—ফাইল চিত্র।
‘প্রধানমন্ত্রীকে তিনটি প্রশ্ন’ (৯-৮) সংবাদ প্রসঙ্গে এই পত্র। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাহুল গান্ধী তাঁর সাংসদ পদ ফিরে পেয়েছেন— এই নিয়ে যেন রাজনীতির উৎসব পালিত হচ্ছে সংসদ ভবন থেকে মিডিয়া, সর্বত্র। মনে হচ্ছে ভারত যেন মস্ত সাফল্য পেয়েছে। ভারতের এখন আর কোনও সমস্যা নেই। যেটুকু আছে, আগামী নির্বাচনে রাহুল গান্ধী ক্ষমতায় এলে তারও সমাধান হয়ে যাবে। ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও যে দেশে সাধারণ মানুষ উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার, পানীয় জল বা বাসস্থানের সুযোগ পায় না, সে দেশে কী করে রাহুল গান্ধী বা নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা হতে পারে? মণিপুর নিয়ে সংসদে মোদী এসে বিবৃতি দিলেই বুঝি মণিপুর শান্ত হয়ে যাবে? এর পর মণিপুরে আর কোনও দিন অশান্তি হবে না, এক জন নারীরও আর শ্লীলতাহানি হবে না? যে সব জন-প্রতিনিধিরা দিনরাত এক করে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেন, সংবিধানের কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাঁরা কি এক বারও রাজনীতির বাইরে এসে ভাবেন যে তাঁরা যা করেন, তা আসলে সমাজবিরোধীদের কার্যকলাপকেও লজ্জা দেয়? রাজনীতির স্বার্থে দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের অর্থে চলা সংসদ ভবনকে অচল করে দিয়ে যখন কোটি কোটি টাকার অপচয় ঘটে, অথবা অধ্যক্ষের সামনে এসে আস্ফালন দেখিয়ে কাগজপত্র ছুড়ে ফেলা হয়, তখন কি মনে হয় এঁরা আদৌ মানুষের কথা বলছেন বা সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করছেন? ভোটের দিন ভোট লুট হয়ে যাওয়ার পরও সব ‘শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে বলে দাবি করে এঁরা যখন বিজয় উৎসব পালন করেন, তখন কি মনে হয়, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এঁরা এমন ভাবে ভোট লুট করেন?
এই সব সাংসদ কি কখনও ভাবেন, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও কী করে ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে দেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে? সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে, অথচ সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাতিভেদের প্রচলন কেন রয়েছে? কারণ, সবার উপরে মানুষ সত্যের মতো রাজনীতিতে ভোট ব্যাঙ্কই সত্য। রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ ফিরে পাওয়া থেকে, মণিপুর অশান্তি বা প্রধানমন্ত্রীর সংসদে বিবৃতি না দেওয়া— সবই ভোট ব্যাঙ্কের অঙ্ক। এর সঙ্গে গণতন্ত্র, সংবিধান বা মানুষের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই প্রধানমন্ত্রীকে তিনটি প্রশ্ন করার আগে, দেশের মৌলিক প্রশ্নগুলি নিয়ে সাংসদরা নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করুন এক বার।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
বেমানান
দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘কুৎসিত, বীভৎসা-’পরে...’ (১০-৮) সঠিক বিচার করেছে তিনটি পূর্বাপর ঘটনার, যেগুলো ঘটেছে এ রাজ্যে, মণিপুর ও হরিয়ানায়। সব ক্ষেত্রে মনুষ্যত্বহীনতা ও নৈরাজ্যের যে ছবিগুলি তুলে ধরা হয়েছে, তাতে সবার অকর্মণ্যতাই ফুটে উঠেছে। ব্যক্তি, প্রশাসন— কেউ নিজেদের প্রমাণ করতে পারেনি। বেহালার স্কুলটির সামনে পুলিশি প্রহরা বা ট্র্যাফিক পুলিশ দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি কেন পুলিশ প্রশাসনের? স্কুলের প্রধানশিক্ষক নাকি শিশুদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের কাছে বার বার সাহায্য চেয়েছিলেন। অবশেষে একটি শিশু প্রাণ দিয়ে পুলিশের বিবেক জাগ্রত করল, বোধোদয় ঘটাল প্রশাসনের। গত কয়েক বছরে পুলিশ কমিশনারেট, পুলিশের উচ্চ পদ সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। তবু এত নৈরাজ্য, নৃশংসতা কেন রোজকার খবরে উঠে আসে? সর্বভারতীয় স্তরের মেধাবীরা, যাঁরা পুলিশ বা প্রশাসনে আসেন, তাঁদের থেকে কি তাঁদের দফতরের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বেশি মেধার অধিকারী? বরং, পুলিশ বা প্রশাসনেরগুণগত অবক্ষয় এ ভাবে ডেকেআনা হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকার মাসমাইনে ও অন্যান্য সরকারি সুযোগসুবিধা দিয়ে অবসরপ্রাপ্তদের উপদেষ্টা পদে বসিয়ে কার লাভ হচ্ছে? সেই অর্থ ব্যয় করে প্রয়োজনীয় একশো জন পুলিশকর্মী নিয়োগ করা যায়, যা আখেরে জনগণের কাজে লাগে।
হরিয়ানার গুরুগ্রামে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হামলা, অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে, বিশেষ করে মুসলিম মহল্লাগুলোতে। একটি বিশেষ ধর্মীয় উন্মাদনার ফসল এই অত্যাচার, নিগ্রহ, আস্তানা ছাড়া বা স্থানত্যাগের হুমকি। নিরাপত্তা দিতে অপারগ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সকলকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। জনগণের সংখ্যা সব সময় সমাজবিরোধী বা দুষ্কৃতী সংখ্যার চেয়ে বেশি। সকলের নিরাপত্তা দেওয়ার বিশাল আয়োজন সরকারের সাধ্যে না কুলোলেও, গোনাগুনতি সমাজবিরোধীকে চিহ্নিত করে আটক করতে তো বেশি আয়োজনের দরকার হয় না!
‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের প্রবক্তা কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি মণিপুরে নিজের দলকে সিংহাসনে বসিয়েও প্রায় তিন মাস সময়ে দুই গোষ্ঠী মেইতেই ও কুকিদের পারস্পরিক লড়াই, প্রাণহানি, সম্পদ নষ্ট, হাজার হাজার মণিপুরবাসীকে ঘরছাড়া করাতে উৎসাহ দিয়ে গেল! সংখ্যালঘু কুকি গোষ্ঠীর দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো ও শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করার মতো উন্মত্ততা, বিকৃত মানসিকতা ও নিষ্ঠুরতার কোলাজ তৈরি হতে দিয়েছে সেই রাজ্যের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার, অনেকটা সময় ধরে। বিবদমান দুটো গোষ্ঠীর পরিচিতি ও অধিকার নিয়ে সমস্যা মেটাতে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের বিধানসভা, লোকসভা একেবারে ব্যর্থ, তেমন ইতিহাস-ই লেখা হয়ে গেল। স্বাধীনতার অমৃতকাল রচনার মধ্যে দেশের চার দিকের এই ঘটনাগুলো কি এখন অনেকটাই বেমানান ঠেকবে না?
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
অ-রাজনীতি
দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে বর্তমান রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও তাদের দেশভাবনা বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে বার বার মনে হচ্ছিল, এ তো রাজনীতি নয়। আসলে এ অ-রাজনীতি। রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল কী ভাবে দেশের মানুষকে শোষণ করবে, তারই প্রতিযোগিতা যেন চলছেদেশ জুড়ে।
সবাইকে যেন ধরে নিতে হবে, রাজনীতি করতে নামলে একটু-আধটু নির্লজ্জ হতেই হয়। নিজের পরিবার পরিজনের সুখ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার, বা দুর্নীতিতে নিজেকে জড়ানোর সুযোগে প্রতিবন্ধকতা এলেই আসে দলবদলের হাতছানি। দশ-বারো বছর দলে থেকেই করে-কম্মে খেয়ে, সেই দলের বিরুদ্ধে কেচ্ছা ছড়ানোর ‘দায়িত্ব’ মেলে সেই রাজনৈতিক কর্মীর। এই মানসিকতার ব্যক্তিদের দলের প্রতি আনুগত্য কোথায়? যেটা আছে, তা হল স্বার্থ গোছানোর চেষ্টা। এঁদের কথায় যদি প্রশাসন চলে, তা হলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা তো অবশ্যম্ভাবী। প্রবন্ধে কলকাতা-মণিপুর-গুরুগ্রামের প্রসঙ্গ তো অতি সাম্প্রতিক ঘটনা, সর্বত্রই এমন ঘটনা সরকারের অপশাসন বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার পরিণাম। আমরা তো দেখছি, যে রাজ্যে এমন হিংসা বা অশান্তির ঘটনা ঘটছে, সে রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা ফলাও করে বলছে কেন্দ্রীয় সরকার। আবার তেমনই নানা রাজ্যের সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দোষারোপ করে ঢাকঢোল পেটাচ্ছে। দু’তরফই পরস্পরের বিরোধিতা করে উস্কানিমূলক কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনার অপদার্থতার কথা কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই স্বীকার করে না।
প্রবন্ধকার শেষে বলেছেন, অমৃতকাল উদ্যাপনের দিনে এমন সব ক্ষমতাধরদের মুখে শান্তি, সুশাসন, সম্প্রীতির কথা শোনা যাবে। সত্যি তো, অমৃতকালে অমৃতবাণী না শোনালে তাঁদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশের দিকটা যে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁদের কাজে ও কথায় আসমান জমিন ফারাক তো থাকতেই পারে, কারণ যে সব ঘটনার জন্য নিজের মসনদে টান পড়ে না, সে সব ঘটনায় দেশে অশান্তির আগুন জ্বললেও এই নেতাদের কিছুই যায় আসে না।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০