Buddhadeb Guha

সম্পাদক সমীপেষু: অক্ষয় খড়্গ

যত দিন অত্যাচার, অসাম্য থাকবে, বুদ্ধদেব গুহও প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তাঁর মানবিক সাহিত্য এবং খড়্গসম জ্বলে ওঠা বাক্যের মাধ্যমে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:২৯
Share:

ওড়িশার জঙ্গলে ভ্রমণরত ঋজুদা তাঁর সঙ্গীদের বলেছিলেন, “এই আমাদের আসল দেশ। কলকাতা নয়, নতুন দিল্লি বা চণ্ডীগড়ও নয়। ফ্লাইওভার আর পাতাল রেল আর ফোয়ারা নয়। যেদিন আমাদের দেশের এই সাধারণ ভাল, গ্রামীণ মানুষরা দু’বেলা খেতে পাবে, ভদ্রভাবে পোশাক পরে থাকতে পারবে, শীতে কষ্ট পাবে না, গরমে খাবার জল আর চাষের জল পাবে, সেদিনই জানবি যে আমাদের দেশের কিছু হল।” ঋজুদার সঙ্গে লবঙ্গি বনে উপন্যাসের এই কথাগুলো মনে করায়, মঙ্গলগ্রহের কক্ষ স্পর্শ করা, বা বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি নির্মাণের দামামা বাজানো নিরর্থক, যখন দেশের কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষ নিরন্তর পিষ্ট হতে হতে বেঁচে আছেন। বুদ্ধদেব গুহের মানবিকতার মধ্যে যে সত্য-সুন্দর বিরাজ করছে, তার ক্ষয় নেই।

Advertisement

সারস্বত শীর্ষক স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, “বাড়িতে বা অফিসে আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গেই দেখা করিনি কোনও দিন। এতে বিরূপতা, অভিমান এবং অপপ্রচার কম হয়নি, কিন্তু তাতেও আমি বদলাইনি নিজেকে। ২৪ ঘণ্টার দিনে অনেক কিছু যাকে করতে হয়, তার চার ধারে প্রাচীর না তুলে রাখলে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাতে কে কী মনে করলেন, না করলেন, অত্যন্ত অপারগ হয়েই বলছি, কিছু করার নেই আমার।” চরম ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে বুদ্ধদেববাবু তাঁর গুণমুগ্ধদের স্বহস্তে পত্রের উত্তর দিতেন। ঋভু পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একটা পত্র লিখেছিলাম। প্রত্যুত্তরে তাঁর চিঠির অন্তিম বাক্য ছিল, “তোমাদের উৎসাহই এই নির্দল লেখকের একমাত্র পুরস্কার।” পত্র লিখলেই তিনি উত্তর দিতেন, দেরি হওয়ার জন্য মার্জনা চাইতেন। ভদ্রতা, বিনয়ের কী অসামান্য প্রদর্শন! বুদ্ধদেব গুহ কোন মাপের লেখক ছিলেন, তা নতুন করে উল্লেখ করা বাতুলতা মাত্র। কিন্তু মানুষ হিসেবে যেন তিনি আরও উচ্চমার্গে অবস্থান করতেন।

তাঁর ঋভু উপন্যাসের একটি অংশ এই দুঃসময়ে নিরন্তর প্রেরণা জোগায়— “কার গায়ে কতটা জোর সেটা কখনই বিচার্য বিষয় নয়। অথরিটিকে, গায়ের জোরকে, চক্রান্তকে, এস্টাব্লিশমেন্টকে, মিডিয়ার দুরভিসন্ধিকে, মনোপলিকে কে কতখানি সাহসের সঙ্গে অগ্রাহ্য করতে পারেন, কে তাদের বশংবদ না হয়েও শোকে দুঃখে অপমানে অসম্মানে মাথা উঁচু করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে এই ক্লীবে ভরা পৃথিবীতে মানুষের যোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকতে পারেন, সেটাই বড় কথা।” যত দিন অত্যাচার, অসাম্য থাকবে, বুদ্ধদেব গুহও প্রাসঙ্গিক থাকবেন। তাঁর মানবিক সাহিত্য এবং খড়্গসম জ্বলে ওঠা বাক্যের মাধ্যমে।

Advertisement

কাজল চট্টোপাধ্যায়

সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

বহুমাত্রিক

বুদ্ধদেব গুহ চলে গেলেন, চলে গেল এক সঙ্গে অনেকগুলো ব্যক্তিত্ব। একাধারে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, শিকারি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, এবং হয়তো আরও কিছু। স্বর্গে কি শিকারি দরকার? না কি গন্ধর্ব চিত্রসেন অরুণাংশু হয়ে মর্তে চলে আসার পরে তাঁর জায়গাটা এখনও খালি পড়ে আছে? অথবা, চিত্রগুপ্তের হিসাবের খাতার গরমিল ঠিক করার জন্য এক জন ‘অডিটর’ দরকার?

বুদ্ধদেব গুহ বাংলা সাহিত্যে যে মণিমুক্তো রেখে গেলেন, তা নিয়ে বাঙালি পাঠক আরও একশো বছর স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারবে। নিজের লেখার শৈলী পরিবর্তন করার এমন পরীক্ষানিরীক্ষা বুদ্ধদেব গুহ ছাড়া আর কোনও লেখক করেছেন কি না, সন্দেহ। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ চানঘরে গান। এটি উপন্যাস, না কি গল্পের বই, না কি অন্য কিছু, সে সম্বন্ধে লেখক নিজেই দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে এটা যে এক উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি এই বইয়ের শেষ পাতাটা পড়া শেষ করেই আবার প্রথম পাতা থেকে শুরু করি। দু’বার পড়েই চিঠি লিখতে বসেছিলাম। মনে হয়েছিল, লেখককে অভিনন্দন জানানো উচিত। প্রায় সাত মাস পর আমাকে অবাক করে উত্তর এল। জঙ্গলের ছবি-ছাপানো প্যাডের কাগজে। মনে হয়েছিল, এত সব কাজ নিখুঁত ভাবে তিনিই করতে পারেন, যিনি নিজে এক জন নিখুঁত মানুষ।

মানস বিশ্বাস

রৌরকেলা, ওড়িশা

কবিতাই হাতিয়ার

সেবন্তী ঘোষ বেজান মাতর-এর প্রসঙ্গ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর ‘প্রতিরোধ জারি রাখবে কবিতা’ (২৬-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে। সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষণে অশুভ শক্তিকে নাশ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে কবিতা। আজ অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এক সঙ্কীর্ণ মনোভাব কাজ করে। কোনও বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতা লেখা হলে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত আসতে পারে! কিন্তু তাই বলে কখনওই কবি ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না। তাঁরা আমৃত্যু লিখে যাবেন প্রতিবাদী কবিতা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত বার নেমে এসেছে লাগামছাড়া বর্বর আচরণ, তত বারই অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে কবিতা। ভবিষ্যতেও কবিতাই হবে প্রতিবাদের হাতিয়ার।

সুমন সাহা

কৃষ্ণনগর, নদিয়া

প্রকৃত শিক্ষা

১৯৯৭ সালের বইমেলা। রাত সাড়ে সাতটা। ময়দান চত্বর ফাঁকা। আমি আর আমার বন্ধু একটি প্রকাশনার স্টলের সামনে পৌঁছে দেখি, লাল ভেলভেটে মোড়া সোফায় দামি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন বুদ্ধদেব গুহ, একা। আমাদেরই বয়সি এক জন স্টল থেকে ওঁর একটা বই কিনে ওঁর দিকে বাড়িয়ে দেয় স্বাক্ষরের জন্য। উনি তা করে দিতেই ছেলেটি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। সঙ্গে সঙ্গে ধমক, “অ্যাই, পায়ে হাত দিস কেন রে, হাত জোড় করে নমস্কার করতে পারিস না। একদম মানুষের পায়ে হাত দিবি না।” এই হচ্ছে এক জন সাহিত্যিকের দেওয়া শিক্ষা— যার তার সামনে মাথা নোয়ানো নয়। বাঁচতে হবে মেরুদণ্ড সোজা করে।

ইন্দ্রনীল রায়

কলকাতা-৪৭

পুলিনবিহারী

পীতম সেনগুপ্তের “‘জনগণমন’ কি আসলে ব্রিটিশ শাসকের জয়গান” (রবিবাসরীয়, ২২-৮) শীর্ষক প্রবন্ধের সূত্রে কিছু কথা। রবীন্দ্রচর্চার আকর প্রবাসী পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়ে পুলিনবিহারী সেন সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনা পর্যবেক্ষণ করেন এবং অনুপ্রাণিত হন। সহযোগী হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, নীরদচন্দ্র চৌধুরীকেও। আশৈশব গ্রন্থজগতে নিমগ্ন থাকা পুলিনবিহারী প্রবাসী, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থেকে বাংলা মুদ্রণ জগতে কিংবদন্তি পুরুষে পরিণত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ও রবীন্দ্র-রচনা সমৃদ্ধ একাধিক পত্রিকার বিবরণমূলক সূচিও প্রস্তুত করেন। সম্পাদনা করেছিলেন সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা (বর্ষ ১৩৬৫-৬৬), তত্ত্বকৌমুদী (বৈশাখ-চৈত্র, ১৩৭২)। সঠিক পাঠ, বিষয় বিন্যাস, গ্রন্থ পরিচয় রচনা ও মুদ্রণ সৌকর্ষে বিশ্বভারতী প্রদর্শিত সম্পাদন-পদ্ধতি পুলিনবিহারী সেনের হাতে এক বিশেষ যুগের সূচনা করেছিল। রবীন্দ্রতথ্যজ্ঞ ও বিশ্বভারতী অন্তপ্রাণ এই মানুষটিকেও সরে যেতে হয়েছিল বিশ্বভারতী থেকে।

পুলিনবিহারী সেন ‘জনগণমন’ গানটি রচনার উপলক্ষ জানতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দেওয়ার অনেক আগেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাঘ ১৩১৮ সংখ্যায় গানটির পরিচয় দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ বলে। ওই বছরের মাঘোৎসবেও গানটি ব্রহ্মসঙ্গীত বলে গীত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশন (২৬-২৮ ডিসেম্বর, ১৯১১) ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে ১৯১৯ সালে মদনপল্লিতে এক সভায় গেয়েছিলেন গানটি ‘দ্য মর্নিং সং অব ইন্ডিয়া’ নামে। পরে মস্কোয় (১৯৩০) ‘পায়োনিয়ার্স কমিউন’-এ তিনি অনাথ বালক-বালিকাদের গেয়ে শোনান গানটি।

সুদেব মাল

খরসরাই, হুগলি

খালের মৃত্যু

ইদানীং অল্প বর্ষায় চারিদিক ডুবে যায়। রাস্তার দু’দিকে চওড়া খালে আগে বর্ষার জল জমা হত। এখন খাল বুজিয়ে অবৈধ নির্মাণের ফলে সব জল রাস্তায় জমা হচ্ছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে এই জলনিকাশি খালগুলো বাঁচিয়ে সুষ্ঠু নিকাশিব্যবস্থা তৈরি করা হোক।

রঞ্জিত হালদার

মৌড়িগ্রাম, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement