকার কারণ যে অত জরুরি ছিল না, সেটা আগেই মহেন্দ্রলাল জেনেছিলেন।
স্বাভাবিক ভাবেই জমিদারবাড়ি থেকে প্রতি মাসে অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে মহেন্দ্রলাল বঞ্চিত হলেন। কিন্তু এতে তাঁর কোনও আক্ষেপ ছিল না। বিজ্ঞানের উদীয়মান ছাত্রদের আগামী দিনের জন্য তৈরি করা— এই কর্তব্যকেই তিনি সে দিন অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। এক জন জমিদারের হুকুম পালনকে নয়। এমন সব ব্যাপারেই মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন স্পষ্টবাদী, নির্ভীক, আত্মনির্ভর এক মানুষ।
প্রবীর চক্রবর্তী
গোচারণ, জয়নগর
পথপ্রদর্শক
বৌবাজারের এক জমিদারবাড়িতে এক বার মহেন্দ্রলাল সরকারের ডাক পড়েছে। স্বয়ং জমিদারগিন্নি অসুস্থ। স্টেথোস্কোপ নিয়ে পরীক্ষা করতে যাবেন, এমন সময় এল বাধা। পরপুরুষের সামনে কী করে মুখ দেখাবেন জমিদারগিন্নি? পর্দার এ পাশে রোগী, ও পাশে ডাক্তার। বিরক্ত হয়ে উঠে আসার সময় তাঁকে ফি দিতে গেলে মহেন্দ্রলাল তা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেন। এ রকম বহু ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর ডাক্তারি জীবনে। মহিলা রোগীদের দেখার সময় তিনি অনুভব করতেন, এই দেশে মহিলা ডাক্তারের প্রয়োজন কতখানি। মেয়েরাও যাতে ডাক্তারি পড়ে, তা নিয়ে জোরদার প্রচার চালান তিনি। তাঁর সামনে ছিলেন এমন দু’জন, যাঁদের উপর তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। তিনি দেখতেন, ডাক্তার হওয়ার লক্ষ্যে কী অদম্য পরিশ্রম করে চলেছেন দু’জন মেয়ে। এক জন অবলা বসু, যিনি চেন্নাইয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। তিনি ছিলেন বাঙালি মেয়েদের মধ্যে প্রথম মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। ইতিহাসে স্বামী জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর নামও সমান ভাবে স্মরণীয়। অপর জন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। শিক্ষক মহেন্দ্রলালের স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল কাদম্বিনীর হাত ধরে, পরবর্তী কালে যিনি হবেন ভারতের দ্বিতীয় এবং বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার।
সায়ন তালুকদার
কলকাতা-৯০
বিদ্যাসাগর-সঙ্গ
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। মহেন্দ্রলাল সরকার দেশবাসীর বিজ্ঞানচর্চার জন্য কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠাকল্পে অর্থ সংগ্রহে নামলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এগিয়ে আসেন। তিনি শুধুমাত্র জমিদার কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছ থেকে ২৫০০ টাকাই জোগাড় করেননি, নিজেও এককালীন ১০০০ টাকা দান করে উৎসাহিত করেন। সঙ্গে বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র প্রমুখদেরও অনুপ্রাণিত করেন (‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— স্টোরি অব হিজ় লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক’, সুবলচন্দ্র মিত্র)। ১৮৭৪-এর এপ্রিলে বিজ্ঞানসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে ট্রাস্টিবোর্ড গঠিত হয়েছিল, তার অন্যতম সদস্যও ছিলেন বিদ্যাসাগর।
আবার বিদ্যাসাগরই সে কালের এমডি উপাধিপ্রাপ্ত ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারকে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসায় উদ্বুদ্ধ করেন (ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন, জুলাই ১৯০২)। শরৎচন্দ্র ঘোষের লেখা মহেন্দ্রলাল সরকারের জীবনী থেকেও জানা যায় যে, ওই সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত ও প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক পি সি সরকার এবং বিদ্যাসাগরের সমর্থনেই হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা বিস্তার লাভ করেছিল। হোমিয়োপ্যাথির প্রচারে মহেন্দ্রলাল চিকিৎসক মহলে প্রায় একঘরে হয়ে পড়লে বিদ্যাসাগর নিজে ওই শাস্ত্রে বিশ্বস্ত থেকে তাঁর পাশে ছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা থেকেই বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রলালের বিজ্ঞান আন্দোলনকে গভীর ভাবে সমর্থন ও সাহায্য করে গিয়েছেন। এক সময় উভয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। ১৮৭৯ সালে ২৭ এপ্রিল বিদ্যাসাগরের বাড়িতে তিনি সস্ত্রীক ও সপুত্র নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন (ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের দিনলিপি ‘গ্লিনিংস অব দ্য পাস্ট অ্যান্ড দ্য সায়েন্স মুভমেন্ট’-এ উল্লিখিত। সম্পাদনা অরুণকুমার বিশ্বাস। এশিয়াটিক সোসাইটি, মার্চ, ২০০০)। ডান হাতে ফোড়ার চিকিৎসার জন্য বিদ্যাসাগর ১৮৭৯ সালের ২৭ নভেম্বর মহেন্দ্রলালের কাছে দেখাতে যান। শুধু কলকাতা বা বঙ্গদেশে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে হোমিয়োপ্যাথিকে প্রতিষ্ঠা করতে মহেন্দ্রলালের সঙ্গে বিদ্যাসাগরও ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
একেশ্বরবাদী
শ্রীরামকৃষ্ণের সারল্য মহেন্দ্রলালকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি তাঁর প্রতি আকর্ষণ বোধ করতেন। কিন্তু ঠাকুরের ভক্তিরস তাঁর অবস্থানকে প্রভাবিত করেছিল, এমন প্রমাণ নেই। মহেন্দ্রলাল ছিলেন পদধূলি গ্রহণের ঘোর বিরোধী। কিন্তু নরেন, গিরিশের যুক্তিতে হেরে গিয়ে তিনি ঠাকুরের পদধূলি গ্রহণ করেছিলেন— এ রকম তত্ত্ব রামকৃষ্ণ ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত আছে। কাঠখোট্টা, নিজ আদর্শে অবিচল মহেন্দ্রলাল এমন করেছিলেন বলে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। একই কারণে ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের গায়ে পা তুলে দেওয়া তিনি প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। গিরিশ ঘোষকে সখেদে বলেছিলেন— আর সব করো কিন্তু ওঁকে ঈশ্বরজ্ঞানে পুজো করো না। এমন ভাল মানুষটার মাথা খাচ্ছ তোমরা।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ব্রায়ান এ হ্যাচার তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ঠাকুরের ‘সর্বস্ব ঈশ্বরে সমর্পণ তত্ত্ব’ মহেন্দ্রলালের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। রামকৃষ্ণের প্রয়াণের এক যুগ পরে ১৮৯৮ সালে যোগীন্দ্রনাথ বসুকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে রামকৃষ্ণের নাম উল্লেখ না করে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরকে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি অ্যালবার্ট হলে নিবেদিতার কালী বক্তৃতার তীব্র বিরোধিতা করে এক ভক্তের হাতে নিগৃহীতও হন। যোগেন মহারাজকে কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ধর্মকর্ম অতি অপদার্থ জিনিস। মেরিনন্দন, যশোদানন্দন ও শচীনন্দন— এই তিন নন্দন জগৎটাকে নষ্ট করছে, বুঝলে।’’ একেশ্বরবাদের প্রতি গভীর আস্থাশীল মহেন্দ্রলাল ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে ছিলেন। পরমহংসের অবতারত্ব অস্বীকার করতে চাওয়া মানুষটির ঘরের দেওয়ালে কিন্তু রামকৃষ্ণদেবের ছবিই শোভা পেত।
শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তিম দশার ছবিটি তাঁর দানের টাকায় তোলা হয়েছিল। মহেন্দ্রলালের নিজের হাতের লেখা ইংরেজি ডায়েরিটি বেলুড় মঠের মহাফেজখানায় রয়েছে।
সরিৎশেখর দাস
চন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।