‘গায়ত্রী ও প্রাণায়ামে নিরাময়! এমসে কোভিড-গবেষণা’ (২১-৩) শীর্ষক সংবাদটি পড়ে অবাক ও হতাশ হলাম। লকডাউনের শুরু থেকেই এমন অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার কথা শোনা যাচ্ছে। দেশের তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা করোনা থেকে মুক্তি পেতে নানা নিদান দিয়েছেন। কেউ বলেছেন গোমূত্র খেতে, কেউ বলেছেন গোবর-জলে স্নান করতে এবং গোবর খেতে, কেউ বলেছেন রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে। আবার কেউ বলেছেন, রামনাম করলে করোনা কাছে আসবে না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘ভাবিজি’ পাঁপড় খেলে করোনা চলে যাবে। করোনা দূর করতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু মহাসভা বিভিন্ন জায়গায় ‘গোমূত্র পার্টি’-র আয়োজনও করেছিল। আবার এখন করোনা থেকে মুক্তির জন্য গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ, প্রাণায়াম করতে বলছে। গবেষণা শুরু হয়েছে দেশের এমস হৃষীকেশ শাখায়।
একটা ভাইরাসকে নিয়ে শুধুমাত্র ভারতেই এত গুজব, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞান, অযৌক্তিক প্রচার চলছে। ‘দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রিমেডিস অ্যাক্ট ১৯৫৪’ অনুযায়ী, মন্ত্র-তন্ত্র, তাবিজ, কবজ দেখিয়ে যদি কেউ রোগ সারানোর দাবি করে, তবে সে আইনের চোখে অপরাধী। এমস হৃষীকেশ কিন্তু এই আইন ভেঙেই চিকিৎসার নামে বুজরুকি ও অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। দেশবাসীকে সরকার বিনামূল্যে সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা দিতে ব্যর্থ। সেই জন্য এই সব অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক অপচিকিৎসাকে উৎসাহ দিচ্ছে।
প্রতাপচন্দ্র দাস, নবদ্বীপ, নদিয়া
কেবল যুক্তি?
‘গায়ত্রী ও প্রাণায়ামে নিরাময়! এমসে কোভিড গবেষণা’ শীর্ষক সংবাদ কিছুটা বিদ্রুপের স্বরে পরিবেশিত। লেখাটি সমাপ্ত হয়েছে জনৈক ভাইরোলজিস্ট-এর একটি মন্তব্য দিয়ে, “ভাববাদ দিয়ে বিজ্ঞান চলে না। চলে যুক্তিবাদের উপরে।” তার মানে, মনুষ্য মন নিজের যুক্তির নাগালের মধ্যে যা পায় তাই সত্য, আর সব অসত্য? বিজ্ঞান আমাদের সর্বোচ্চ জ্ঞান দিতে পারে? বহু চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা বলে, তাঁদের দক্ষতা এবং জ্ঞান প্রয়োগ সত্ত্বেও সব সময়ে অভিপ্রেত ফল মেলে না। এমন কিছু আছে, যেখানে আমরা অসহায়। এমসে যে গবেষণা শুরু হয়েছে, সেটা বিজেপি-শাসিত ভারতে না হয়ে আমেরিকা বা জার্মানিতে হলে বোধ হয় প্রতিবেদক প্রাণায়ামে নিরাময়ের উল্লেখের পর বিস্ময়বোধক চিহ্নটি ব্যবহার করতেন না। গৌরবময় অতীত আমরা বিস্মৃত হয়েছি।
অরুণাভ সেন, কলকাতা-৭৮
‘পাই’ নিয়ে
“কী করে ‘পাই’” (এষণা, ১৭-৩) লেখাটির সূত্রে এই পত্রের অবতারণা। গণিত জনপ্রিয় করার রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের এই প্রয়াস প্রশংসনীয়। কিন্তু লেখাটি কিছু গাণিতিক তত্ত্বগত বিভ্রান্তি, অস্বচ্ছতা তথা স্ববিরোধিতার শিকার। লেখক গোড়ার দিকে বার বার ‘পাই-এর মান’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, যা অবশ্যই ‘পাই-এর মূলদ আসন্নমান’ হওয়া উচিত ছিল। আর “কারণ আমরা জানি পাই-এর মান আসলে ৩.১৪”— এই বাক্য কোনও ভাবেই কোনও গাণিতিক রচনায় অভিপ্রেত নয়। লেখক নিজেই রচনার শেষে এসে বলেছেন, “পাই-এর মান কথাটা প্রকৃত অর্থে ঠিক নয়।” যদিও ঠিকটা যে কী, সে বিষয়ে আলোকপাত করেননি। বৃত্তের আকার নির্বিশেষে তার পরিধি ও ব্যাসের ধ্রুবক অনুপাত হল ‘পাই’, যা একটি অমূলদ সংখ্যা। অন্য যে কোনও অমূলদ সংখ্যার মতোই, পাই-এরও সুনির্দিষ্ট দশমিক মান নির্ণয় অসম্ভব। এর যে কোনও ভগ্নাংশ ‘মান’ বা দশমিক ‘মান’ই প্রকৃত অর্থে মূলদ আসন্নমান মাত্র, তা সে ২২/৭ হোক বা ৩.১৪ অথবা “দশমিকের পর কয়েক কোটিতম স্থান অবধি।” এই বিশেষ অনুপাতটির ধ্রুবক হওয়ার কথা জানা ছিল প্রায় প্রতিটি প্রাচীন মানবসভ্যতায়। হাতে-কলমে আঁক-কষার অভিজ্ঞতা থেকে, এবং নিজেদের গণিত-জ্ঞান অনুসারে তাঁরা এই ধ্রুবকের মান নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছেন। তবে এই অনুপাতের কোনও বিশেষ নাম সেখানে দেখা যায় না, ‘পাই’ তো নয়ই। প্রাচীন গ্রিসের অক্ষরভিত্তিক সংখ্যাতন্ত্রে ‘পাই’ বলতে বোঝাত ৮০।
বৃত্তের পরিধিকে ‘বক্ররেখা’ বলা এই রচনার আর একটি গাণিতিক ত্রুটি, যা আমাদের নানা বিদ্যালয়স্তরের পুস্তকেও নজরে পড়ে। পরিধি হল, বৃত্তের বক্রটির দৈর্ঘ্য। আর এখানে যাকে ‘পরিধি’ বলা হচ্ছে, সেটিই হচ্ছে বৃত্ত। লেখক বলেছেন, আর্কিমিডিসের “দেখানো পদ্ধতিতে কাজ করেই পাই-এর মান ক্রমাগত নিখুঁত ভাবে বার করা সম্ভব হচ্ছে”— যদিও বাস্তবে এটি হচ্ছে শ্রীনিবাস রামানুজনের লিখে যাওয়া একটি বিশেষ অসীম অভিসারী শ্রেণিকে ব্যবহার করে। লেখক অবশ্য এই রচনায় ভারতীয় গণিতজ্ঞদের কথা উল্লেখ করেননি। জনৈক চিনা গণিতজ্ঞ স্থান পেলেও, স্থান হয়নি তাঁর সমসাময়িক আর্যভট্টের, যাঁর বইতে (৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ) আলোচ্য ধ্রুবকের ‘মান’ ধরা পড়েছে ৩.১৪১৬। তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, তা আসন্নমান, “চতুরধিকং শতমষ্টগুণং দ্বাষষ্টিস্তথা সহস্রাণাম্। অযুতদ্বয়বিষ্কম্ভস্য আসন্নো বৃত্তপরিণাহঃ।।” অর্থাৎ, ২০ হাজার (অযুতদ্বয়) একক ব্যাস (বিষ্কম্ভ)-বিশিষ্ট বৃত্তের পরিধির (পরিণাহ) আসন্নমান ১০৪-এর আট গুণের সঙ্গে ৬২ হাজারের যোগফল।
পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১০৩
টাউ দিবস
এত কাল ব্যবহৃত ‘পাই’-এর বদলে ‘টাউ’ ব্যবহারের জন্য বিশ্বের এক দল অঙ্ক বিশারদ জোরদার প্রচার চালাচ্ছেন। টাউ-এর মান ৬.২৮ (প্রায়)। তারিখে পরিবর্তন করলে এটি হয় ২৮ জুন। তাই ২৮ জুন পালিত হয় ‘টাউ ডে’ হিসেবে। ২০১০ সালের টাউ দিবসে মাইকেল হার্টল নামে এক পদার্থবিদ প্রকাশ করেন ‘টাউ ম্যানিফেস্টো’। যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, কেন পাই অপেক্ষা টাউ অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
রঞ্জিত কুমার দাস, বালি, হাওড়া
ভারতের অবদান
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় ‘পাই’-সংক্রান্ত আলোচনায় একাধিক বিদেশি মনীষীর নাম উল্লেখ করেছেন। অথচ, লেখক এক বারও কোনও ভারতীয় গণিতজ্ঞের নাম উল্লেখ করলেন না। উনি লিখেছেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর গণিতবিদ উইলিয়ামস জোন্স প্রথম বৃত্তের জ্যামিতিতে পাই-কে ঢুকিয়ে নেন।” অথচ, গণিতের অন্যতম পীঠস্থান ভারতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে ভারতীয় গণিতজ্ঞ আর্যভট্ট বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত দিয়েছেন ২২/৭। আর এক ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্য লিখেছেন, ২২/৭ দিয়ে বৃত্তের ব্যাসকে গুণ করলে স্থূল, এবং ৩৯২৭/১২৫০ দিয়ে গুণ করলে প্রায় কাছাকাছি পরিধির মান পাওয়া যায়। ৩৯২৭/১২৫০ বা (৩+১৭৭/১২৫০) দশমিকে প্রকাশ করলে ৩.১৪১৬... হয়, যা আধুনিক পাই (৩.১৪১৫৯...) এর খুব কাছাকাছি। নবম শতকের ভারতীয় গণিতজ্ঞ মহাবীরাচার্য, চতুর্দশ শতকের গণিতজ্ঞ নীলকান্ত সোয়ামাজির বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সংক্রান্ত গবেষণা প্রসঙ্গে লেখকের নীরবতা দুর্ভাগ্যজনক।
মন্দার গোস্বামী, খাগড়া, মুর্শিদাবাদ
উপেক্ষিত
জয়ন্ত বসু যথার্থই বলেছেন, ‘সরকারি উন্নয়নে পরিবেশ নেই’ (১৯-৩)। দারিদ্র ও অনুন্নয়নকে ঢাল করে আমাদের দেশে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলি উপেক্ষিত। এভারেস্ট-অ্যান্টার্কটিকায় দূষণ, কিংবা আমাজনের জঙ্গলে দাবানল হলে আমাদের তথাকথিত পরিবেশ চেতনা জাগ্রত হয়। অথচ, ঘরের কাছে যে আবর্জনার স্তূপ প্রতি দিন গড়ে ওঠে, তা নিয়ে আমরা উদাসীন।
অপূর্ব সৎপতি, সারেঙ্গা, বাঁকুড়া