—প্রতীকী ছবি।
ভাস্কর মজুমদারের ‘বার্ধক্যের কোনও দেশ নেই’ (১৩-১০) প্রবন্ধটির উত্তরে তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলছি যে, বার্ধক্য শুধু কোনও দেশের নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই সমস্যা যেমন ভারতের, তেমন চিন, জাপানেও। চিনের সমস্যা এতটাই তীব্র যে, সেখানে সরকার যুবক-যুবতীদের অধিক সন্তান উৎপাদনের জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। জাপান সরকারও তাদের এই সমস্যা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত।
ভাস্করবাবু খুব সঙ্গত কারণেই বলেছেন, বৃদ্ধরা সংসারে অবহেলিত। শুধু সংসার নয়, দেশের শাসককুলও বৃদ্ধদের অবহেলার চোখে দেখে। এ দেশে ষাট বছর হলেই কর্মক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাজের জায়গা থেকে অবসর নিতে হয়। সরকারি সংস্থা বা সংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে অবসরকালীন সুবিধা থাকলেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে তেমন কোনও সুবিধা নেই। আমি নিজে এই ব্যবস্থার শিকার। লেদার টেকনোলজিস্ট হিসাবে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নাগাড়ে চব্বিশ বছর কাটিয়েছি। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে কানাকড়িও পাইনি সংস্থার কাছে। সংগঠিত ক্ষেত্রের তুলনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমার মতোই হাল হয়তো আরও বহু মানুষের। অথচ, এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য তেমন কোনও সামাজিক প্রকল্প নেই সরকারের। নেই স্বাস্থ্যবিমার সুযোগও। আর নিজে থেকে স্বাস্থ্যবিমা করালে আঠারো শতাংশ জিএসটি দিতে হয় সরকারকে। সেখানে নেই কোনও ধরনের ছাড়।
কোভিডের আগে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য রেলের ভাড়ায় যে ছাড় মিলত, তা-ও এখন মেলে না। কেবল ব্যাঙ্ক আমানতে যৎসামান্য বেশি সুদ পাওয়া যায়। সরকার বিলক্ষণ জানে, সমাজের প্রবীণ নাগরিকদের বয়স বাড়লে আয় কমে গেলেও অন্য নাগরিকদের মতোই তাঁদের জীবন নির্বাহের খরচ আছে। সেই সঙ্গে চিকিৎসা খরচ বাড়ে। কিন্তু সরকারের কোনও তাগিদ নেই আমাদের মতো মানুষদের জন্য। এই সব মানুষ এত দিন যে তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দেশের সেবা করেছেন, তাঁদের কি সমাজ বা দেশ, কেউই দেখবে না?
তারক সাহা, হিন্দমোটর, হুগলি
প্রাপ্য সম্মান
প্রবন্ধকার ভাস্কর মজুমদার সমাজের একটি গুরুতর ঘাটতির দিকে আঙুল তুলেছেন। বলেছেন, আমরা বয়স্ক মানুষদের কাজ থেকে অবসরে সরানোর অছিলায় ঠেলে দিতে চাই জীবন থেকে দূরে। বাস্তবিক সমাজ জুড়ে শ্রমশক্তির যে বিপুল অপচয় চার দিকে ঘটে চলেছে, তারই একটি রূপ যেন বয়স্ক মানুষদের এ ভাবে জীবন থেকেই দূরে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা। সমাজের সবচেয়ে সক্ষম যে যুবসমাজ, তাদের বিরাট একটা অংশই আজ কর্মহীন হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। যুবসমাজই যখন সংসারে, সমাজে মূল্যহীন, সেখানে বয়স্ক মানুষদের অবস্থা যে আরও করুণ হয়ে পড়বে, তাতে আর সন্দেহ কী! অথচ, আমরা ভেবে দেখি না যে, এর ফলে বয়স্ক মানুষগুলির বিপুল অভিজ্ঞতার ভান্ডার অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে, যা ব্যবহার করলে সমাজই লাভবান হত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন মানুষের আয়ু যেমন দীর্ঘায়িত হয়েছে, তেমনই কর্মক্ষমতাও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। অথচ, সরকারি নীতিতে এমন কর্মক্ষম মানুষদের জীবনের মাঝপথেই অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। এক জন শিক্ষক, বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ বা অন্য বহু পেশার মানুষ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যে সমৃদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হন, তা অবসরের পরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। আর, সমাজও বঞ্চিত হয় সেই সমৃদ্ধ জ্ঞানের কার্যকারিতা থেকে।
দীর্ঘ দিন ধরে সমাজে বড়দের সম্মান করার যে রীতি গড়ে উঠেছে, তা তো আসলে তাঁদের সঞ্চিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার কারণেই। আজ আমাদের সমাজমনস্কতা ক্ষয়ে গিয়ে যত আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি, ততই হারাচ্ছি মূল্যবোধ। আর ততই বয়স্কদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে ভুলে যাচ্ছি। এও ভুলছি, আজ আমরা যেখানে পৌঁছেছি, তা সম্ভব হয়েছে বাবা-মা থেকে শুরু করে শিক্ষকদের মতো অসংখ্য প্রবীণ মানুষের পরিশ্রম এবং অবদানের ফলেই। আমরাও তো এক দিন বয়স্ক হব। আজ যে আচরণ আমরা বয়স্কদের প্রতি করছি, সেই একই আচরণ ভবিষ্যতে আমাদের জন্যেও হয়তো অপেক্ষা করছে। প্রবীণদের উপযুক্ত সম্মান দিলে তবেই সমাজ বাঁচবে, সঙ্গে পৃথিবীটাও।
সমর মিত্র, কলকাতা-১৩
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
এক জন সত্তরোর্ধ হয়েও ভাস্কর মজুমদারের প্রবন্ধটির যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। তথ্য এবং কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে লেখক তাঁর বার্ধক্যের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চারিত্রিক বিভিন্নতাকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন। পৃথিবীটাকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য— এ ভাবে ভাগ করলে কতকগুলি বিষয় দৃষ্টিগোচরে অবশ্যই আসবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে আর্থসামাজিক কারণে প্রবীণদের একই পরিবারের সদস্য করে রাখার চল নেই। তবে তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারের স্কন্ধে চাপানো না হলেও ওল্ড এজ হোমের ব্যবস্থা সরকারি তত্ত্বাবধানেই হয়ে থাকে, অবশ্যই তাঁদের সঞ্চিত অর্থের বিনিময়ে। তা ছাড়া, বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশ ব্যয় হয় চিকিৎসা খাতে। পশ্চিমের দেশগুলিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাটি বিমা-নির্ভর, যা বাধ্যতামূলক এবং প্রিমিয়ামের বিনিময়ে চিকিৎসা খাতে খরচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত হয়। চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবনের শেষ চলচ্চিত্রে দেখিয়েছিলেন— আমেরিকার রাস্তায় বয়স্ক মানুষরা ‘উই আর হোমলেস’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে আছেন। মাথার উপর ছাদের বেজায় অভাব। প্রশংসনীয় হল এই যে, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে প্রথম জীবন থেকেই স্বাবলম্বী হতে হয় পরনির্ভরশীলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে।
জীবন আর সিনেমাকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। প্রাচ্যের অনেক পরিবারেই প্রবীণরা অবহেলিত নন। এঁদের মধ্যে অনেকেই সম-মনোভাবাপন্নদের সঙ্গে আড্ডা, বই পড়া, লেখালিখি, ইনডোর গেমস-এ সুন্দর সময় কাটান। তবে যেখানে পুত্র-কন্যারা বিদেশবাসী এবং একাকী পিতা বা মাতা চলৎশক্তিরহিত, সেখানে আয়াদের উপর নির্ভর করতেই হয়। আসলে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আয়া সেন্টারগুলি প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে ইদানীং আমাদের রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসন বয়স্কদের খোঁজখবর নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে কিছু সংস্থার সহযোগিতায়।
ভারতের বয়স্কদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের প্রবন্ধকারের এই যুক্তি খুব যুক্তিগ্রাহ্য নয়। এ ভাবে এই দেশকে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ‘এজইজ়ম’ তথা জেনারেশন গ্যাপ একটি সামাজিক ভ্রান্তি। শেষ ছত্রগুলিতে বৃদ্ধাবাসের ভাবনাটি যথার্থ, কিন্তু সেগুলি আবার অর্থ শোষণের পন্থা না হয়ে ওঠে। আর একটি বিষয়, রূপান্তরকামী, সমকামীদের পরিসংখ্যানটিও খুব প্রাসঙ্গিক মনে হল না।
সুবীর ভদ্র, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
নতুন জীবন
বার্ধক্যের যেমন দেশ নেই, তেমন সংসার, সমাজ, রাজ্যও নেই। আসলে ষাটের পর জীবনের দ্বিতীয় শৈশব বা দ্বিতীয় ইনিংস শুরু, আবার নতুন করে বাঁচা। লোক শরীরের দিকে দেখে বটে, মনের খবর কেউ রাখে না। যুগ বদলেছে, বদলেছে যাপনের আধুনিকতা। শারীরিক লক্ষণগুলো প্রকাশ হয় বলে সমাজ বুড়ো বানিয়ে দেয়। কিন্তু মন সজীব থাকে। আসলে বার্ধক্যকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই, বার্ধক্য এখন আর মৃত্যুর সমার্থক নয়! মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, তাই বার্ধক্যের হাসি ফোটানোর দায়িত্ব সংসার, সমাজ এবং দেশের।
পুষ্প সাঁতরা, আটবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর