—ফাইল চিত্র।
সুগত ত্রিপাঠীর ‘পুজো, না অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ (২৩-১০) লেখাটিতে যেন আমার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে পেলাম। আমাদের মফস্সল পাড়ায় শিক্ষাঙ্গন থেকে বরাবর দূরে-থাকা, দলের ঝান্ডাধারী, বিশেষ উপায়ে চাকরিপ্রাপ্ত, কিংবা বিবিধ আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত কতিপয় যুবকের দাপট দেখা যায়। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বর্তমানে দুর্গাপুজোরও সার্বিক নিয়ন্ত্রক এরা। রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও পরিচয়ে তারা শক্তিশালীও বটে। পুজোর বাহ্যিক আড়ম্বরে নাকি এলাকার কৌলীন্য বৃদ্ধি হয়!
তাদের এই মতবাদের জেরে আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে পাড়ার মানুষদের উপর ধার্য চাঁদার পরিমাণ প্রতি বছর লাফিয়ে বাড়ে। দু’হাজার টাকা চাঁদা দেওয়ার পরেও (বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন সত্ত্বেও) আমাকে শুনতে হয়, আমার জন্য নাকি পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা ধার্য করা ছিল! এখন পাড়ার পুজোর মানে দাঁড়িয়েছে, মহালয়ার পরের দিন থেকেই বাজিয়ে চলা গানের একঘেয়েমি সহ্য করে যাওয়া, মাসাধিক কাল রাস্তা অবরুদ্ধ থাকা, আলোকসজ্জার বাহুল্যে বিদ্যুতের বিপুল অপচয়, পুজোর দুর্বোধ্য ‘থিম’ বুঝতে না পারা, এমন আরও কত কী।
এ দিকে আবার দুর্গাপ্রতিমাকে প্যান্ডেলে এসে দু’-তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়, যত ক্ষণ না মোটরসাইকেল বাহিনী-পরিবৃত কোনও রাজনৈতিক পদাধিকারী এসে ফিতে কেটে প্রতিমা দর্শনের ছাড়পত্র দেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন আয়োজিত ‘কার্নিভাল’— কলকাতার অনুকরণে আলোকসজ্জিত গাড়ির মিছিলে অংশগ্রহণ। এ সবই নাকি এলাকার উন্নয়নের পরিচয়জ্ঞাপক! মেনে নিলে ভাল, না মানলে সম্বৎসর অঘোষিত অসহযোগের মুখে পড়তে হবে। ফলে অরাজনৈতিক মানুষকে সেই বিড়ম্বনা সইতে হবে। আড়ম্বরের উৎপীড়নে পাড়ার প্যান্ডেল থেকে ‘পুজোর গন্ধ’ আর নাকে এসে পৌঁছয় না!
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
ভক্তিহীন
‘পুজো, না অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে বলা দরকার, শহর-মফস্সল নির্বিশেষে পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তার প্রতি এখনই দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। পুজো হল মানুষের ভক্তির প্রকাশ, ভক্তিটুকু বিসর্জন দিয়ে বাহ্যিক আড়ম্বরকে প্রাধান্য দেওয়াকে পুজো বলা চলে না। দুর্গাপুজোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের আবেগ, ভাললাগা-ভালবাসা, রুটিরুজি জড়িয়ে থাকে। অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ এই সময়ে কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায় বুক বাঁধেন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতির একটা প্রগাঢ় সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, নিজেকে ‘সেরার সেরা’ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমরা পুজোর প্রকৃত মর্মার্থকে উপেক্ষা করছি। বৃহত্তর জনস্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে কোথাও কোথাও পুজো কমিটিগুলির তরফ থেকে অতিরিক্ত চাঁদা আদায়, রাস্তাঘাটে যানজট সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মদত দেওয়া, এবং শব্দ ও আতশবাজির তাণ্ডব চলে, যার ফলস্বরূপ পরিবেশ দূষণ আরও তীব্র হয়। অথচ, প্রতি বছর আমরা বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার অঙ্গীকার করছি। তাই বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে দুর্গাপুজোকে বৈভব প্রদর্শনের মঞ্চ না বানানোই কাম্য।
সুমন কল্যাণ রায়, কলকাতা-৮৪
বিপদের ভয়
‘পুজো, না অসুস্থ প্রতিযোগিতা’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার পুজোর প্রতিযোগিতার আড়ালে যে সব অসুখ চিহ্নিত করেছেন, তার ভুক্তভোগী পুজোর উদ্যোক্তারাও হতে পারেন। বিপদ কারও ক্ষেত্রেই বলে-কয়ে আসে না। প্যান্ডেল এবং পুজোর ভিড়ে দমকল বা অ্যাম্বুল্যান্সের যাত্রাপথ মসৃণ হওয়া সম্ভব নয়। বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটলে কী যে হতে পারে, ভেবে আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়।
সরকারের সৌজন্যে পাঁচ দিনের দুর্গাপুজোর ভোগান্তি বেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শহর জুড়ে বিশালাকার সারি সারি বিজ্ঞাপন এবং আওয়াজের দাপটে রাস্তার ধারেকাছে বাড়ির বাসিন্দাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আড়ম্বরের আতিশয্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরাও হয়তো প্রবন্ধকারের মতোই আত্মগোপনের কোনও নিরাপদ আস্তানা খোঁজেন। পুজোকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির চাকা ঘোরা সর্বকালেই ছিল। তার জন্য পুজোকে দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখা দরকার।
ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭
মুখ ঢেকে যায়
পুজো আসে, পুজো যায়। তারই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বহরও বাড়তে থাকে। বড় পুজোগুলোর পার্শ্ববর্তী রাস্তার দু’ধারে বাঁশের কাঠামোতে বড় বড় হোর্ডিং টাঙানো হয়। চেনা জায়গা অচেনা লাগে। রাস্তার ধারে থাকা অফিস, দোকানের নাম ঢেকে যায়। দোতলা, তিনতলা বাড়ির বারান্দায় বসে কিংবা ঘর থেকে বয়স্ক মানুষ ও বাচ্চারা যে রাস্তায় জনজোয়ার দেখবে, সে উপায়টুকুও থাকে না। এ এক দমবন্ধ পরিস্থিতি। এতে দৃশ্যদূষণ সীমা ছাড়ায়। ফুটপাত থেকে রাস্তার সিগন্যাল দেখতেও অসুবিধে হয়। হোর্ডিং লাগানোর জন্য যে ভাবে নির্বিচারে গাছের ডাল কাটা হয়, তাতে গাছের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
শুনেছি, এই হোর্ডিংগুলি খুলে নাকি পুনর্ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখি বেশ কিছু হোর্ডিং যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। অনেক সময় পশুপাখিরা খাবার মনে করে তা চিবিয়েও থাকে। এই হোর্ডিং তৈরিতে যে রাসায়নিকগুলি ব্যবহার করা হয়, তা ফুসফুসকে ক্ষতিগ্ৰস্ত করে। এ ছাড়াও ক্যানসার ও কিডনির সমস্যাকে প্রভাবিত করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে তা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেরও ক্ষতি সাধন করে। এগুলি পোড়ালে বিপজ্জনক গ্যাস নির্গত হয়ে পরিবেশকে দূষিত করে। এই ক্ষেত্রে বাণিজ্য শেষ কথা হতে পারে না। বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলিকে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকেও মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসনকেও সজাগ থাকতে হবে।
সুদীপ্ত সরকার, কলকাতা-১০৩
কাদের পুজো?
‘আতঙ্কের উৎসব’ (১৯-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয় মনোগ্রাহী ও সময়োচিত। প্রশ্ন জাগে, পুজো উদ্যোক্তারা কি মনুষ্যসমাজের বাইরের? না কি অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন? তাঁদের মনে এই ন্যূনতম প্রশ্নটুকু জাগে না যে, এ পুজো-পার্বণ কাদের জন্য? তা কি সাধারণ মানুষের উৎসব নয়? মনে হয় যেন কতিপয় দুষ্কৃতী, ‘মস্তান’ গোত্রের লোকের জন্য দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে উৎসব বসাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। পুজোর আগে থেকেই ম্যারাপ বাঁধা আর বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স, নানা সামগ্রীতে চার দিক একাকার হয়ে যায়! বাঁশ, লোহার কাঠামো, কাঠ, দড়ি, জাল, চট, তাঁবু প্রভৃতি নিয়ে যে ভাবে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়, তা সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। পাড়ার মানুষ ভয়ে মরেন। একটা অ্যাম্বুল্যান্সও যাতায়াত করতে পারবে না, মণ্ডপগুলি এমনই সঙ্কীর্ণ করে দেয় রাস্তাগুলিকে। ঘরবাড়ি, অফিসের জানলা-দরজা আটকে দেয় বিজ্ঞাপনের ফেস্টুন৷
সেই সঙ্গে মাইকের প্রবল শব্দ, ডিজে বক্সের বাড়াবাড়িতে কে কাকে কতখানি টেক্কা দিতে পারবে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকারি অনুদান পাওয়া সত্ত্বেও চাঁদার আতঙ্ক গৃহস্থের যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্তব্য শুধু খাতায় কলমেই লেখা থাকবে কি না, এই প্রশ্ন মাথা কুটে মরে। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই উৎসবের তাণ্ডব সমানে চলেছে। ব্যতিক্রম দু’-একটি আছে বটে, কিন্তু বাড়াবাড়ির তালিকার কাছে তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু!
উৎসবের আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রশাসন যদি কঠোর ভাবে আইনের প্রয়োগ না করে, তা হলে মানুষের মন থেকে উৎসবের আতঙ্ক কিছুতেই দূর হবে না৷
বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান