পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী তাঁর ‘গভীরসঞ্চারী সমাজবোধ’ (৯-৫) শীর্ষক প্রবন্ধে ভেবলেনের পণ্য-তত্ত্বের সঙ্গে সমসাময়িক রাবীন্দ্রিক পণ্য-চিন্তার তুলনা করেছেন। এঁদের দু’জনের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন, তা মনে রাখতে হবে। তবে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ভোগের ব্যাপারে নৈতিক অবস্থানের কোনও তাৎপর্য বর্তমান যুগে নেই। বিলাসকে ফাঁস হিসেবে দেখা, বা সামগ্রীর প্রতি বাসনাকে অসুস্থতার লক্ষণ, লজ্জাজনক ঠাহর করা এক সময় করেছিল ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল’-এর অনুগামী চিন্তকরা। বামপন্থী ও গান্ধীর ভক্তরাও ক্রেতার ব্যক্তিসত্তা, মেধা এবং নির্বাচনের অধিকারের অবমাননা করেছেন। নিজেদের স্বাভাবিক ভোগস্পৃহাকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে প্রচুর সময় ও শব্দের অপব্যবহারও করেছেন। ব্যয়বহুল কাফের আঙিনায় বসে বিপ্লবের পরিকল্পনা রচনার দ্বিচারিতাও করেছেন।
পণ্য-ভোগ-বিমুখ ভাবমূর্তির বাহকরা, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এটা মেনে নিতে পারছেন না যে, সচ্ছল সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয় পণ্য বা বিত্তের বিস্তার ও ব্যাপ্তির মাধ্যমেই। পণ্য বা বিত্তকে তিরস্কার করে নয়। অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধির মাধ্যমেই সামাজিক সমতা আসে। পণ্যের ভূমিকা সেখানে শ্রেণিগত বিভাজন গড়া নয়, বরং তাকে হ্রাস করা। আয়ের সেই সমতা স্থাপিত হলে আর সামন্ততান্ত্রিক কায়দায় মস্ত বাড়ি-গাড়ির প্রদর্শন করে সামাজিক পার্থক্য স্থাপনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমরা সে পথে না গিয়ে অনেকেই পণ্য-বিমুখ হওয়ার মেকি সাধনায় মেতে আছি। রবীন্দ্র-জমানায় পণ্যের সংযত ব্যবহারের মধ্যে উচ্চস্তরের নৈতিক অবস্থান থাকলেও, আজ বিশ্বায়ন-উত্তর ভুবনে ব্যয়সঙ্কোচের গরিমা নেই, আছে সঙ্কীর্ণতার ছাপ, অযথা ত্যাগকে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা। এই প্রাচীনপন্থীদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ভোগকে কুরুচিপূর্ণ বলে গঠন করার একটা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। সেটা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মূল প্রকল্প।
বিংশ শতাব্দীর স্বদেশি চেতনার মূলে রয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ধারণা। রণকৌশলে, প্রযুক্তিতে, সংগঠনে এবং পণ্যে— পাশ্চাত্যের উৎকর্ষ উপনিবেশ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যা কিছু, যেমন আধ্যাত্মিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি— এ সকল ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীন। এই অন্দর-বাহিরের সামাজিক দ্বৈতকরণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই অন্দর-বাহিরের বিভাজনের বিশদ বিবরণ পাই ঘরে বাইরে উপন্যাসেও।
গত ত্রিশ বছরে পণ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমূল পাল্টেছে। পণ্য বা ভোগকে দূর-ছাই করাটাই এখন সেকেলে বিলাসিতা। পণ্য আজ শুধুমাত্র শ্রেণিচিহ্ন নয়। পণ্য একটা অভিজ্ঞতা ও বাসনার ধারক ও বাহক। মধ্যবিত্ত সত্তা গঠনে পণ্যের সাংস্কৃতিক ভূমিকা আজ অনস্বীকার্য।
শ্রীদীপ, কলকাতা-৮৬
ভুল ইতিহাস
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ স্থানগুলোর মধ্যে নবদ্বীপের নাম উল্লেখযোগ্য। বছর দুয়েক আগে সঙ্গত ভাবেই নবদ্বীপকে ‘হেরিটেজ সিটি’ ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অতি সম্প্রতি শহরের ঐতিহ্যশালী স্থানগুলোতে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-সহ পরিচিতি-ফলক লাগানো শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন। কিন্তু মর্মান্তিক ভুলে ভরা ফলকগুলো বিকৃত ইতিহাসের বাহক হয়ে উঠেছে।
নবদ্বীপে রয়েছে দু’শো বছরের বেশি পুরনো মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত অনুমহাপ্রভু মন্দির। ভাগ্যচন্দ্রের ঊর্ধ্বতন সপ্তম গুরু নরোত্তম ঠাকুর কমিশনের ফলকে হয়ে গিয়েছেন মহারাজের পুত্র ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। নবদ্বীপের প্রধান মহাপ্রভু মন্দিরের গায়ে ফলকে লেখা হয়েছে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলায় চৈতন্য মহাপ্রভুর পুজো শুরু হয়েছিল। অখণ্ড বাংলার কথা বাদ দিলেও নবদ্বীপের মণিপুর অঞ্চলে উল্লিখিত মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র ১৭৯৮ সালে অনুমহাপ্রভু মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সেবাপুজো চালু করেন।
নবদ্বীপের পোড়ামাতলা নামটিকে ফলকে ‘পোড়োমাতলা’ করেই ক্ষান্ত হয়নি কমিশন, লেখা হয়েছে মহারাজ গিরিশচন্দ্র নাকি ‘দুটি প্রস্তর দেবদেবীমূর্তি’-কে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন এক বটগাছের গোড়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তী কালে মহারাজ রাঘব রায় সে দু’টিকে ভবতারিণী কালী ও শিবলিঙ্গে রূপান্তরিত করান। কিন্তু ঘটনা হল, রাঘব রায় ছিলেন গিরিশচন্দ্রের ঊর্ধ্বতন দশম পুরুষ। ভবতারিণী কালী ও ভবতারণ শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত উল্লিখিত ঘটনাও অবান্তর। নবদ্বীপ সাধারণ গ্রন্থাগার-এর সাইনবোর্ডে এই পাঠাগারের নামটি স্পষ্টাক্ষরে জ্বলজ্বল করলেও হেরিটেজ ফলকে তা হয়ে গিয়েছে ‘নবদ্বীপ পাবলিক লাইব্রেরি’।
সরকারি সিলমোহর লাগানো এই ফলকগুলোই নবীন প্রজন্মের নবদ্বীপবাসী এবং বহিরাগত মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে ক্রমশ। তাই অবিলম্বে সমস্ত বিকৃত-তথ্যের ফলক তুলে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তাঁদের পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নতুন করে ফলক লাগানো হোক।
সুব্রত পাল, মালঞ্চপাড়া, নবদ্বীপ
বাদুড়ের ভয়
সুমনা সাহার ‘মাথা রক্ষার বিশ্বস্ত সঙ্গী’ (রবিবাসরীয়, ১৫-৫) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়তে পড়তেই আমার কৈশোরের একটি মজার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এক রবিবারের সন্ধেবেলা। হঠাৎ খেয়াল করলাম, বাড়ির মধ্যে কোথা থেকে যেন একটা বাদুড় ঢুকে পড়েছে এবং সেটা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা সব ক’টা জানলা খুলে দিলাম। দরজার পাল্লাগুলোও হাট করে খুলে দেওয়া হল। ভাবলাম, এ বার জানলা বা দরজা দিয়ে ঠিক বেরিয়ে যাবে বাদুড়টা। কিন্তু তা হল না।
ঠিক তখনই আমাদের বাড়িতে এলেন বাবার এক পরিচিত। তিনি বাড়িতে বাদুড় ঢুকেছে শুনেই বললেন, “আমাকে একটা ছাতা দিন। এখনই তাড়িয়ে দিচ্ছি।” আমরা অবাক। ভদ্রলোক এক অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন, “বাদুড়রা ছাতাকে ভয়ানক ভয় পায়!” বাবা দাদুর বেশ বড়সড় কালো কাপড় দিয়ে ছাওয়া, বাঁকানো ডাঁটিওয়ালা ছাতাটা এনে দিলেন। ভদ্রলোক ছাতাটা খুলে বাদুড় যে দিকে উড়ে যাচ্ছিল, ঠিক তার পিছনে খোলা ছাতা হাতে ছুটতে লাগলেন।
মিনিট দশ-বারো খোলা ছাতা হাতে ছোটাছুটির পর বাদুড়টাকে বাড়ি থেকে তাড়ানো গেল। এতগুলো বছর পরও ছাতার ওই অদ্ভুত ব্যবহারের কথা ভুলতে পারিনি।
সৌরীশ মিশ্র, কলকাতা-৯১
ছাতার কাজ
ছাতা-পরব আসলে শস্যের উৎসব, সে কথা যথার্থ। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে ছাতা-পরবের দিন গ্রামবাংলার প্রত্যেক চাষি সূর্য ওঠার পূর্বেই পার্শ্ববর্তী বনজঙ্গল থেকে সেগুন এবং শাল গাছের ঘন পাতায় ভরা বড় বড় ডাল কেটে এনে প্রতিটি ধানি জমির মাঝে পুঁতে দেন। একে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ডাল গাড়া’ পরব বলে। কৃষকদের ধারণা, এতে ছাতার তলায় লক্ষ্মী ঠান্ডায় বিরাজ করেন। ওই দিনেই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজায় ‘ছাতা’র প্রতীক হিসাবে সেগুন বা শালগাছের ডাল গুঁজে দেওয়া হয়, যাতে বর্ষার বিষাক্ত পোকা-মাকড় বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। তা ছাড়া বাংলার পশ্চিম প্রান্তে বিশেষ করে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া এলাকার এক রেওয়াজ হল, শ্রাবণের এক বিশেষ তিথিতে নতুন জামাইকে মেয়ের বাড়ির তরফ থেকে ছাতা ও গামছা উপহার দেওয়া, যাতে জামাই মেয়েকে সারা জীবন ছাতার তলায় শান্তির ছায়াতে রাখতে পারে।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।