West Bengal Assembly Election 2021

সম্পাদক সমীপেষু: দেশের শত্রু কারা?

বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যগুলি সোনার রাজ্য হয়ে গিয়েছে, এ কথা অতি বড় সমর্থকও বলতে পারবেন না। হাথরস থেকে কৃষি আইন, নোটবন্দি থেকে রাফাল কেলেঙ্কারি— লেগেই আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪০
Share:

অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘এ বার তবে বন্দুকের মুখে ভোট?’(১২-৪) নিবন্ধের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, সিআরপিএফ জওয়ানরা দেশের শত্রু নন। তাঁরা নেতাদের ভয় পেয়ে টেবিলের তলায় লুকান না। বরং মাওবাদী-উপদ্রুত এলাকার মতো বিপজ্জনক জায়গায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বুক চিতিয়ে লড়াই করে প্রাণ দেন। নির্বাচনের ভারপ্রাপ্ত কর্মীরা নিরাপদে ভোট করে ঘরে ফিরতে পারেন। ইভিএম লুট হয় না। বুথ জ্যাম হয় না। রাতের অন্ধকারে দাদা-দিদিদের অঙ্গুলিহেলনে ভোট হয়ে যায় না। নইলে বিধানসভা ভোটও পঞ্চায়েত ভোটের মতো প্রহসনে পরিণত হত। শীতলখুচির ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক। কিন্তু এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি এবং মৃত্যুর জন্য দায়ী শুধুই কি কেন্দ্রীয় সরকার? এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও কি দায় এড়াতে পারেন?

Advertisement

প্রকাশ্য জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে সিআরপিএফ জওয়ানদের হাতা-খুন্তি নিয়ে ঘিরে ধরে অন্যদের ভোট দিয়ে আসার মতো উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেছেন, তাতে কেন তিনি অভিযুক্ত হবেন না? দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, সায়ন্তন বসুর মতো বিজেপি নেতারাও একই দোষে দোষী। তাঁদের লাগামছাড়া উস্কানিমূলক মন্তব্যে আগুনে ঘৃতাহুতি পড়েছে। লেখক উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, “ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় যাদের এই রূপ, তারা চেয়ারে বসলে তো হাতে মাথা কাটবে।” সহমত পোষণ করছি। বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যগুলি সোনার রাজ্য হয়ে গিয়েছে, এ কথা অতি বড় সমর্থকও বলতে পারবেন না। হাথরস থেকে কৃষি আইন, নোটবন্দি থেকে রাফাল কেলেঙ্কারি— লেগেই আছে।

দুর্ভাগ্য আমাদের। দুর্ভাগ্য বলেই এ দেশের বহু মানুষকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ফাঁসানো হয়। দেওয়া হয় জঙ্গি তকমা। সেখানে কোনও বিচার চলে না। তবে কী হবে আর কী হবে না, সে কথা কি অগ্রিম কেউ বলতে পারে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার আগে কেউ কি ভেবেছিল, বছরের পর বছর স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা বন্ধ থাকবে? অনুদান, ভাতা আর পাইয়ে-দেওয়া রাজনীতির কৌশলে কর্মক্ষেত্রগুলিকে সঙ্কুচিত করেদেওয়া হবে, কিংবা মাওবাদী তকমা দিয়ে নিরীহ চাষিকে জেলের ঘানি টানানো হবে?

Advertisement

বিশ্বরূপ দাস

শ্রীপল্লি, পূর্ব বর্ধমান

দানবের বিরুদ্ধে

শীতলখুচি নিয়ে দিলীপ ঘোষের হুমকি, তাকে ছাপিয়ে উঠতে চেয়ে রাহুল সিংহের হুঙ্কার এবং জয় গোস্বামীর চিঠির (‘হত্যার হুমকি!’, ১৪-৪) সূত্রে যে কথাগুলি মনে এল— ঘোষ এবং সিংহ উভয়েই এমত উচ্চারণ করেছেন দিল্লিতে নিজেদের নম্বর বাড়াতে এবং এ-কথা জেনেবুঝেই যে, নির্বাচন কমিশন কৈফিয়ত তলব করবে, এমনকি ২৪-৪৮ ঘণ্টার জন্য কারও প্রচার বন্ধ রাখতে নির্দেশ জারিও করতে পারে। যে হেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রচার বন্ধ রাখার ফরমান জারি করাতে কমিশনের একপেশে ভাব ফুটে উঠেছিল, এমনটি হলেই দেখানো যাবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ। তা যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়েনি, ঘোষ এবং সিংহ মশাইদেরও জামাই-আদর করেনি। কমিশনের ভাবমূর্তিতে পালিশ লাগবে। কিন্তু যা চট করে কেউ ভাববে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচার আটকানো, আর দিলীপ-রাহুলের প্রচার বন্ধ রাখা এক জিনিস নয়। মমতার প্রচার আটকালে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হইহই করে মাটি কাঁপিয়ে বক্তৃতা করতে পারবেন বিধাননগরে। এবং সেই সময়টুকুতে তাঁর বিরোধী কোনও কণ্ঠস্বর সম্প্রচারিত হবে না কোনও দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে। শ্রীযুক্ত শাহ একাই শাসন করবেন সংবাদমাধ্যম।

জয় গোস্বামীর কথার পরিপূরক হিসেবে বলি, আমাদের মতো বরিষ্ঠ নাগরিক, যাঁদের সংসার চলে স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের টাকায়, যার পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কমেছে ৪০ শতাংশ, পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে এর থেকে অনেক দ্রুত হারে, শীতলখুচির গুলি যদি তাঁদের অন্তর বিদ্ধ করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সেই আততায়ীর বিরুদ্ধে ভোট দিতে প্ররোচিত না করে, বুঝতে হবে আমরা সব মোমের পুতুল। মানুষ নয়, মানুষের প্রতিরূপমাত্র। অতএব ভোটের দিন স্থির প্রতিজ্ঞা নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাব। দানবদের বিরুদ্ধে যদি ল্যাম্পপোস্টও দাঁড়ায়, সেই মূক বস্তুটির পক্ষেই বোতাম টিপব।

অশোক মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-৯১

বিদ্বেষের প্রচার

দীপেশ চক্রবর্তী (‘বিদ্বেষবিষ কি অবিনাশী’, ১৩-৪) প্রশ্ন করেছেন, কাজী আবদুল ওদুদ, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের রচনা কি আমরা পড়াই? কিন্তু আমরা তো নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সৈয়দ মুজতবা আলি, জসীমউদ্দিন, বেগম রোকেয়া, শামসুর রহমান, এস ওয়াজেদ আলি পড়েছি। তা হলে কেন এত বিদ্বেষ? এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম কেন?

আসলে, দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় বাঙালি মুসলমান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা চলে গেলেন। যেমন— আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবুল ফজল, রাজিয়া খান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ। এঁরা সঙ্গে নিয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারার গুরুত্বপূর্ণ এক উত্তরাধিকার। ফলে একটা ফাঁক তৈরি হয়ে গেল। তাঁদের উপন্যাস এ-পার বাংলায় অনাবিষ্কৃত রয়ে গেল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই উত্তরাধিকারকে সম্মান দিয়ে ফাঁক পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো সেই প্রভাবেই অনেক পরে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলি, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস পড়েছি। দু’দশক আগেও এত বিদ্বেষবিষ ছড়ায়নি। আসলে গত দু’দশকে বিষাক্ত করা হয়েছে সমকালীন রাজনীতিকে।

হ্যাঁ, হিন্দু বাঙালি এ-পার বাংলায় মুসলিম লেখকের সাহিত্য কম পড়েছেন, ইদ উৎসবে দূরে থেকেছেন। কিন্তু বাংলায় এত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়নি। ২০১১-র নির্বাচন থেকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আত্মঘাতী হতে শুরু করল। বাংলার বুদ্ধিজীবীরা সব দেখেছেন। উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা, চাটুকারিতার মতো নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গিয়েছে। বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত। শাসক দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা নানা সুবিধা উপভোগ করেছেন, এখনও করছেন। সমকালীন সাহিত্যে এর প্রতিবাদ স্পষ্ট হয়নি, যা বামপন্থীদের সমালোচনায় দেখা যায়।

এ সব এড়িয়ে যাওয়া যায় না । বীরভূমে শাসক দলের জনৈক নেতা যখন ভয়ঙ্কর শব্দ-শাসানি করেন, তখন মিডিয়া তা নিয়ে বিস্তর প্রচার করে তাঁকেই উৎসাহিত করে গিয়েছে। জনৈক বিজেপি নেতা যখন প্রত্যুত্তরে শাসানি দিলেন, তখন মিডিয়া নারদ-নারদ ভঙ্গিতে তার বিস্তর প্রচার করল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাজনীতির বিতর্ককে কলহে নামালেন। দলনেত্রী যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য উস্কানিমূলক, আদর্শ আচরণবিধি বা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন লঙ্ঘনকারী মনে করে নির্বাচন কমিশন প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর তাই লজ্জার শেষ নেই বিশ্ববাসীর কাছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এখন কি মিডিয়ার ঘুম ভাঙবে? মত প্রকাশের অধিকার তো নিরঙ্কুশ হতে পারে না। খারাপ কথা বাস্তব হলেও মিডিয়ার প্রকাশ করা উচিত নয়। বীভৎস মৃত্যু বা ধর্ষিতার ছবি, নাম এখন আর প্রকাশ করা হয় না মিডিয়ায়। তেমনই রাজনৈতিক নেতানেত্রীর বক্তব্যও সম্পাদনা করা দরকার। গালাগালের প্রত্যুত্তর না-করলে যেমন সে গাল ফিরে যায় বক্তার কাছে, তেমনই বিপজ্জনক খারাপ কথাও ফিরে যাবে বক্তার কাছে। কেউ বলতে পারেন, অনেক সময় ছাপা সংবাদ আইনি সাক্ষ্য হয়। কিন্তু তার আগেই যে দাঙ্গা, খুনোখুনি, মৃত্যু হয়, তার ক্ষতিপূরণ হয় না। ২০২১-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত প্রাণ চলে গেল, তা কখনও ফিরে আসবে না। সে কারণেই এই সব বিতর্কিত মন্তব্য প্রকাশ প্রচারমাধ্যমে বন্ধ হওয়া দরকার। ফের ফিরে পড়া যাক অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের ইতিহাস, সাহিত্য।

শুভ্রাংশু কুমার রায়

চন্দননগর, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement