অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেশনেতা চিত্তরঞ্জন’ (পত্রিকা, ১৭-৪) নিবন্ধটি পড়লাম। পুরুলিয়ার বুকে নারীদের উচ্চশিক্ষা প্রসারে চিত্তরঞ্জন দাশের অবদানের উপর আলোকপাত করতে এই পত্র। পিতা ভুবনমোহন দাশ, মাতা নিস্তারিণী দেবীর সঙ্গে চিত্তরঞ্জন ১৯০২ সালে পুরুলিয়া শহরের বুকে তাঁদের বাড়ি ‘সামার হাউস’-এ আসেন। চার দিকে উদ্যান ঘেরা মনোরম পরিবেশে এই বাড়ি। তখন এখানে মেয়েদের শিক্ষার অগ্রগতির ব্যাপারে প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের অভাব ছিল। তাই, সেই সময় চিত্তরঞ্জন দাশের সমস্ত পরিবার সামাজিক কাজ হিসেবে মেয়েদের শিক্ষায় উদ্যোগী হন। তাঁদেরই কন্যা অমলা দেবী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নানা ধরনের কাজে মেয়েদের দক্ষতা তৈরির জন্য মহিলা প্রশিক্ষকদেরও নিজের অর্থ দিয়ে নিয়োগ করেন অমলাদেবী। সেই সময়ে একমাত্র নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় যা চিত্তরঞ্জন দাশের আর্থিক সহায়তা এবং তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে ওই সামার হাউসে, তাঁর নিজের মায়ের নামে তার নাম রাখা হয় ‘নিস্তারিণী বিদ্যালয়’। মেয়েদের পড়াশোনার সঙ্গে নাচ, গান, সেলাই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন রকম হাতের কাজ শেখানোর জন্য কর্মদক্ষ বহু তরুণী তিনি নিয়োগ করেন।
১৬ জুন, ১৯২৫ সালে কিছু দিন জ্বর ভোগের পর চিত্তরঞ্জন হঠাৎ চলে যাওয়ায় পুরুলিয়ার ‘সামার হাউস’-এ শূন্যতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী নিজ পিতৃকুলের আত্মীয় এনে ওই এলাকায় পাড়ার হরিজন প্রতিবেশীদের নিয়ে বাড়িটিতে লেখাপড়ার মাধ্যমে সকলের মধ্যে একাত্মবোধ জাগিয়ে তোলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘সংকীর্তন’।
শোনা যায়, পরবর্তী কালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে চিরঞ্জন দাশ যখন এখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ‘সামার হাউস’-এ এসে তাঁর চিকিৎসা করেন, এবং ‘সংকীর্তন’-এ ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে ছাত্রছাত্রীদের একত্রিত দেখে তিনি মুগ্ধ হন। তাঁর অনুরোধে পুরুলিয়ার তৎকালীন বিখ্যাত নেতা ও সমাজসেবী জীমূতবাহন সেন এবং আরও অনেকে উদ্যোগী হয়ে স্কুলটিকে ‘নিস্তারিণী মহিলা মহাবিদ্যালয়’-এ রূপান্তরিত করেন। ১৯৫৭ সালে সামার হাউস থেকে কলেজটি স্থানান্তরিত হয় রাঁচী রোডে ‘স্বপ্নপুরী’ নামের এক ভাড়াবাড়িতে। এখানে আট মাস কলেজ চলার পর আবার সেটি পুরুলিয়ার ‘দেশবন্ধু রোড’-এর উপরে সামার হাউসে ফিরে আসে। ১৯৫৮ সালে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এই মহাবিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্ৰস্তর স্থাপন করেন। কলেজটি মেয়েদের উচ্চশিক্ষার এক মাইলফলক।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
দুই নেতা
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২১ সালের মে মাসে সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে ভারতে ফেরেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে। ১৬ জুলাই তিনি বম্বেতে (এখন মুম্বই) মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এক ঘণ্টা আলোচনা করেন। আলোচনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি নিরুৎসাহ ও হতাশ হন। অবশ্য গাঁধীর উপদেশে কলকাতায় ফিরে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করেন। প্রথম দিন দেশবন্ধুর বাড়িতে গিয়েও তাঁর অনুপস্থিতির জন্য সাক্ষাৎ করতে পারেননি। দ্বিতীয় বার বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পান। সুভাষচন্দ্রের কথায়, “মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে আমার মন যেরকম দমে গিয়েছিল, এই মহৎ লোকটির সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্ৰহে তা অংশতঃ দূরীভূত হল।”
তিনি আরও লিখেছেন যে, চিত্তরঞ্জন সর্বদা যুবকদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করতেন। তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বুঝতে এবং দুঃখে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারতেন। “আমাদের কথোপকথনের সময় আমি অনুভব করতে লাগলাম যে তিনি এমন একজন মানুষ যিনি জানেন তাঁর লক্ষ্য কি, যিনি তাঁর সর্বস্ব দান করতে পারেন, এবং অন্য সকলের কাছে তাদের দেয় সবকিছু দাবী করতে পারেন। তিনি এমন একজন মানুষ যাঁর কাছে যৌবন অবাঞ্ছিত নয়, বরং একটি সম্পদ। আমাদের আলোচনা যখন শেষ, আমার মন তৈরী। মনে হল নেতা খুঁজে পেয়েছি। তাঁকেই অনুসরণ করব।” (সুভাষচন্দ্র সমগ্ৰ রচনাবলী, ২য় খণ্ড)। সুতরাং, সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক জীবনে দেশবন্ধু ছিলেন ‘ধ্রুবতারা’-র মতো। দেশবন্ধুর দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগের কথা সুভাষচন্দ্র ইংল্যান্ডে থাকতেই শুনেছিলেন। এই ত্যাগের আদর্শ তাঁকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল। কথায়-কাজে, মনে-প্রাণে সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর যথার্থ অনুগামী ছিলেন।
অসহযোগ আন্দোলনে দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র, উভয়েরই ছ’মাসের কারাদণ্ড হল। আলিপুর জেলে এক সঙ্গে যে ক’মাস ছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে দিলীপকুমার রায়কে সুভাষ লেখেন, “আমি তাঁর অত্যন্ত কাছ থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহূর্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম, সময় এলে জগতের সামনে তার কথঞ্চিত(ৎ) আভাস দিতে পারব আশা করি।” আর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হয়েছিলেন বলেই দেশবন্ধুর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসা জন্মেছিল। জেলে দু’জনে পাশাপাশি সেলে ছিলেন। এই সময় দেশবন্ধুকে দেখাশোনা, তাঁর এক বেলা রান্নার কাজও করেছিলেন। এই নিয়ে তাঁর একটা গর্ব ছিল।
জেলে যাওয়ার আগে তিনি মাত্র কয়েক মাস দেশবন্ধুকে রাজনৈতিক নেতা ও গুরুরূপে দেখেছিলেন। কথায় আছে, বেশি ঘনিষ্ঠতা হলে অশ্রদ্ধা জন্মায়। সুভাষচন্দ্র এই কথাটির উল্লেখ করে বলেছিলেন, দেশবন্ধু ও তাঁর ক্ষেত্রে এর বিপরীত ঘটেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, সাধুকে দেখবে দিনে-রাতে। কারাগারের ক্ষুদ্র পরিবেশে দেশবন্ধুকে দিনে-রাতে দেখে, খুব কাছাকাছি এসে চিত্তরঞ্জনের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা শতগুণে বেড়ে গিয়েছিল। তিনি যখন বর্মার মান্দালয় জেলে বন্দি ছিলেন, তখন বিভিন্ন চিঠিতে ওই কারাজীবন ও দেশবন্ধুর যে স্মৃতিচারণা করেন, তা অমূল্য সম্পদ।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
অসামান্য বক্তা
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশের ভূমিকা উল্লেখ করেছেন। এই মামলাতে দেশবন্ধুর যে বাক্নৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছিল, তা ব্যতিক্রমী। অরবিন্দ-বারীন্দ্রের পৈতৃক বাড়িতে বোমার কারখানার খোঁজ পাওয়ার পর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আলিপুর কোর্টে মামলা শুরু করে পুলিশ (১৯০৮)। এই মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত-সহ মোট ৩৭ জন। অভিযুক্তদের পক্ষে সওয়াল করে চিত্তরঞ্জন বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করা অপরাধ নয়। তিনি বলেছিলেন, অরবিন্দ কেবল হাই কোর্টের বিচারপতিদের বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নেই, ইতিহাসের আদালতের সামনে তিনি দাঁড়িয়ে। এই বিতর্ক নীরব হয়ে যাবে, এই উত্তেজনা শেষ হয়ে যাবে, ব্যক্তি অরবিন্দের জীবনের অবসান হবে, তারও বহু পরে তাঁকে দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, মানবজাতির প্রেমিক বলে দেখা হবে। অরবিন্দ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার বহু পরেও তাঁর কথা প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে, কেবল ভারতে নয়, বহু দূরের নানা দেশে।
এক জন ব্যক্তির মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশবন্ধু যেন ব্রিটিশ সরকারকেই জানিয়ে দিলেন, তারা যাঁকে আসামি করেছে তিনি এক দিন বিশ্বের কাছে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বলে বিবেচিত হবেন।
প্রবীর চক্রবর্তী, জয়নগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
ভোট-দূষণ
২২ এপ্রিল নদিয়া জেলার নির্বাচন শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নানা দলের ব্যানার, ফেস্টুন রয়ে গিয়েছে। ২২ এপ্রিলের সন্ধ্যায় সামান্য ঝড়ে একটা বড় কাঠের ফ্রেমের ব্যানার বাঁশের খুঁটি-সহ ভেঙে পড়ে ইলেকট্রিক তারের উপর। তার ছিঁড়ে পড়লে প্রাণহানিও হতে পারত। প্রতিটি দলের উচিত নিজেদের ফেস্টুন সরিয়ে ফেলা। দেওয়াল লিখনগুলো দৃশ্যদূষণের নামান্তর। সেগুলোও মোছা দরকার। এ ছাড়া ছোট ছোট প্লাস্টিকের পতাকা রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেগুলো আগে পরিষ্কার হোক। নইলে ড্রেনে জমে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।
পরেশনাথ কর্মকার, রানাঘাট, নদিয়া