—প্রতীকী ছবি।
সম্পাদকীয় ‘সংশয় এখনও’ (২১-১২-২০২৩), ‘সতর্কতার পালা’ (২৭-১২-২৩), ‘অগ্নিবলয়’ (২-১) এবং অদিতি মুখোপাধ্যায়ের উত্তর সম্পাদকীয় ‘সীমা ছাড়ানোর কিনারায়’ (২-১), অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘অতিবৃষ্টির কয়েক কাহন’ (৩-১)— পরিবেশ বিষয়ক এই লেখাগুলিতে মূলত বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হওয়া পৃথিবীর আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। জানা গিয়েছে, ২০২৩ সালের ১৭ ও ১৮ নভেম্বর পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পায়ন-পূর্ব বিশ্বের তাপমাত্রার থেকে দু’ডিগ্রি বেশি ছিল। গত বছরে নভেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত মোট ৮৬ দিন পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল শিল্পায়ন-পূর্ব বিশ্বের তাপমাত্রার থেকে দেড় ডিগ্রি বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা বার বার ঘটছে, হিমবাহ গলার কারণে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উষ্ণায়নের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিক ব্যবহার। গত বছর দুবাইতে হওয়া জলবায়ু সম্মেলনেও বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে।
যদিও বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি বিগত বেশ কয়েক বছরে রাস্তায় পেট্রল/ ডিজ়েলচালিত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বহু অর্থ লগ্নিকারী সংস্থা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিতে উৎসাহিত করছেন ক্রেতাদের। কিন্তু প্রয়োজন ছিল গণ পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতিসাধন। আরও বেশি করে বনাঞ্চল সৃষ্টি ও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেওয়ার দরকার ছিল। দেশে যে বনাঞ্চল কমেছে, তা উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে। নতুন বন সংরক্ষণ আইনেও বনাঞ্চল সৃষ্টির বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে বলে জানা যাচ্ছে। অদিতি মুখোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছেন— দেশে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন, পরিবহণ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিন গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি ও কৃষিতে তিন লক্ষেরও বেশি সোলার পাম্প বসেছে। কিন্তু এই সকল পদক্ষেপ যে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, তা তিনিও স্বীকার করেছেন। এটা অনেকটা সেই চৌবাচ্চার অঙ্কের মতো, একটি জলভরার পাইপ ও একটি বেরোনোর পাইপ চালু থাকলে চৌবাচ্চায় থাকা জল কখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না বা পারলেও তার স্থায়িত্ব বেশি ক্ষণ হবে না।
প্রায়শই চোখে পড়ছে উন্নয়নের নাম দিয়ে অবাধে গাছ কাটা, বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে, ছোট ছোট গলি রাস্তাকেও কংক্রিট দিয়ে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে তাই রাস্তা, উড়ালপুল ও অন্যান্য নির্মাণের কথা আসে, আসে না পরিবেশ বাঁচানোর কথা। অন্যতম কারণ বোধ হয়, পরিবেশ রক্ষা কোনও জনমোহিনী বিষয় নয়, এর থেকে দ্রুত অর্থ রোজগারও হয় না, বরং এর জন্য দরকার সহনশীল ও সংযমী হওয়ার দীর্ঘ অভ্যাস গড়ে তোলা। সম্পাদকীয়তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এই বলে— দীর্ঘ ও বিশদ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এখন এই কথাটি জানিয়ে দিয়েছেন যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না কমালে এবং ভূমিক্ষয় ও অরণ্য ধ্বংস-সহ প্রকৃতি সংহারের রকমারি ধ্বংস কাণ্ড রোধ না করলে বিশ্ব পরিবেশ যে সর্বনাশের কানাগলিতে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। এখন এই কথাগুলি জনগণকে বোঝাতে পারতেন যে প্রবল-প্রতাপান্বিত শাসক সম্প্রদায়, তাঁরা কি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এ কাজ করতে চাইবেন? পারলে তাঁরা আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি
করুণ ছবি
অশোক সরকারের প্রবন্ধ ‘বাজারের পাঠশালা’ (১৯-২) প্রসঙ্গে কিছু কথা। অসরকারি সংস্থা ‘অসর’ প্রতি বছরের মতো এ বারও এ দেশের প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষার মূল্যায়ন করে সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগের। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার এই করুণ প্রতিচ্ছবি বছরের পর বছর প্রকাশিত হচ্ছে, আমরা পড়ছি, আবার যথারীতি ভুলেও যাচ্ছি। সর্বস্তরেই গা ছাড়া মনোভাব। প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক না থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি অসম্ভব, এ কথা সকলেই জানি। কিন্তু দীর্ঘ দিন বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি থাকায়, লেখাপড়ার মান ক্রমশ নিম্নমুখী। অথচ, এই মানোন্নয়ন ও শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট তৎপরতা দেখাচ্ছে না। নিয়মমাফিক জামা-প্যান্ট, জুতো-মোজা, বই-খাতা, সাইকেল, দুপুরের খাবার ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকছে। আমরা অভিভাবকেরাও ওইটুকু পেয়েই সন্তুষ্ট থাকছি। সন্তানের শিক্ষা কত দূর এগোল বা কোথায় পিছিয়ে গেল, কেন ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে, সে খবরও রাখি না। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এ দেশের গ্রামীণ এলাকায় ১৪-১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের ২৫ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য থেকে মাতৃভাষায় লেখা বাক্য পড়তে পারছে না, ৫৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে তিন অঙ্কের সংখ্যাকে এক অঙ্কের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে পারছে না, ৪৩ শতাংশ একটা অতি সরল ইংরেজি বাক্য পড়তে পারছে না।
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার এমন করুণ চিত্র যদি সচেতন অভিভাবকদের সামনে আসে, তাঁরা কোন ভরসায় সন্তানকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাবেন? আর কিছু দিন এ ভাবে চলতে থাকলে, শহরের সরকারি স্কুলগুলি যেমন ছাত্রাভাবে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যে গ্রামের স্কুলগুলিরও যে অমন দশা হবে না, এ কথা কি হলফ করে বলা যায়? আর এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অভিভাবকেরা হয়তো তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য বেসরকারি স্কুলের বন্দোবস্ত করতে পারেন, কিন্তু অভাবী ঘরের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে? যে দেশের সরকারকে ৮০ কোটি মানুষের দু’বেলা বিনামূল্যে আহার জোগাতে হয়, সে দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কতটুকু তা নিশ্চয়ই হিসাব কষে বলে দেওয়ার দরকার হয় না। এই অভাবী ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে, কিন্তু কিছুই শিখবে না। স্বভাবতই ‘বাজারের পাঠশালা’ থেকেই রাজনীতি, সমাজ এবং ন্যায় অন্যায়ের বোধ তৈরি হচ্ছে ও হবে। ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর নেপথ্য কারিগরেরা এমন উপভোক্তা তৈরি করায় সদা তৎপর। কোনও ব্যক্তির ন্যায়-অন্যায় বোধটাকে ভোঁতা করে দেওয়ার প্রক্রিয়া যদি সমাজমাধ্যমের নেপথ্য পরিচালকদের দখলে চলে যায়, তখন স্বাধীন ভাবে চিন্তাভাবনা করার শক্তিটুকু আর অবশিষ্ট থাকে না। ওরা যে ভাবে চাইবে, সে ভাবেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চিন্তাভাবনা অগ্রসর হবে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদি বিষয় দূরে সরিয়ে রেখে মন্দির গড়া কিংবা মসজিদ ভাঙার বিষয়টা সামাজিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে। এ ভাবে দীর্ঘ দিন চলতে দিলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কাঠামোটাই ভবিষ্যতে নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দিতে পারে।
এত দিন বিদ্যালয় থেকে পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা যে শিক্ষা গ্রহণ করত, তাতে ওরা যেমন নিজের ভাল-মন্দ বিচার করতে শিখত, তেমনই দেশ ও দশের ভাল-মন্দের বিচারটাও করতে পারত। প্রথাগত শিক্ষার সেই বনিয়াদ কোনও ভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে, সমাজের অব্যবস্থার কারণগুলিকে চিহ্নিত করার দক্ষতা অর্জন করা তুলনায় কঠিন হবে। সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন ভাল মানুষের অভাব দেখা দেবে। ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’-এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোবাইলে পৌঁছে যাওয়া অসত্য ভিডিয়োকেও সত্য বলে ধরে নিয়ে অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে তা নির্দ্বিধায় ছড়িয়ে দেবে। তবে নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয় যেমন রক্ষা পায় না, ঠিক তেমনই সমাজ ক্রমাগত ‘বাজারের পাঠশালা’র মাধ্যমে দূষিত হতে থাকলে মুষ্টিমেয় বেসরকারি স্কুলের সুরক্ষাকবচ দিয়ে সমাজকে বাঁচানো যাবে না। সমাজমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচারিত ভিডিয়োসমূহ আমাদের সুস্থ চেতনার পরিসর নানা ভাবে সংক্রমিত করে বিপথে চালিত করছে কি না, ভেবে দেখা দরকার। ‘অসর’ রিপোর্ট সে দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা