সুচিত্রা মিত্র। —ফাইল চিত্র।
একই দিনে দুই লেখিকার দু’টি লেখা পড়ে বড় আপ্লুত হয়েছি। প্রথমটি রুশতী সেনের ‘তাঁর গানে মনের বৈভব’ (৮-১০)। অপরটি রবিবাসরীয়-তে ঈশানী দত্ত রায়ের ‘সে দিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’।
রুশতী লিখেছেন সুচিত্রা মিত্রের কথা। লিখেছেন এমন এক আবেগ, এমন এক অনুভূতির জায়গা থেকে যে, তাঁর প্রতিটি বাক্য আমাদের রেডিয়োয় কান পেতে সুচিত্রা মিত্রের গান শোনার ছেলেবেলাকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যখন ক্লাস নাইনে পড়ি বাবা এক দিন রেকর্ড প্লেয়ার হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরল, সঙ্গে কিছু রেকর্ড, যার মধ্যে সুচিত্রা মিত্রের একটা লং প্লে রেকর্ড ছিল। কভারে সুচিত্রার ছবি, এখনও সেই ছবি দেখে একটা কথাই মনে হয়, এই সেই নারী যাঁর ব্যক্তিত্ব আর কণ্ঠস্বর একে অপরের পরিপূরক। আমি আর দিদি আনন্দে উদ্বেল। আর রেডিয়োর প্রতীক্ষায় থাকতে হবে না, এখন ইচ্ছামতো শোনা যাবে ‘আজি কোন সুরে বাঁধিব দিন অবসান বেলা রে’, ‘তুমি উষার সোনার বিন্দু’। আজ অবসর জীবনের দীর্ঘ ধূসর অবকাশকে খানিকটা পূর্ণ করে দিয়ে গেল রুশতী সেনের রচনা।
প্রবন্ধকারের লেখাতেও সেই বাল্যস্মৃতি। এমনকি সেই পিসিমণি আমাদেরও ছিলেন। বিদ্যাসাগর বাণীভবনে সুপ্রভা রায়ের কাছ থেকে নানাবিধ শিক্ষা লাভ করেন আমাদের বড়পিসিমা, বাল্যবিধবা জ্যোতির্ময়ী। নারকেলডাঙার প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেন। পুজোর ছুটিতে নানা উপহার নিয়ে হাজির হতেন। নিরামিষ রান্না আর নারকেল নাড়ু বানিয়ে আমাদের খুশি করে পুজোর ছুটির পরে ফিরে যেতেন নিজের বাসস্থানে। প্রবন্ধকার কোনও ফাঁক রাখেননি, ‘যাদের না হলে চলে না’ সেই নামগুলো সব পাড়ার স্যুভেনিরে একই রকম হত। আর ওই মাইক টেস্টিং! কানেকশন এলে প্রথম টুঁউউউউউ করে একটা আওয়াজ। তার পর ‘হ্যালো মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি ফোর...।’ আরও নানাবিধ মুহূর্তের উল্লেখে প্রবন্ধকার তাঁর রচনাটিকে সর্বজনীন করে তুলেছেন। লেখাটির দ্বিতীয় ভাগে আছে দর্শনের ছোঁয়া, যা ভোরের আলোর মতোই শরীরকে স্পর্শ করে যায়, অন্তরকেও। এই দুটো লেখা যেন ‘পূর্বজনম স্মৃতি’ আর ‘হারিয়ে যাওয়া গীতি’ পুজোর প্রাক্কালে বহন করে আনল।
সোমনাথ দাশগুপ্ত, কলকাতা-৯৯
তোমার দুয়ার
‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল’— ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধ ‘সে দিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়’ পাঠান্তে রবি-গানের প্রথম ছত্রটি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠছিল। কে জানে কখন চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল! আমার এই পরিণত বয়সে পুজোর অনুষঙ্গে যিনি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছেন, তিনি আমার গর্ভধারিণী। পুজো এলেই তিনিও আসেন চুপটি করে, রান্নাঘরে, তাঁর অসংখ্য দেব-দেবীর পুতুল-সংসারে, জবাকুসুম তেলের গন্ধ নিয়ে, এবং তাঁর ছেলেকে কাঁদিয়ে। ছেলেদের কান্না নাকি বারণ, অন্তত সর্বসমক্ষে তো নয়ই। কিন্তু, কেন যে আবাসনের পুজোর মিটিং থেকে শুরু করে ঘরের লক্ষ্মীপুজো অবধি তাঁর ব্যস্তসমস্ত দিন-রাত্রি যাপন আমাকে কাঁদিয়ে মারে, কে জানে!
আমাদের আবাসনে বেশ জাঁকিয়ে নারকেল হয় বছরে দু’টি সময়ে। সাকুল্যে সত্তর-আশিটা নারকেল কুড়িয়ে, পুজোর আগে আবাসনের মহিলাদের একটি দিব্যি-জমাটি দ্বিপ্রহর কাটে রাত আটটা-ন’টা অবধি নাড়ু তৈরিতে।
চারটি বিশাল মাটির হাঁড়িতে, চার দিনের নাড়ু সযত্নে রক্ষিত থাকে।
আমাদের পুজোর মহাপ্রসাদ ওই নাড়ু। মা যত দিন সক্ষম ছিলেন,
এই নাড়ু-উৎসবে উপস্থিত থাকাটা তাঁর কাছে ছিল সপ্রাণ আনন্দযজ্ঞে শামিল হওয়ার মতো। এই তো ক’দিন বাদেই আবার নাড়ু তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন মহিলারা।
মায়ের নিঃশব্দ উপস্থিতি তাঁদের কারও মনে পড়ে কি না, সে কথা জানা নেই।
বারো মাসে ২৪, না কি, ৩৬ পার্বণ ছিল তাঁর? আর উপোস করাটা ছিল বাতিক নয়, অবধারিত নিয়ম। বাবা যত দিন জীবিত ছিলেন, মহা ধুমধাম করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হত বাড়িতে। কয়েক দিন আগে থেকেই নানাবিধ মোয়া, মুড়কি, নাড়ু তৈরির আয়োজন এবং সুগন্ধ মাতাল করে দিত। নিশি না পেলে মা লক্ষ্মীর আবার পুজো কী? তাই, আকাশে যখন পৌর্ণমাসীর ঢল, রুপোর চাদরে চরাচর মাখামাখি, মায়ের তখনও ফুরসত নেই। নিমন্ত্রণহীন অতিথিদের ভোগ বিলোচ্ছেন, গল্প করছেন, মুখে স্মিত হাসি। কেউ কি খোঁজ রেখেছিল, তিনি কিছু মুখে দিয়েছেন কি না? ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় আমরা তো মহানন্দে ফোঁটা নিতাম। ও দিকে দেওয়ালে পাঁচটি ফোঁটা পড়ত চন্দন-ধান-দুব্বো’সহ। মা বিড়বিড় করে বলতেন সেই আবহমান কালের মধুর বুলিগুলো। আমরা জানতাম ওই ফোঁটাগুলো বড় মামা, মেজো মামাদের উদ্দেশে। কিন্তু, তখনও জীবিত ছোট মামার কাছে মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কারও মনে পড়ত না। বাবারও নয়। হাসি মুখেই মেনে নেন সব মায়েরা। যেমন, সবার খাওয়া হলে একলাটি রান্নাঘরে তাঁর দ্বিপ্রাহরিক আহার সারবার সময় কারই বা মনে পড়েছে আমাদের দেওয়া সব ক’টি পদ তাঁর পাতে আছে তো?
নিয়ম করে পুজোর চারটি দিন সকাল-সন্ধেতে আবাসনের কমিউনিটি হলে তাঁর যাওয়া ছিল অবধারিত। দুপুরে চার দিন আবাসিকদের জন্য মহাভোজের আয়োজন। মা অপেক্ষা করতেন ভোগের জন্য। আড্ডা, গুলতানির ফাঁকে ভোগটুকু পৌঁছে দিতেই তাঁর চোখে-মুখে তৃপ্তি। কপালে ঠেকিয়ে বলতেন, “খেয়ে নিস। দেরি করিস না।”
পুজোর ভার এখন ছোটদের উপর। স্যুভেনিরের নামোল্লেখে হাফপ্যান্ট, ফ্রক পরিহিতরা এখন কর্তাব্যক্তি, গিন্নিমা। আলো-আঁধারিতে যারা প্রেমের পাঠ নিয়েছিল, যে সুন্দরী বৌদি পাড়ায় বৌ হয়ে বিজয়া সম্মিলনীতে ‘সে দিন দুজনে’ গেয়ে বহু যুবকের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল, সারা বছর মস্তানি করাটা যাদের মজ্জাগত ছিল, তারাও কেমন বুড়িয়ে গেছে।
মায়ের মুখ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হওয়া দেখে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে আমাদের সর্বংসহা মা মনে মনে সব মায়ের মতো বলতেন, “আবার এসো মা”। সাত/ আটটি সন্তানের জননী নিজেকে কি তুলনা করতেন চার সন্তানের জননী ‘সমপ্রেমী’র সঙ্গে?
পুজো ফিরে ফিরে আসে। শিউলি ভোর মৃদু গায়, ‘তোমার দুয়ার খোলার ধ্বনি ওই গো বাজে...’
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
স্মৃতিমেদুর
ঈশানী দত্ত রায়ের সঙ্গে সহমত যে, শারদীয় উৎসবের স্মৃতি সত্তরোর্ধ্বদের অবশ্যই বেদনাহত এবং স্মৃতিমেদুর করে। আমাদের দেশের উৎসবমুখর দিনগুলির সঙ্গে প্রকৃতির একটি সুনিবিড় সম্পর্ক আছে। আশ্বিনের শিশিরবিন্দু ঘাসের ডগায়, কাশফুলের দোল খাওয়া, শিউলি ফুলের শোভা উৎসবের বার্তা বহন করে। তার পর মহালয়া দিয়ে শুরু। ইতিমধ্যে ঠাকুর গড়ার তৎপরতা।
বিজয়া দশমীর মিষ্টান্ন আর জেঠিমা, কাকিমা করেন না, সবই এখন বাজারজাত। তবে বিভিন্ন রামকৃষ্ণ আশ্রমে, বেলুড়ের অন্তর্গত, কুমারীপুজোও হয় স্বামী বিবেকানন্দের সেই কাশ্মীরি বালিকাকে পুজো করার সঙ্গে সমতা রক্ষা করে। দুর্গোৎসব দিয়ে শুরু, আর সরস্বতী পুজোতে বাৎসরিক উৎসবের ইতি! আমি অন্তত অনেকের মতো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত, দরাজ কণ্ঠস্বর, বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গীতে স্মৃতিমেদুর হই। এখনও বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে মহালয়ার অনুষ্ঠান হয়, তবে কেমন যেন কৃত্রিমতার ছাপ! প্রবন্ধকার দুর্গোৎসবের এ কাল সে কাল নিয়ে আঁকিবুকি কাটতে চেয়েছেন। আর্থিক ভাবে পশ্চাৎপদ মানুষজনের কাছে পুজোর আনন্দ এখনও অধরাই। তবে অনস্বীকার্য, দুর্গোৎসব মিলনমেলার চরিত্র হারায়নি।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১