‘সম্রাটের ফোড়া কেটে অবাধ বাণিজ্য’ (রবিবাসরীয়, ২১-৩) নিবন্ধের সূত্রে এই চিঠি। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “বাদশাহ (ফারুখশিয়র) সেরে উঠে হ্যামিলটনের সুচিকিৎসার চূড়ান্ত ইনাম হিসেবেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে বসলেন বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলা বিহার ওড়িশায় নিঃশুল্ক ব্যবসা-বাণিজ্যের ছাড়পত্র...।” ছাড়পত্র কিন্তু অত সহজে পাওয়া যায়নি। তা বাদশাহের দেওয়া ইনামও ছিল না। বাদশাহি ফরমান আদায়ের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সাহেবদের। ১৭১৬-র জানুয়ারি মাসে কোম্পানির দূত বাদশাহের কাছে আর্জি পেশ করার সুযোগ পান, কিন্তু সরাসরি নয়। তা-ও আর্জিটি তিন বার সংশোধন করতে হয়েছিল কয়েকটা বিষয়ে আপত্তি ওঠায়। শেষ পর্যন্ত মোগল দরবার থেকে পাওয়া গেল হুকুমনামা। কিন্তু সেটা ছিল বাদশাহের স্বাক্ষরিত ফরমানের পরিবর্তে উজিরের স্বাক্ষরযুক্ত হসব্-উল-হুকম্।
সময় গড়িয়ে ১৭১৬-র এপ্রিল এল। বাদশাহ লাহৌর অভিযান করলেন শিখদের দমন করতে। সাহেব দূতরা তাঁর অনুবর্তী হলেন। সেই সময় ঘটনাচক্রে তাঁরা জানতে পারলেন, কাজ হাসিল করা যেতে পারে হারেমের জনৈক খোজাকে উৎকোচে বশ করতে পারলে। সামান্য খোজার এলেম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তবু তা-ই করলেন তাঁরা। খোজা একরারনামা দিল, সাহেবদের পছন্দমতো ফরমান সে জোগাড় করে দেবে। তাঁদের অবাক করে বাদশাহের স্বাক্ষরিত ও সিলমোহর বসানো ফরমান উজির মারফত তাঁদের হাতে তুলেও দিল কয়েক দিনের মধ্যে।
কোম্পানির প্রতিনিধিরা রহস্যটা জানতে পেরেছিলেন পরে। ১৬৮৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে পাঠানো এক নৌবহর হামলা করেছিল মোগলদের জাহাজে। ফরমান প্রদানের পূর্বে মোগল কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধের ফলে কোম্পানি বাধ্য হয় সুরাতের কুঠি তুলে নিতে। গুজরাতের নবাব শঙ্কিত হয়ে উঠলেন পূর্বের ইংরেজ নৌবাহিনীর হামলার কথা স্মরণ করে। যে খোজাকে উৎকোচ দেওয়া হয়েছিল, সে ছিল নবাবের ঘনিষ্ঠ। নবাব তাকে জানালেন, তাঁর আশঙ্কার কথা উজিরের কানে তুলে দিতে, আর পরামর্শ দিলেন ইংরেজদের আর্জি অনুমোদন করাই শ্রেয়। এই পরামর্শ পেয়ে উজির তাঁর কর্তব্যটি করেন। ইংরেজ দূত বাদশাহি ফরমান নিয়ে বিদায় নেন ১৭১৭ সালের জুলাইয়ে। এই তথ্যের সূত্র: ১. হিস্ট্রি অব দ্য মিলিটারি ট্রানজ়্যাকশনস অব দ্য ব্রিটিশ নেশন ইন ইন্দোস্তান (দ্বিতীয় খণ্ড), রবার্ট অর্মে, ২. দ্য আর্লি অ্যানালস অব দি ইংলিশ ইন বেঙ্গল (দ্বিতীয় খণ্ড), সি আর উইলসন।
নিখিল সুর, কলকাতা-৩৪
সারহেদ
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সম্রাটের ফোড়া কেটে অবাধ বাণিজ্য’ প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। প্রবন্ধে আর্মেনিয়ান ‘খোজা সারহেদ’কে ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের এক দোভাষী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁর মাধ্যমে প্রতিনিধি দলের প্রধান ক্যাপ্টেন জন সারমন মোগল দরবারের গোপন খবর জানতে পারতেন। কিন্তু খোজা সারহেদ, পুরো নাম খোজা ইসরায়েল সারহেদ, এক সামান্য দোভাষী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য। জন সারমনের পরেই ছিল তাঁর স্থান।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি হওয়ার আগে, মোগল আমল থেকেই পশ্চিম এশিয়ার ছোট দেশ আর্মেনিয়া থেকে ভারতে শুরু হয় বণিকদের আনাগোনা। স্থলপথে আফগানিস্তান ও পারস্য পেরিয়ে তাঁরা ভারতে বসতি স্থাপন করেছিলেন সুরাত, আগরা, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ— সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রে। সুতানুটি ও কলকাতাতে যখন তাঁরা বসবাস শুরু করেন, কলকাতা শহর তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। কলকাতার দানশীল ব্যবসায়ী সুকিয়া, যাঁর নামে ‘সুকিয়া স্ট্রিট’, ছিলেন আর্মেনিয়ান। আর্মানি গির্জার প্রাঙ্গণে তাঁর স্ত্রীর কবর রয়েছে। মৃত্যুর তারিখ ২১ জুলাই, ১৬৩০, অর্থাৎ জোব চার্নকের সুতানুটির ঘাটে ঐতিহাসিক পদার্পণের ষাট বছর আগে। কিন্তু শুধু কলকাতার অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠী বলেই নয়, আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পলাশির যুদ্ধ-পূর্ববর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিবৃত্ত।
১৬৯৬-৯৭ সাল। চার্নক মারা গিয়েছেন প্রায় চার বছর আগে। সেই সময় স্থানীয় শাসক শোভা সিংহের বিদ্রোহ দমন করার জন্য ঔরঙ্গজেবের প্রতিনিধি হয়ে বাংলায় এলেন জবরদস্ত খান। ব্রিটিশরা ঠিক করল, ব্যবসার সুবিধার আর্জি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। তার জন্য দরকার স্থানীয় প্রভাবশালী কোনও ব্যক্তির সাহায্য। ব্রিটিশরা শরণাপন্ন হল খোজা ইসরায়েল সারহেদের, যিনি তখনই হুগলির প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, এবং সুরাতের বিখ্যাত ধনী ফানুস কালান্দরের ভাইপো। ১৬৯৭ সালের জুন-অগস্টে যখন এই নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন বাংলার সুবেদার হয়ে এলেন আজিম-উস-সান, স্বয়ং আলমগীরের ভাইপো। তাঁর কাছে আর্জি জানানোর দায়িত্ব নিলেন সারহেদ। আজিম-উস-সানেরই পুত্র ফারুখশিয়র। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪। পিতার আগেই পুত্রের মন জয় করে ফেললেন সারহেদ। কী ভাবে? বিদেশি খেলনার প্রতি তীব্র মোহ। লেখকের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, পরিণত বয়সেও যে নেশা ফারুখশিয়রকে ছাড়েনি। পুত্রকে বিদেশি খেলনা উপঢৌকন দিয়ে পিতার মন জয় করতেও সারহেদের বেশি সময় লাগল না। পিতাপুত্রকে বশ করে সারহেদ আদায় করে ফেললেন কলকাতা, সুতানুটি আর গোবিন্দপুরের জমিদারি স্বত্ব।
১০ নভেম্বর, ১৬৯৮ সালে ১৩০০ টাকায় সেই জমিদারি কিনে নিল ব্রিটিশরা, যা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম ধাপ। আর দ্বিতীয় ধাপ হল, প্রবন্ধে উল্লিখিত এপ্রিল, ১৭১৭-য় ফারুখশিয়রের ফরমান। ব্রিটিশ বাণিজ্যে বাংলার নবাব জ়াফর খানের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর বাহানায় গঠিত দিল্লিগামী দলে সারহেদকে অন্তর্ভুক্ত করা হল। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা তাঁদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ফারুখশিয়রের ফরমানের জন্য হ্যামিলটনকেই একক কৃতিত্ব দিয়ে গিয়েছেন, যিনি প্রতিনিধি দলে ঠাঁই পান ঘটনাচক্রে। অন্য দিকে, এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পিছনে কি সারহেদের কোনও ভূমিকাই ছিল না? ঔপনিবেশিক শাসক ও ইতিহাসবিদদের কল্যাণে খোজা সারহেদ ইতিহাসে পরিণত হয়েছেন এক জন সামান্য দোভাষীতে।
আর্মেনিয়ানদের উপকারের প্রতিদান হিসেবে ব্রিটিশদের ‘কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন’-এর উদাহরণ অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের পরে কলকাতা থেকে উদ্বাস্তু ব্রিটিশ নরনারীরা আশ্রয় নেন ফলতায়। সিরাজ ফলতায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন। তখন গোপনে শত শত নরনারীকে খাদ্য জুগিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন আর এক আর্মেনিয়ান, খোজা পেট্রাস আরাতুন। পলাশির ষড়যন্ত্রের তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ শরিক। অথচ মীরকাশিমের পরাজয়ের পরে সেই পেট্রাসকেই ব্রিটিশরা আখ্যা দেয় ‘নবাবের গুপ্তচর’ বলে। তাঁর শাস্তির দাবি করা হয়। ক্ষোভে, অপমানে পেট্রাস এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন ব্রিটেনে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছে। কোম্পানি সে চিঠির উত্তর দেওয়া দূরে থাক, ব্রিটিশ ইতিহাসে তার উল্লেখমাত্র রাখেনি। বহু দিন পর এক আর্মেনিয়ান গবেষক সেই চিঠির খোঁজ পান।
এই হল সাম্রাজ্যবাদীদের চিরন্তন ইতিকথা। যে আশ্রয়গুলো জড়িয়ে তারা হয়ে ওঠে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্যবিধাতা, প্রয়োজন ফুরোলে তাদের ইতিহাসের আবর্জনায় ছুড়ে ফেলতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না। এই তথ্যগুলির সূত্র: কলকাতা, শ্রীপান্থ, আনন্দ পাবলিশার্স।
শান্তনু ঘোষ, কলকাতা-৫৯