Literature

সময়ের দলিল

আমরা যদি বাংলা সাহিত্য, মহাকাব্য বা পুরাণের দিকে তাকাই, তা হলে এমন অনেক কিছু খুঁজে পাব যা এখন অশ্লীল বা আপত্তিকর বলে মনে হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৩ ০৬:১২
Share:

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

‘সাহিত্যের খুঁত’ (২১-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের ভাবনা ও তাতে কিংবদন্তি লেখক সলমন রুশদি-র বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। সাহিত্য সম্পদ মাঝে মাঝে কালকে অতিক্রম করলেও তা মূলত একটি নির্দিষ্ট কালের সম্পদ। যে সময়ে তা রচনা করা হচ্ছে, সেই সময়ের সংস্কৃতির ছাপ তার মধ্যে থাকবেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অশ্লীল বা আপত্তিকর মনে হলেও সেই লেখাতে কলম চালানোর অর্থ হল, সেই সময়ের ভাবনাকে অস্বীকার করা এবং লেখকের স্বাধীন চিন্তাভাবনার অবমাননা করা।

Advertisement

আমরা যদি বাংলা সাহিত্য, মহাকাব্য বা পুরাণের দিকে তাকাই, তা হলে এমন অনেক কিছু খুঁজে পাব যা এখন অশ্লীল বা আপত্তিকর বলে মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, জীবনানন্দ দাশ-এর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির কিছু অংশ অশ্লীল বা আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি-র কিছু অংশ অশ্লীল ঠেকতে পারে কোনও কোনও পাঠকের কাছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ছবি) বা সমসাময়িক লেখকগণ ‘মাগী’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন, যা আমরা এখন ব্যবহার করার কথা ভাবতেও পারি না। এক সময়ে ‘খেউড়’ গানের রমরমা ছিল কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে। এটি আদি রসাত্মক গান, গানের ভাষাও অশ্লীল। একে রসের গানও বলা হয়। এখন তার প্রচলন খুব একটা না থাকলেও নদিয়ার নবদ্বীপে রাসের সময়ে এই গান গাওয়ার রীতি এখনও পালিত হয়।

এত উদাহরণ দেওয়ার উদ্দেশ্য হল একটাই— সাহিত্যকে বিচার করতে হলে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে এবং কিছু জায়গা আপত্তিকর মনে হলেও এখনকার বোধবুদ্ধি অনুযায়ী তাতে হস্তক্ষেপ করা একদমই বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে অপমান করা হয়। কে বলতে পারে, হয়তো আজ যা যা রচনা করা হচ্ছে তা আগামী প্রজন্ম এই একই যুক্তিতে ছুড়ে ফেলে দেবে না? মনে রাখতে হবে, সাহিত্য শুধুমাত্র মনোরঞ্জন করে না, তা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দলিলও বটে। রুচিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা তা নষ্ট করে ফেলছি কি না, ভেবে দেখা দরকার।

Advertisement

অমিত দত্ত, গাড়ুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা

নতুন ভাষা

সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে তৈরি মৃণাল সেনের ছবিগুলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মৈনাক বিশ্বাসের লেখাটির একটি সুন্দর শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে ‘তর্কের মতো সিনেমা’ (১২-৫)। সে কালের উত্তপ্ত ঝোড়ো সময় নিয়ে ছবি তৈরি করতে গিয়ে মৃণাল সেন ছবি তৈরির প্রচলিত ধাঁচ ভেঙে দিয়েছেন। ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক এবং কোরাস-এর মতো ছবিতে অজস্র ভার্টিক্যাল লাইন ব্যবহার করেছেন এবং আমাদের ছবি দেখার গতানুগতিক অভ্যাসটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছেন।

কলকাতা ৭১-এ দেখি ২১ বছরের ছেলেটি গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার পর দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলছে, “আমাকে কারা গুলি করে মেরেছে আমি জানি, কিন্তু আমি বলব না। আপনারা তাকে খুঁজে বার করুন। আপনারা এত নিস্পৃহ কেন?” বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, পরিচালক ওই উত্তপ্ত সময়ে দাঁড়িয়ে সিনেমার এক নতুন ভাষার প্রয়োজন অনুভব করেছেন, যেটা নিছক গিমিক নয়। সত্তরের দশকের উত্তাল যৌবন বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল, তাদের সেই ক্রোধ, স্বপ্ন, সেই সময়কার উত্তপ্ত রাজনীতি মৃণাল সেনকে বাধ্য করেছিল নতুন চলচ্চিত্রের ভাষা খুঁজতে।

ষাটের দশকে ফ্রান্সের সিনেমায় এক ‘নতুন তরঙ্গ’ উঠেছিল, যার সঙ্গে মৃণাল সেন পরিচিত ছিলেন। সেই সময় ভুবন সোম ছবিটি বক্স অফিস সাফল্য পাওয়ায় মুম্বইয়ের প্রযোজকরা তাঁর পিছনে ঘোরাঘুরি করছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সময় টের পাচ্ছিলেন, কলকাতা ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, যেন ফেটে পড়তে চাইছে। তিনি তখন ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার মিছিলের ছবি তুলতেন। ইন্টারভিউ ছবিতে চাকরিপ্রার্থী ছেলেটি লন্ড্রি ধর্মঘট থাকায় স্যুটবুটের পরিবর্তে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে যায় এবং সে চাকরিটি থেকে বঞ্চিত হয়। ছেলেটি তখন একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে লন্ড্রির শো-কেসে ছুড়ে মারে। তার পরই পর্দা জোড়া জনজাতিদের সশস্ত্র মিছিল। মুহূর্তের মধ্যে যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায়। ছেলেটির চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভ এক বৃহত্তর প্রতিবাদের ব্যঞ্জনা পায়। তখন সেটা আর একটি বেকার ছেলের একক না, হয়ে দাঁড়ায় প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সহিংস প্রতিবাদ।

পদাতিক ছবিতে দেখি সমস্ত পর্দা জুড়ে একটা গ্লোব ঘুরছে, তার সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে সংগঠিত সশস্ত্র সংগ্রামের ক্লিপিংস। পাশাপাশি কলকাতার রাস্তায় কঙ্কালসার বুভুক্ষু মানুষের সারি আর পর্দাজোড়া দু’টি আড়াআড়ি করে বাঁধা মাইক্রোফোনের ছবি, সাউন্ড ট্র্যাকে সংসদীয় নেতাদের নানান সুরে ও নানান স্বরে ভেসে আসা ভাষণ। ছবির এই ইমেজগুলি নকশাল ছেলেটির সশস্ত্র বিপ্লবের কাজে যুক্ত হওয়াকে ন্যায্যতা দেয়। পুলিশ-ভ্যান থেকে পালিয়ে এক গোপন ডেরায় আশ্রয় নেওয়া নকশাল যুবকটির মধ্যে দলের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিপ্লবের একটা নির্দিষ্ট স্তরে শত্রু মিত্র চেনার ক্ষেত্রে মাও জে দং-এর দীর্ঘ উদ্ধৃতির মধ্যে দিয়ে যার প্রকাশ ঘটে। যে বাবাকে ছেলেটি মনে করত বিপ্লবের পথে বাধা, সেই বাবাকেই ছবির শেষের দিকে নতুন করে আবিষ্কার করে সে।

অরুণ পাল, উত্তরপাড়া, হুগলি

বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র

পথিক গুহের ‘কাঠগড়ায় এক বিজ্ঞানী’ (রবিবাসরীয়, ২১-৫) পড়ে মনে পড়ছিল হীরক রাজার দেশে-র বিজ্ঞানীর কথা। তিনিও তো তাঁর আবিষ্কারকে রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করেছিলেন। রাষ্ট্র বা ক্ষমতাবান শক্তি অর্থ বিনিয়োগ করে গবেষণায়। গবেষণায় পাওয়া ফসল যে সেই শক্তি বা রাষ্ট্রের কাছে মাথা বিকিয়ে বসবে, এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। সেখানে ‘আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে গোটা অধিবাসী সমেত একটি শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে’ (আগন্তুক)— এমন সুযোগ পেলে কোনও ক্ষমতালোভী শক্তি ছেড়ে দেবে কেন?

লেখাটা যে দিন প্রকাশিত হল, সে দিন রাজীব গাঁধীর মৃত্যুদিন। পরিচালক সুজিত সরকারের মাদ্রাজ ক্যাফে-তে দেখানো হয় রাজীব গাঁধীকে হত্যার জন্য মানববোমা তৈরি করা হয় প্লাস্টিকের উপকরণ দিয়ে, যা মেটাল ডিটেক্টরেও ধরা যাবে না। যে ব্যক্তি বানাচ্ছিলেন এই বোমা, তাঁকে কার্যত ভয় দেখিয়ে এই কাজ করায় এলটিটিই। তার পর সেই বিজ্ঞানীর পরিবারের মানুষরা প্রাণে বেঁচেছিল কি না, তা জানা হয়নি। যাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁরা একক মানুষের বিবেক দংশন নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়; কারণ শাসন এবং শোষণযন্ত্রে ‘বিবেক’রূপী দুর্বল বিষয়ের স্থান নেই। সেখানে আনুগত্য আছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যত দিন থাকবে, তত দিন এই সব দেখে যেতেই হবে।

এ বার আসি ছবির কথায়। ওপেনহাইমার ছবি করছেন ক্রিস্টোফার নোলান, ভাল কথা। তবে এর আগে ডানকার্ক ছবিতে ঐতিহাসিক কাহিনিকে ঘটনা পরম্পরায় বিবৃত করেননি। তিনি সময় নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। তাই ওপেনহাইমার-কে শেষ অবধি কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবেন, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।

অভিজিৎ চক্রবর্তী, কলকাতা-১১৩

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement