Jadavpur University Student Death

বিধির সম্মান

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে সাড়ে সতেরো বছরের এক ছাত্র বাংলা সাহিত্য ভালবেসে পড়তে এসে প্রাণ হারিয়েছে অকথ্য অত্যাচারের পরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২৭
Share:

—ফাইল চিত্র।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে যে সব বিরূপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে, তা আমাদের মতো পুরনো ছাত্রদের কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। র‌্যাগিং প্রসঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা জানাতে চাই। যদিও আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, আমার কর্মজীবনের বেশির ভাগটাই কেটেছে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট বা আইএসআই-তে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং প্রাক্তন ডিন হিসাবে এই প্রতিষ্ঠানের হস্টেল জীবন সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই।

Advertisement

এখানে ছাত্রসংখ্যা খুবই কম। একটি স্নাতকদের, একটি স্নাতকোত্তর ও গবেষক ছাত্রদের, এবং একটি মেয়েদের হস্টেল। জুনিয়র আর সিনিয়র পড়ুয়াদের সম্পর্ক বেশ ভাল। ২০০৭-এ ফার্স্ট ইয়ারের এক ছাত্রের অভিভাবক র‌্যাগিং-এর অভিযোগ করলেন। দৈহিক নির্যাতন হয়নি, তবে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। ডিরেক্টর অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জন অধ্যাপককে নিয়ে একটা তদন্ত কমিটি করলেন, এক সপ্তাহে রিপোর্ট ও সুপারিশ। মূল অভিযুক্তকে ইনস্টিটিউট থেকে বিতাড়িত করা হল, বাকি যোগদানকারীদের স্কলারশিপ বন্ধ করে হস্টেল থেকে বার করে দেওয়া হল। কিছু অভিভাবক ও অধ্যাপক শাস্তি কমানোর সুপারিশ নিয়ে ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য খুব পরিষ্কার— র‌্যাগিং আইনত অপরাধ। হয় ইনস্টিটিউট তদন্তকারী কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ব্যবস্থা করবে, না হলে অভিযুক্ত ছাত্রদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে, যথাযথ আইনি ব্যবস্থার জন্য। এর পর আর কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেননি। আইএসআই-তে আর কোনও র‌্যাগিং প্রচেষ্টার কথা আমি শুনিনি।

যে কোনও অপরাধের শেষে যেমন থাকে মানুষ, তেমনই যে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থার শেষেও আছে মানুষ, কোনও যন্ত্র নয়। সিসিটিভি ক্যামেরা বসালেই হল না, কাউকে নিয়মিত তার ডিসপ্লে-র দিকে নজর রাখতে হবে। যাদবপুরের ঘটনার দিন নাকি ডিন অব স্টুডেন্টস-কে খবর দেওয়া হয়েছিল, হস্টেল সুপারকে জানানো হয়েছিল, কেউ আসেননি। তা হলে নিরাপত্তার সরঞ্জাম দিয়ে কী লাভ? আইআইটি-তে এক জন ছাত্রের মৃতদেহ কবর খুঁড়ে বার করে আবার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে, এবং সন্দেহ করা হচ্ছে যে ছাত্রটিকে খুন করা হয়েছে।

Advertisement

দুঃখের বিষয়, খুব কম সংখ্যক ছাত্রই র‌্যাগিং-এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বদনাম হয় পুরো প্রতিষ্ঠানের। এত সব কাণ্ডের পরেও যাদবপুর বা আইআইটি-র শিক্ষার মান একই থাকে। ধর্ষকাম বা সেডিজ়ম একটা মানসিক বিকার, এর উপযুক্ত চিকিৎসা দরকার। আর দরকার একটা এমন সক্রিয় প্রক্রিয়া যা প্রতি বছর অ্যাডমিশনের আগে বিশেষ ভাবে তৎপর হয়ে র‌্যাগিং-এর প্রক্রিয়াকে রুখবে।

আমি ষাটের দশকের মাঝামাঝি যাদবপুরে ছাত্র হিসাবে ঢুকেছিলাম। তখন উপাচার্য ত্রিগুণারঞ্জন সেন ও রেজিস্ট্রার পিসিভি মল্লিক, ‘র‌্যাগিং’ শব্দ উচ্চারণ করার সাহস কারও হত কি না সন্দেহ। তখন এই মেন হস্টেল সব ছাত্রের আড্ডা মারার জায়গা ছিল। এমনকি সপ্তাহান্তে বি ই কলেজ বা আইআইটি-র ছেলেরাও সেখানে আড্ডা মারতে আসত। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, ভীতির নয়।

খুবই দুঃখের বিষয়, এই ঘটনার ফলে জানা গেল, ইউজিসি-র অনেক গাইডলাইনই বিশ্ববিদ্যালয় মানেনি, ক্যাম্পাসে কোথাও সিসিটিভি বসানো হয়নি, ফ্রেশারদের আলাদা হস্টেল হয়নি। এর ফলে হয়তো যাদবপুর ‘ইনস্টিটিউশন অব এমিনেন্স’-এর তালিকায় থাকবে না, শিক্ষার মান ভাল হওয়া সত্ত্বেও। যে প্রাক্তন ছাত্ররা এই কাজের জন্য তাঁদের ভালবাসার বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থসাহায্য করেছিলেন, তাঁদের এই দুঃখটা মেনে নিতেই হবে।

আদিত্য বাগচী, কলকাতা-৮৪

তরুণের সঙ্কট

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে সাড়ে সতেরো বছরের এক ছাত্র বাংলা সাহিত্য ভালবেসে পড়তে এসে প্রাণ হারিয়েছে অকথ্য অত্যাচারের পরে। আইআইটি খড়্গপুরের তৃতীয় বর্ষের এক পড়ুয়াও হস্টেলে নিজের ঘরে খুন হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ হস্টেলে চার বছর ধরে অত্যাচারিত হয়ে চলেছে টেক্সটাইল এঞ্জিনিয়ারিং-এর এক ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুলিশ-প্রশাসন, সর্বস্তরে আবেদন করে ফল হয়নি। এ কোন শিক্ষাপ্রাঙ্গণ, যেখান থেকে অবসর নিয়েছি প্রায় তিন দশক আগে?

সিসিটিভি বসানো, আইডি কার্ড দেখিয়ে বেরোনো-ঢোকা, হস্টেলে প্রবেশ-নিষ্ক্রমণের খতিয়ান রাখা— এমত বিধি-ব্যবস্থা কেন নেই? প্রতিরোধের কাছে কেন নতিস্বীকার করেছেন কর্তৃপক্ষ, কেন প্রাক্তনীরা বেআইনি ভাবে দখল করে আছে ছাত্রাবাসের ঘর, কেন তাদের এই পৈশাচিক দাপট— আশা করা যায় জানা যাবে, হবে বিহিত।

এ সকলের অনেক গভীরে, প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে যে প্রশ্ন আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে, অসুস্থতার প্রান্তে উদ্বিগ্ন করে রাখছে তা হল, কেন তরুণ, মেধাবী ছাত্র, বর্তমান অথবা প্রাক্তন, এই পৈশাচিক প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে? ‘বহিরাগত’ ছাত্রাবাসে হতে পারে, সমাজে তো নয়। কোন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে, কোন পরিবেশে এদের আমরা বড় করে চলেছি, যে তারা এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে; ঘটাতে পারছে? এই প্রশ্ন শিক্ষক-প্রশাসক-আধিকারিকদের কাছে, তার পূর্ববর্তী পর্যায়ে স্কুলশিক্ষক ও পরিবারের কাছে।

জানা যাচ্ছে, মফস্‌সল গ্রামাঞ্চল থেকে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হিসাবে যে মেধাবী কিশোররা শহরের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে স্থান পাওয়ার ভরসায় এসে পৌঁছয়, তাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় র‌্যাগিং-এর শিকার। আবার যারা অত্যাচারের নেতৃত্বে থাকে, তারাও আর্থিক ভাবে দুর্বল স্তর থেকে মেধার ভিত্তিতে উঠে আসা তরুণ। এ বার জানা দরকার, অন্য আবাসিক ছাত্র, যারা মেনে নিচ্ছে, তারা কি অপ্রত্যক্ষ সমর্থন দিচ্ছে, না নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে নীরব থাকছে? যাদবপুরের মেন হস্টেলের ঘটনার রাতে যে সব জেনারেল বডি মিটিং হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে, সেখানে এই আবাসিকদের কণ্ঠস্বর কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ কাল ধরে বামপন্থী শাসন চলেছে, ঘটেছে নকশালবাড়ি আন্দোলন। শ্রেণিচেতনার সুদীর্ঘ চর্চা, শ্রেণি সংগ্রামের প্রেক্ষাপট— সব উত্তরাধিকারের এই কি ফল? ‘হোক কলরব’-এর কণ্ঠস্বর এ ক্ষেত্রে কেন সরব হয় না? সে কি ছাত্রাবাসের সুলভ আবাসন সুবিধাটুকু ধরে রাখার স্বার্থপর উদ্দেশ্যে?

মনে পড়ছে, পাড়ার ফোটোকপি করার দোকানে স্কুলপড়ুয়া, ক্লাস ফাইভ, সিক্সের বাচ্চাদের মায়েরা অপেক্ষারত— আগের বছরে প্রথম স্থান অধিকার করে যারা উঁচু ক্লাসে উঠেছে, তাদের খাতাপত্র ফোটোকপি করে নিচ্ছেন সন্তানের জন্য। হতবাক হয়েছিলাম— পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণিতে যদি নিজের কাজ নিজে না করতে শেখে, তবে কী ভাবে পথ চলবে এই শিশুরা? সহজে স্বার্থসিদ্ধির এই শিক্ষাই কি আমরা সন্ততিকে দিচ্ছি? পাশের পড়ুয়াটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষা কি দিয়েছি? এ দায়বদ্ধতার চেতনা রাজনীতির পতাকা তলে সংঘটিত হয় না, গড়ে ওঠে প্রতি দিনের জীবনযাপনে— বাড়িতে, স্কুলে, রাস্তায় পথ চলায়। সেখানে কি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছি আমরা একেবারে?

প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনেই বা কেন এই সার্বিক ব্যর্থতা? যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যহীন কী করে থাকে? কেন থাকবে? কেন কার্যনির্বাহী সমিতির মিটিং হবে না? আধিকারিক নিয়োগ যদি রাজনীতি কার্যকর হয়ে থাকে, সে তো অতিশয় গর্হিত। এমন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা কাজ দিতে পারে না। মেধা, মননচর্চা এক অন্য জগৎ। অনুপ্রবেশ, অস্বাস্থ্যকর, ধ্বংসাত্মক। ‘অটোনমি’ সেই ঘেরাটোপ, যা রক্ষা করে নির্ভীক, সজীব মননচর্চা। আর সব শেষে আসে সেই দায়বদ্ধতার কথা। তুলনায় যে দুর্বল, তাকে আগলে রেখে এগিয়ে দেওয়া সমগ্র সমাজের অলিখিত অঙ্গীকার।

সতী চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৪৫

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement