মহানায়ক উত্তম কুমার। —ফাইল চিত্র।
অগ্নি রায়ের ‘বাঙালির মহানায়ক’ (রবিবাসরীয়, ২৩-৭) প্রসঙ্গে বলতে গেলে— বাঙালিদের কাছে উত্তমকুমার শুধুমাত্র এক জন অভিনেতা নন, তিনি আবেগ, ভালবাসা, সকলের প্রিয় ‘মহানায়ক’। সেই জন্যই তো তিনি প্রয়াত হওয়ার এত বছর পর আজও অনুরাগীদের মনে নিজের স্থান ধরে রেখেছেন। যদিও এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলা সিনেমার জগতে উত্তমকুমারের প্রথম জীবন খুব সাফল্যমণ্ডিত ছিল না। তবে সাড়ে চুয়াত্তর সাফল্যের আলো দেখার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
কিন্তু বাংলা সিনেমার দর্শক যে ভাবে তাঁকে গ্রহণ করেছে, সারা দেশের মানুষের মন তিনি সে ভাবে জয় করতে পারেননি। ষাটের দশকের শুরুতেই উত্তমকুমার-আশা পারেখ জুটির হিন্দি ছবি করার কথা হয়েছিল। ছবির নাম ঝংকার। বম্বে গিয়ে উত্তমকুমার আশা পারেখের সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের শুটিংও করেছিলেন। এটি ছিল পঞ্চাশের দশকের একটি বাংলা ছবির রিমেক। কোন বাংলা ছবির রিমেক, সেই নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। সম্ভবত নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ইন্দ্রাণী ছবির হিন্দি রিমেক। ইন্দ্রাণী ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা তাঁদের প্রেমপর্বে এমনই একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছিলেন। উত্তম-আশার হিন্দি ছবিটিই হত উত্তমকুমার অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি, যে ছবি দিয়েই বম্বেতে পা রাখতে চলেছিলেন তিনি। কিন্তু এই ছবিটি কিছু দিন কাজ শুরু হয়েই বন্ধ হয়ে যায়।
কিংবদন্তি রাজ কপূরও বাংলার ‘মহানায়ক’কে জাগতে রহো-র বাংলা রিমেক একদিন রাত্রে-তে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ব্যস্ত সময়সূচির জন্য এই ক্ষেত্রে সময় দিতে পারেননি অভিনেতা। এমনকি এর পর ব্লকবাস্টার সঙ্গম-এও উত্তমকে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন রাজ কপূর। কিন্তু সাফল্যের শীর্ষে থাকার সময় গোপালের চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হননি তিনি। সেই ছবি বক্স অফিসে হিট হওয়ার পর নাকি বেশ আফসোস করেছিলেন ‘মহানায়ক’। কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, আর বেশ কিছু জটিলতা— এই দুইয়ের মিশ্রণেই বাংলার ‘মহানায়ক’ বলিউডে নিজের সম্পূর্ণ প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারেননি।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর
চরকির গান
‘বুকের মধ্যে বাজে যে গান’ (১৫-৭) প্রবন্ধে ঈশিতা ভাদুড়ী যথার্থ বলেছেন। তখন একদম ছোট, গ্রামে বিয়েবাড়িতে প্রথম রেকর্ড প্লেয়ার দেখার সুযোগ হয়। চরকির মতো ঘুরছে। গ্রামে কোনও বড় অনুষ্ঠানে মাইকে গান বাজানোর চল ছিল। সেখানে আধুনিক থেকে আরম্ভ করে বাংলা ছায়াছবির গান বাজত। এমনও দেখেছি কেবলমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুল গীতি বাজছে। মানবেন্দ্র, মান্না, নির্মলা, সতীনাথ, লতা, আরতি, হেমন্ত— এঁদের গান শোনার জন্য মানুষ বসে থাকতেন। পরবর্তী কালে ক্যাসেট প্লেয়ার এল। বাড়িতে টেপ রেকর্ডার থাকলে সোনায় সোহাগা। যাঁদের টেপ রেকর্ডার ছিল, তাঁরা অন্যের সঙ্গে ক্যাসেট দেওয়া-নেওয়া করতেন। পরে এল সিডি প্লেয়ার। একটি সিডি প্লেয়ারে অনেক গান। ক্যাসেটের মতো ফিতে জড়িয়ে যাওয়ার ভয় নেই। ক্যাসেটের সময় অনেক গানের অ্যালবাম বার হত। কোনও অ্যালবাম জনপ্রিয় হলে সঙ্গে সঙ্গে দোকানে পাওয়া যেত না। অনেক সময় অগ্রিম টাকা দিয়ে আসতে হত। সিডি থেকে ডিভিডি-তে উত্তরণ ঘটল খুব কম সময়ের মধ্যে। এখন নানা অ্যাপ-এ গান শোনা যায়। অনেক গান নিয়ে অ্যালবাম বার হয় না বললেই চলে।
সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ডিস্ক-ইতিহাস
‘বুকের মধ্যে বাজে যে গান’ শীর্ষক প্রবন্ধে একাধিক ভুল তথ্য আছে। প্রথম ভারতীয় রেকর্ডিং গওহরজানের কণ্ঠে হয়নি। ডিস্ক রেকর্ডের প্রবর্তক এমিল বার্লিনার ১৯০১ সালে জন ওয়াটসন হডকে প্রতিনিধি হিসাবে কলকাতায় পাঠান। কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি তাদের শাখা অফিস খোলে জুলাই মাসের ৭ তারিখে, ৬/১ চৌরঙ্গি রোডে। নাম ছিল ‘দ্য গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড’। পরে অফিস স্থানান্তরিত হয় ৮/২ ডালহৌসি স্কোয়্যারে (মে ১৯০২, অক্টোবর ১৯০৩)। গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম রেকর্ডিং এঞ্জিনিয়ার ও বার্লিনারের অতি ঘনিষ্ঠ গেইসবার্গ ১৯০২ সালেই কলকাতায় আসেন। গান রেকর্ডিং-এর যন্ত্রপাতি তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। ৮ নভেম্বর ১৯০২ ভারতে প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করান গেইসবার্গ— নর্তকী-গায়িকা মিস শশিমুখীর কণ্ঠে ‘আমি কি সজনী কুসুমেরি’। আর ১১ নভেম্বর রেকর্ড হয় গওহরজানের প্রথম গান ‘ডাগর না জানি যব ক্যায়সে’। গওহরজান প্রথম বাংলা গান রেকর্ড করেন ১৯০৩ সালে, ‘ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে’।
১৯০৮ সালের আগে পর্যন্ত সমস্ত রেকর্ড ছাপা হয়ে আসত বিদেশ থেকে, প্রধানত জার্মানির হ্যানোভার থেকে। এমনই এক সময়ে বাঙালি কৃতী সন্তান হেমেন্দ্রমোহন বসু দেশের মধ্যে প্রথম শুরু করলেন সিলিন্ডার রেকর্ডের ব্যবসা। প্রবন্ধকারের মতে, তিনি ‘এইচএমভি থেকে যন্ত্রপাতি ভাড়া করে’ গান রেকর্ড করতেন। এমন তথ্যের কোনও ভিত্তি নেই। কেননা গ্রামোফোন কোম্পানি ছিল ডিস্ক রেকর্ড প্রস্তুতকারক সংস্থা। হেমেন্দ্রমোহন বিদেশ থেকে সিলিন্ডার রেকর্ড তৈরির প্রযুক্তিযন্ত্র ‘ফোনোগ্রাফ’ আমদানি করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর স্বদেশি রেকর্ড তৈরির কারখানা, যা ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’ নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি প্রথম এইচ বোসেস রেকর্ডে গৃহীত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে। কিন্তু সিলিন্ডার রেকর্ড যুগের অবলুপ্তি ও ডিস্ক রেকর্ডের জনপ্রিয়তা তাঁর ব্যবসায় ভাটা আনে। তিনি ফরাসি রেকর্ড নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে শুরু করেন ‘প্যাথে-এইচ বোসেস রেকর্ড’। ‘বীণাপাণি’, ‘বেকা’, ‘নিকোল’, ‘ওডিয়ন’-সহ একাধিক বিদেশি কোম্পানিও সে সময়ে বহু খ্যাতনামা শিল্পীর গান রেকর্ড করে ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে ১৯০৭-০৮ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির অফিস স্থানান্তরিত হয় ১৩৯ বেলেঘাটা রোড, শিয়ালদহে। ২৩ মে ১৯০৮-এ কলকাতায় প্রথম ডিস্ক রেকর্ড তৈরির কারখানা স্থাপিত হল এখানেই। ডিসেম্বর মাসে ভারতে প্রথম রেকর্ড ছাপার কাজ শুরু করল গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতার নিয়মে এইচ বোসেস-সহ অন্যান্য দেশি-বিদেশি কোম্পানি ধীরে ধীরে পিছু হটে। এর পর ১৯৩২ সালে জার্মানি থেকে সাউন্ড রেকর্ডিং নিয়ে পড়াশোনা করে আসেন চণ্ডীচরণ সাহা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিন্দুস্থান মিউজ়িক্যাল প্রোডাক্টস লিমিটেড’, যা ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড’ নামে পরিচিত। তখন ‘ইন্ডিয়ান রেকর্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ নামে কিছু ছিল না, এম এল সাহাও তার প্রতিষ্ঠাতা নন, যা লেখক বলেছেন। কবিকণ্ঠের গান (‘তবু মনে রেখো’) আর কবিতাপাঠ (‘আমি যখন বাবার মতো হব’) দিয়ে অগস্টে শুরু হয় হিন্দুস্থান রেকর্ডের যাত্রা, অক্রূর দত্ত লেনে। পাশাপাশি জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ‘মেগাফোন রেকর্ড’ পথ চলা শুরু করে কাজী নজরুল ইসলামের দু’টি গান দিয়ে, ১৯৩২-এর সেপ্টেম্বরে। শিল্পী ধীরেন দাস।
রেকর্ডিংয়ের ইতিহাসে ‘গ্রামোফোন কোম্পানি’ নামটি সব সময় এইচএমভি-কেই নির্দেশ করে। প্রবন্ধকার সর্বক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি এনেছেন। এইচএমভি-র লোগো সংক্রান্ত তথ্যটিও ভুল। এই জনপ্রিয় ছবিটি ১৮৯৩-১৮৯৫ সালের মধ্যে আঁকেন চিত্রশিল্পী ফ্রান্সিস ব্যরড। নিপার নামের একটি কুকুর ফোনোগ্রাফের সামনে বসে যেন গান শুনছে। যেন শুনছে— কারণ, তখন ফোনোগ্রাফের মাধ্যমে যেমন গান শোনা যেত, তেমন রেকর্ডও করা যেত। তাই নিপার গান শুনছে, না কি গান রেকর্ড করছে, বিতর্কের বিষয়। তবে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে ব্যরডের তখন যোগাযোগ ছিল না। কিছু সংশোধনের পরে ছবিটি ১৮৯৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃক গৃহীত হয় এবং ১৯০০ সালে বাণিজ্যিক ভাবে প্রথম ব্যবহৃত হয়।
কানাইলাল চন্দ্র, কলকাতা-১৫০