সম্প্রতি টালিগঞ্জ থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত শাসক দলের মিছিল থেকে উত্থিত হিংস্র স্লোগান, “দেশ কী গদ্দারো কো, গোলি মারো, গোলি মারো...” শুনে যারপরনাই আতঙ্কিত রাজ্যবাসী (“এ বার ‘গোলি মারো’ বিজেপির শোভাযাত্রায়”, ২১-১)। এ কোন অপসংস্কৃতি, কিসের অশনিসঙ্কেত? কোন অকাল হোলি খেলার উৎকট মহড়া? এ কি সত্তরের দশকের সেই আধা ফ্যাসিস্ট শক্তির উন্মত্ত আবাহন? প্রকাশ্য দিবালোকে এহেন ছেলেখেলায় উদ্বিগ্ন রাজ্যবাসী-সহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক ভাবেই আরও এক বার প্রশ্ন উঠছে, এ বার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অবাধে প্রয়োগ করার সুযোগ পাওয়া যাবে তো? রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার যা অবস্থা, তাতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন করতে গেলে কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীর যে অত্যন্ত প্রয়োজন, তা আমজনতা থেকে বিরোধী পক্ষ— সকলেই দাবি করছে। কিন্তু এখানেও বিস্তর অভিযোগ। বাহিনী কাদের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে? এদের নিয়ন্ত্রণ যদি রাজ্য পুলিশের হাতে থাকে, তা হলে তো একই অবস্থার প্রতিফলন ঘটবে।
আমাদের রাজ্যে নির্বাচনী কারচুপি মূলত তিন ভাবে হয়। এক, মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় প্রতিপক্ষের সদস্যদের হুমকি, ভীতিপ্রদর্শন, বলপ্রয়োগ, খুন, সন্ত্রাস সৃষ্টি করার নানা অভিনব কৌশল অবলম্বন করা (যেমন, বাড়িতে সাদা থান পাঠানো)। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা দেখেছি, বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতেই পারেননি প্রায় ৩৩% আসনে। ফলে প্রথম জয়টা অনায়াসে এসে যায়। দুই, নির্বাচনের দিন বুথে বিরোধী দলের এজেন্টদের ঢুকতে বাধা দেওয়া। এর জন্য শাসক-আশ্রিত গুন্ডারা নিযুক্ত হয়। যেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়, সেখানে তাঁদের এবং সমস্ত ভোটকর্মীদের হুমকি ও শাসানির মাধ্যমে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রেখে বেপরোয়া ছাপ্পা ভোট প্রদানের মাধ্যমে জয় সুনিশ্চিত করা হয়। তিন, নির্বাচনী ফল প্রকাশের দিনে কোনও বিরোধী এজেন্টদের গণনাকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া। যদি বিরোধী পক্ষের বিজয়ী প্রার্থীর শংসাপত্র লেখা হয়েও যায়, সেটাকে বলপূর্বক ছিঁড়ে ফেলে নিজেদের প্রার্থীর নামে জোর করে লিখিয়ে নেওয়া— এ সব সংস্কৃতিই লাগামহীন সন্ত্রাসের প্রতিফলন। এর পরেও বলা হয়, মানুষের ভোটে আমরা জিতেছি। সত্যি কি ভোট হয়েছিল?
রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, পাঁচলা, হাওড়া
ক্ষতি নেতারই
‘গোলি মারো’ স্লোগান যে পক্ষই দিক, তা খারাপ। একে শোধরাতে গেলে দরকার দলের উচ্চ ও তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীদের সঠিক নির্বাচন ও আত্মমূল্যায়ন। নেতা ও কর্মী একে অপরের পরিপূরক। উঁচুতে বসা নেতাদের চোখ-কান এই তৃণমূল স্তরের নেতারা। এঁদের থেকে বার বার আপত্তিকর মন্তব্য, স্লোগান আখেরে দলের ও নেতাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। সাধারণ মানুষ তার স্থানীয় পরিবেশটাই আগে দেখে ভোটের প্রাথমিক পছন্দ স্থির করে। একই ভাবে নেতাদেরও বক্তৃতা দেওয়ার সময় অন্যায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও ভাষা নির্বাচন জরুরি। না হলে এই স্বল্পশিক্ষিত নেতাদের কথার ও কাজের লাগাম আলগা হবেই।
অরিত্র মুখোপাধ্যায়, শ্রীরামপুর, হুগলি
গুরুত্বহীন
‘গোলি মারো’ প্রকৃতপক্ষে হিন্দিভাষী এলাকায় প্রচলিত কথা। যার অর্থ, কাউকে অগ্রাহ্য করা, বা কারও কথায় গুরুত্ব না দেওয়া। কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা নয়। সাধারণত আমরা কারও কথায় গুরুত্ব না দিলে বলি, “ছাড়, ওর কথায় গোলি মার।” তাই বঙ্গে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাদের কুরুচিকর মন্তব্যকে ‘গোলি মারো’, অর্থাৎ গুরুত্ব না দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া উচিত সাধারণ মানুষের।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
স্লোগানের ভাষা
পশ্চিমবঙ্গে শাসক-বিরোধী দলের মিছিলের স্লোগান জুড়ে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি। ভাবলে অবাক লাগে, বাংলার মতো সমৃদ্ধ একটি ভাষা মিছিলের স্লোগানে ব্রাত্য, বঙ্গ রাজনীতিতেই উপেক্ষিত! উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন বিরোধী দলের সঙ্গে টক্করে গিয়ে বঙ্গের শাসক দলও যে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে আরও নিচু স্তরে নিয়ে যাচ্ছেন, সে কথা বোঝার সময় এসেছে। ‘গোলি মারো’ শব্দটির বহুল ব্যবহার নবীন প্রজন্মের কথাবার্তাকেও অনুপ্রাণিত করছে। একেই তো শহুরে সংস্কৃতিতে বহু ছেলেমেয়েই এখন স্কুলে বাংলাকে তৃতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করছে। সেখানে বঙ্গ রাজনীতিতে এমন ভাষার ব্যবহার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কতটা উৎসাহিত করবে, সে ধন্দ থেকেই যায়।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
গদ্দার কে?
কেউ যদি দলবদল করেন, তবে তাঁকে ‘গদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক বলা কতটা যুক্তিযুক্ত? আদৌ সমীচীন কি? এমনও তো হতে পারে যে, তিনি নিজ দলে উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছিলেন না, বা ঠিকমতো কাজ করতে পারছিলেন না। সব সময়েই যে কোনও নেতা বা মন্ত্রী শুধুমাত্র নিজের সুবিধা দেখতে বা আখের গোছাতে দলবদল করেন, এমনটা ভাবা যুক্তিসঙ্গত নয়। নির্বাচনের দিন এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এখনই যদি প্রচারে এমন অশোভন, নিন্দনীয় মন্তব্য বা স্লোগান শোনা যায়, তবে নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, এর মাত্রা কত তীব্র হবে, তা সহজে অনুমেয়। নির্বাচন কমিশনের উচিত, যে কোনও রাজনৈতিক দলের এমন আচরণ বন্ধ করার জন্য নির্দেশিকা জারি করা, প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। রাজনৈতিক দলগুলিরও উচিত এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা, বাংলার সংস্কৃতি ও শালীনতার প্রতি সুবিচার করা।
পঙ্কজ সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
শান্তির বার্তা
দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্যে এসে বার্তা দিলেন, ভোটে হিংসা নয় (‘ভোটে হিংসা নয়, ফের বার্তা কমিশনের’, ২১-১)। এমন বার্তা প্রতি বারই শোনা যায়। কিন্তু নির্বাচনে দেখা যায়, শুরু ভাল, শেষ ভাল নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রেখে ভোট হয়েছে। নির্বাচন কমিশন যে ভোটার স্লিপ দিয়েছিল, তা দেখিয়ে ছাপ্পা ভোট হয়েছে বলে অভিযোগ। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট বলে দেয়, এই রাজ্যের শাসক দলের হাতে গণতন্ত্র বিপন্ন। ভোট মানে মারো, কাটো, বুথ দখল করো, আর রিগিং করে বিরোধীশূন্য করো। শাসক দলের লুম্পেনবাহিনী অধিকাংশ জায়গায় ভোট করিয়ে নেয়। বিরোধী দলগুলির কাছে অনুরোধ, নির্বাচন কমিশন প্রতি বারের মতো এ বারও হয়তো নিরপেক্ষতাকেই ‘পাখির চোখ’ করে এগোনোর কথা বলবে, কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হওয়া চলবে না। যাতে সাধারণ মানুষ নিজের ভোট দিতে পারে, সেই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতেই হবে।
মলয় মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১০
এই সুযোগ
ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী সরকার যখনই কোনও জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গ্ৰহণ করে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে, রাজ্য সরকার তা কেড়ে নিয়ে সেই কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছে। তা সে বিনামূল্যে টিকা, কৃষকের অনুদান বা রেশনে খাদ্যশস্য দেওয়া, যা-ই হোক। আমার মনে হয়, একটা চমৎকার সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। বিজেপি যদি এ রাজ্যে হিংসা, মিথ্যাচার, কটুভাষণ পরিহার করে, তা হলে তৃণমূলও সেই পথ অনুসরণ করবে। হিংসামুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হলে মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।
অসিত নায়ক, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা