ছবি: সংগৃহীত
‘শীতের সকালে লেগিংস খোলাল স্কুল’ (২০-১১) শীর্ষক সংবাদের প্রেক্ষিতে এই চিঠি। ‘কর্পোরাল পানিশমেন্ট’ বা দৈহিক শাস্তি প্রদানের সঙ্গে অবমাননাজনক শাস্তি প্রদান নিয়মতান্ত্রিক ভাবে গত হয়েছেন, প্রায় এক দশক হয়ে গেল। তবু তাঁদের প্রয়াণে বহু মানুষের শোক এখনও জাগরূক এই মর্মে: ‘‘মারধর উঠে গিয়ে লেখাপড়ার বারোটা বেজে গেল।’’ অথচ বহু শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, সমীক্ষায় দেখিয়েছেন: মারধর করলে বা অপমানজনক ব্যবহার করলে, ছেলেমেয়েরা আরও হিংসাশ্রয়ী বা সমাজবিমুখ হয়ে ওঠে। যে ছাত্র মার খেতে খেতে, অপমান শুনতে শুনতে বড় হয়, সে নিজেও তার জীবনের যে কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য উত্তম মধ্যমকে অধম মনে করে না। বিশ্রী ভাবে খিঁচিয়ে কথা বলাটাকেই সে স্বাভাবিক মনে করে। স্কুলে অনেক স্যরের কাছে সে এমনই শিখেছে। আলোচনা, বোঝাপড়া, যুক্তি দিয়ে বোঝা বা বোঝানো— তার মনে কোনও সমস্যা নিরোধক পন্থা হিসেবে উঠে আসে না।
অথচ দৈহিক বা মানসিক নিপীড়ন না করেও, গন্ডগোল করা ছাত্রকে বাগে আনাই যায়। তার বসার জায়গা পরিবর্তন করে, বা তাকে দিয়েই তার দ্বারা প্রহৃত ছেলেটির শুশ্রূষা করিয়ে, কখনও তার গ্রুপ চেঞ্জ করেও তার ব্যবহার সংশোধন করার পথ খোলা রয়েছে।
কিন্তু ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার আদি প্রকরণের উপর অকৃত্রিম বিশ্বাস এই সমাজে এক শ্রেণির অভিভাবক এবং শিক্ষকের মধ্যে প্রবল। মাঝে মাঝেই তাঁরা নিজেদের বাল্যকালের বেত্রমধুর স্মৃতি বর্ণনা করেন।
শাস্তি দেওয়ার নব নব পন্থা উদ্ভাবন করে শিক্ষকেরা তা প্রয়োগ করতে পেরে আপ্লুত হতেন এক সময়, ঠিকই। কিন্তু এটা সচেতনতার যুগ।
মারধর বা অপমান অনেক সময়ই পড়ানোর অক্ষমতা ঢাকার অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। পাঠদান আকর্ষক না হওয়ার কারণেও অনেক সময় ছাত্র তার মনঃসংযোগ হারায়। শিক্ষক যখনই তাঁর সাধের বেতটিকে আর ব্যবহার করতে পারবেন না, তখনই নিজেকে আরও আকর্ষক করে তোলার কথা ভাববেন নিজের সম্মানার্থেই।
রবীন্দ্রনাথের ‘ছাত্রের পরীক্ষা’ নাটিকার একটি কথা স্মর্তব্য: পিটিয়ে গাধাকে ঘোড়া করা যায় না কিন্তু অনেক ঘোড়া গাধা হয়ে যায়।
শোভন সেন
সাঁতরাগাছি, হাওড়া
চুলের কেতা
বীরভূমের নলহাটির এক স্কুলে প্রধান শিক্ষক পাঁচ ছাত্রের চুল কাটলেন। অভিযোগ, তাদের চুলের কেতা স্কুলের পরিবেশ নষ্ট করছিল। আগেও এ রকম ছাত্রদের বাগে আনতে না পেরে কাঁথির এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্কুলের পাশের একটি সেলুনকে অনুরোধ করেছিলেন, ওই ধরনের ছাঁট না কাটতে।
এই ধরনের ছাত্রের চুলের কেতা-কাহিনি সাহিত্যিক, সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদদের ভাবায়। সমাজের যে স্তর থেকে এরা আসে, সে অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকাই হোক বা পিছিয়ে পড়া, তারা ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার না হলেও, বাড়িতে লেখাপড়ার কেতাবি চল সেই অর্থে নেই। তাই লেখাপড়ার জোরেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে, এমন মনের জোর এই ধরনের পরিবারগুলোতে অমিল। হাজার একটা কাজের মধ্যে লেখাপড়াটাও একটা কাজ, ব্রত নয়। তাই শুধুমাত্র তার চুল কাটিয়ে লেখাপড়ার দিকে তাকে টেনে আনতে যাওয়ার চেষ্টা অনেকটা পাথর কেটে জল বার করার মতো।
তার হাজারো হতাশার মাঝে কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকার এই সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করার অর্থ তার ব্যক্তিপরিসরেও হাত দেওয়া। চুলের কেতা-বঞ্চিত করলেই রাতারাতি সে ভীষণ রকম পাল্টে যাবে, এমনটা তো নয়। বরং আরও মনমরা হয়ে যেতে পারে। প্রকাশ্যে চুল কেটে দেওয়ার অপমানে অভিমানে কুঁকড়ে গিয়ে আত্মঘাতী হওয়াও বয়ঃসন্ধিকালে অস্বাভাবিক নয়।
আবার হয়তো ছেলেটির প্রচুর সমস্যা। হয়তো দিদি নিগৃহীতা বা পঙ্গু, বাবা চলে গিয়েছে, সংসার টানতে এখনই কোনও দোকানে কাজে লেগে যেতে হয়েছে। চুলের ওই কেতাই তার বাঁচার অবলম্বন, তার আসন্ন যৌবনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সাক্ষাৎ স্মারক।
কারণ, ছেলেটি জানে তার সীমাবদ্ধতা। সে জানে, সে কিছু পড়াশোনা শেখেনি। বা বলা ভাল, তাকে কিছু শেখানোর চেষ্টাই কেউ কোনও দিন করেননি। তার গন্তব্য খুবই পরিষ্কার। সে জানে কলম-পেশা চাকরি বা হোয়াইট কলার দশটা-পাঁচটার চাকরি তার কাছে অধরাই থাকবে। তাকে বেছে নিতে হবে এমন পেশা, যা এ সমাজে খুব সম্মানজনক নয়। তাই কাল কী হবে না ভেবে আজকের দিনটা সে নিজের মতো উপভোগ করে নিচ্ছে। ক্ষতি কী?
পার্থ প্রতিম চৌধুরী
কোন্নগর, হুগলি
প্রাথমিক স্কুল
সারা দেশে প্রাথমিক স্কুল আছে ৮ লক্ষাধিক, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩ লক্ষাধিক, এ ছাড়াও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু স্কুল আছে। চিনে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক, যদিও প্রাথমিকে পড়ুয়ার সংখ্যা ভারতে এবং চিনে প্রায় সমান। চার দশক আগে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, পড়ুয়ারা যেন ১ কিলোমিটারের মধ্যে স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যে সব স্কুল গড়ে উঠেছিল, তাদের অধিকাংশেরই ন্যূনতম পরিকাঠামো নেই, অনেক স্কুলে একটি ঘরের মধ্যেই সব শ্রেণির পড়ুয়ারা পড়ছে। অনেক স্কুলে এক বা দু’জন শিক্ষক, পড়া ঠিকমতো চলছে কি না দেখার কেউ নেই। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি সর্বত্রই একটি ঘরের মধ্যে চলে, তিন থেকে ছয় বছরের শিশুদের পুষ্টিদান ও শিক্ষাদান একসঙ্গে চলে। এত ছোট ছোট কেন্দ্রে শিক্ষার আদর্শ পরিকাঠামোও নেই, পরিদর্শনের ব্যবস্থাও নেই। মফস্সলের অনেক অঞ্চলে এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ৮-১০টি প্রাথমিক স্কুল চলছে, পাশাপাশি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাকায় এই স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা তলানিতে।
প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। যে স্কুলে পরিকাঠামো আশপাশের স্কুলের থেকে ভাল, তার পরিকাঠামো আরও বাড়িয়ে, পঞ্চম শ্রেণি ছাড়াও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিশুদেরও এক ছাদের তলায় নিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি স্কুলে তো একই ছাদের নীচে আড়াই-তিন বছরের শিশু থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পঠনপাঠন চলে, সকালে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত, আর বেলায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। সরকারি স্কুলেও এ ভাবে পড়ানো যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় কিছু শিশুকে একটু দূরে যেতে হতে পারে, এখন গ্রামেও রাস্তা অনেক ভাল হয়েছে, যানবাহনও সর্বত্র পাওয়া যায়।
বড় স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বেশি হলে শিক্ষকের সংখ্যাও বেশি হবে, শিক্ষকের ঘাটতি থাকলেও এ সব স্কুলে অন্য শিক্ষকদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ছোট স্কুলে, যেখানে এক বা দু’জন শিক্ষক, এক জন না এলে বা অবসর নিলে, পড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভাল পরিকাঠামো ও উন্নত পঠনপাঠন দেখলে, অভিভাবকেরা সন্তানদের দূরের স্কুলে পাঠানোর অসুবিধা মেনে নেবেন, অনেক বেসরকারি স্কুল দূরে হলেও ওই সব কারণে তাঁরা তো পাঠাচ্ছেন।
অসিত কুমার রায়
ভদ্রেশ্বর, হুগলি
নতুন প্রবাদ
প্রবাদটা এ বার ‘অফিশিয়ালি’ পাল্টে দেওয়ার সময় এসেছে। নতুন বয়ান হল: ‘‘শুধু যুদ্ধে ও ভালবাসায় নয়, রাজনীতিতেও ‘অনুচিত’ বলে কোনও শব্দ নেই।’’
অঞ্জন কুমার শেঠ
কলকাতা-১৩৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।