—ফাইল চিত্র।
শুভজিৎ বাগচীর ‘একেই কি বলে গণতন্ত্র’ (১৩-১০) লেখাটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রাসঙ্গিক। সংবাদপত্র আজ বিপন্ন। আরও খোলাখুলি বললে বলা যায়, শাসক দলের পক্ষে লিখলে সাংবাদিক পুরস্কার, শংসাপত্র, সম্মান সব পাবে, অথচ বিপক্ষে লিখলেই জুটবে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, হয়রানি, চোখরাঙানি, সব শেষে হত্যা। সাংবাদিকরাও মানুষ, তাঁদেরও পরিবার আছে। কতটা ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়, সেটা তাঁরাই জানেন। কাজেই খাতায়-কলমে সাংবাদিকদের যতই স্বাধীনতা থাকুক না কেন, সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন যদি তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে, এক জন সাংবাদিক কী ভাবে কাজ করবেন? আবার, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলে কী বিপদ হতে পারে, গৌরী লঙ্কেশ ও সুজাত বুখারির ঘটনা সেই প্রমাণ দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের গণমাধ্যম এখন কয়েকটি ব্যবসায়ী সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং তারা বেশির ভাগই সরকারের দিকে। এর বাইরে যে ক’টা প্রভাবমুক্ত সংবাদ সংস্থা আছে, তাদের নানা ভাবে হয়রান করা হচ্ছে।
অক্টোবরের গোড়ায় এক সঙ্গে ১২ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশির নামে তাদের বিব্রত করা হয়েছে। নিউজ়ক্লিক সংবাদ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে ও সংবাদপত্রের এক কর্মীকে সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে, সংস্থার সদর দফতরও বন্ধ করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের সন্ত্রাস দমন আইন ভারতে এখনও কার্যকর। তার বলে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করলেও সাজার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু জামিন পাওয়া, কিংবা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা খুব কঠিন। এই জন্য বিচারপতি এন ভি রমণা সাংবাদিকের এমন হয়রানিকে বলেছেন, বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি। এর পরে আসতে চলেছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-২০২৩’। এই আইন আরও কঠোর। কাজেই সাংবাদিকদের একমাত্র জোরের জায়গা, ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যকথন, আর কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে? গণতন্ত্র কি আর সুরক্ষিত থাকবে?
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
দমনই নীতি
শুভজিৎ বাগচীর প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এই চিঠি। ভারত নাকি গণতন্ত্রের পীঠস্থান। বর্তমান শাসকদের বিচারে এখানকার সংসদ হল গণতন্ত্রের মন্দির, আর এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। কয়েক দিন আগেও জি২০ সম্মেলনে বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল— ভারত হল গণতন্ত্রের জননীস্বরূপা, গণতন্ত্র এর শিরায় শিরায় প্রবাহিত। কিন্তু শিরার মধ্য দিয়ে এ কোন গণতন্ত্রের স্রোত? গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের উপর দিল্লি স্পেশাল সেলের পুলিশ বাহিনীর সাম্প্রতিক হানাদারি এই গণতন্ত্রের স্বরূপটিকে সুস্পষ্ট ভাবে চিনিয়ে দিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে শব্দচয়নের মুনশিয়ানা আর বাচনভঙ্গিও একে আড়াল করতে পারল না। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিউজ়ক্লিক-সহ আরও কয়েকটি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক ও কর্মীদের বাড়ি একযোগে হানা দিয়ে নিউজ়ক্লিক-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও এক কর্মীকে সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ-তে গ্রেফতার করে কেন্দ্র বুঝিয়ে দিল, কোন প্রকৃতির গণতন্ত্রকে এই ভারতের শিরায় শিরায় প্রবাহিত করতে তারা বদ্ধপরিকর।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কোনও রকম সমালোচনা বা বিরোধিতাকে সহ্য করে না। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, বেকার সমস্যার সমাধান, দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সর্বজনীন অধিকার, কালো টাকা উদ্ধার, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমানো, দুর্নীতি দমন প্রভৃতি প্রশ্নে সরকারের পাহাড়-প্রমাণ ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিভিন্ন আকারে ফেটে পড়ছে। নির্বাচনের মুখে সেই ক্ষোভকে আড়াল করতে সরকার মরিয়া। ইতিমধ্যেই মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠ বৃহৎ পুঁজির মালিকরা অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকে কিনে নিয়ে দেশ জুড়ে মোদী-বিরোধী হাওয়ার রাশ টেনে ধরেছে। বাকি যে সব সংবাদ সংস্থা, যারা মোদী সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপগুলিকে সামনে নিয়ে আসছে, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করছে, তাদের ‘সহবত শেখাতে’ এমন পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে সেই বিপরীত মেরুর সাংবাদিক ও সম্পাদকদের অনেকের চাকরি গিয়েছে, বহু সাংবাদিকের নামে মামলা ও জেল হয়েছে। সর্বশেষ ধরা হল প্রবীর পুরকায়স্থকে। এর বাইরে আছেন বহু সমাজকর্মী, যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মের সমালোচনা বা বিরোধিতা করার অপরাধে। এ সবের কারণেই সম্ভবত আন্তর্জাতিক মিডিয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে গত এক বছরে ১৫০ থেকে ১৬১-তে নেমে গিয়েছে।
আজ যে কোনও বিরোধিতাকে দমন করতে কেন্দ্র ইউএপিএ-কে ব্যবহার করছে। লক্ষণীয়, আইনটি কংগ্রেসের তৈরি। প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপির সব নেতা কথায় কথায় কংগ্রেসের নানা নীতির বিরোধিতা করেন। অথচ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বিক্ষোভ দমন করতে অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। কিন্তু জরুরি অবস্থা বহু মানুষকে হেনস্থা করতে সক্ষম হলেও বিরোধী চিন্তাভাবনা বা আওয়াজকে শেষ পর্যন্ত দমন করতে পারে না। যে কোনও স্বৈরাচারী শাসককে এটা বুঝতে হবে।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
প্রহসনই বটে
গ্রেগ চ্যাপেল। বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই নামটি ভোলার নয়। অবশ্যই তা ক্রিকেটীয় কারণে। কিন্তু এই চিঠি গ্রেগ চ্যাপেল সম্পর্কিত হলেও, সেই অর্থে ক্রিকেট সংক্রান্ত নয়। সম্প্রতি এই কাগজেই তাঁকে নিয়ে ‘আর্থিক সমস্যায় গুরু গ্রেগ, পাশে বন্ধুরা’ (২৭-১০) শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে জানতে পারলাম, গ্রেগ চ্যাপেল আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন এবং তাঁর বন্ধুরা তাঁকে সাহায্য করার জন্য টাকা তুলছেন। একটু অবাকই লাগল খবরটা পড়ে। গ্রেগ চ্যাপেল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন যে, তিনি আর্থিক ভাবে সমস্যায় আছেন। এখনও গরিব হয়ে যাননি। তবে আরামের জীবনও কাটাতে পারছেন না। বেশির ভাগ মানুষেরই একটা ধারণা থাকতে পারে যে, ক্রিকেট খেলেছেন বলে তাঁরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। সেটা সব সময় হয় না। এখনকার দিনের ক্রিকেটারেরা যে সুযোগ-সুবিধা পান, সেটা তাঁরা পান না।
এইটুকু পড়ার পর থেকেই একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাহায্য আমরা কাকে করি? জীবন ধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলোও যাঁরা মেটাতে পারেন না, তাঁদের। বৈষম্যের এই সমাজব্যবস্থায় যাঁরা তুলনামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন প্রান্তিক অভাবী, গরিব মানুষদের দিকে। আশ্চর্য লাগল, যে মানুষটা নিজেই স্বীকার করছেন, তিনি এখনও গরিব হয়ে যাননি, কেবল আরামের জীবন কাটাতে পারছেন না, সেই তাঁর দিকেই বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাহায্যের হাত। অনলাইনে অর্থ সাহায্যের উদ্যোগও করা হচ্ছে। যদিও আমার অনুমান, গ্রেগ চ্যাপেল চাইলেই তাঁর ক্রিকেট মেধা কাজে লাগিয়ে হয়ে উঠতে পারেন যে কোনও ক্রিকেট প্রশিক্ষণ শিবিরের উপদেষ্টা।
যে তৃতীয় বিশ্বের দেশে বসে এই খবর পড়ছি আমরা, সেখানে চার পাশে চোখ বোলালেই আমরা দেখতে পাই অনাহারী মানুষের শূন্য ভাতের থালা, ঋণের কারণে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়া অসহায় কৃষক, অভুক্ত শিশুর কান্না। আর সেই দেশে বসেই আমরা পড়ছি কাউকে দারিদ্র থেকে মুক্তি নয়, বরং আরাম এবং বিলাসের জীবন দেওয়ার জন্য তোলা হচ্ছে অর্থ। এই দারিদ্র জর্জরিত দেশের অসংখ্য মানুষের কাছে এই খবর যেন বিধাতার প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
ডা. অপূর্ব ঘোষ, কলকাতা-৩২