‘এক হাতে প্রেম, অন্য হাতে প্রশ্ন’ নিবন্ধে (১৩-১) শিশির রায় লিখেছেন, “কী পেরেছিলেন, লেখা আছে ইতিহাসেই। নইলে মনীষীময় এই ভারতে এক সন্ন্যাসীর জন্মদিন কখনও একটা দেশের যুব দিবস হয়ে উঠতে পারত না।” যুব দিবসে বিবেকানন্দকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রাজনৈতিক শক্তির আস্ফালন আর অন্যের প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা ছাড়া আমরা কী করেছি? স্বামীজির ছবি নিয়ে দলীয় স্লোগান আর পতাকা হাতে একখানা মালা গলায় চাপিয়ে দিলেই কি ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হল? এই যুব দিবসেও নেতাদের শপথ নিতে দেখা যায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের জন্মভূমিকে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ হতে দেব না। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আর কী ভাবে হতে পারে?
ভারতে মনীষীরা কখনও অন্য প্রদেশের ভারতীয়দের, এমনকি অন্য দেশের মানুষকেও বিদ্বেষের চোখে দেখতেন না। তাই বিবেকানন্দ শিকাগোর ধর্ম মহাসভায় দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিলেন, “ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স অব আমেরিকা।” তথাকথিত যুবসমাজ যদি সত্যিই মনীষীদের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধাশীল হত, তা হলে তারা কি বলতে পারত না যে, বিদ্বেষ নয়, ভালবাসা দিয়ে ভারতের সব প্রদেশকে স্বামীজির আদর্শে গড়ে তুলতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? তা হলে যুব দিবস প্রকৃত অর্থে স্বামীজির শ্রদ্ধা দিবসে পরিণত হতে পারত।
মিহির কানুনগো
কলকাতা-৮১
ভ্রান্ত উদ্ধার
স্বামীজি কোথায় নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করে কী বলেছিলেন, তাঁর সেই কাজকেই আমরা অনুকরণ করব, শাস্ত্র-নির্দেশিত বিধিনিষেধ মানব না, যে হেতু বিবেকানন্দ মানতেন না। কিন্তু তাঁর ব্রহ্মচর্য, অসাধারণ সাধনজীবন, বেদান্ত শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, জীবের মঙ্গলের জন্য অনন্য প্রয়াস, এ সবের চর্চা করব না। যেটুকু আমাদের ভোগী জীবন যাপনের সমর্থনে উদাহরণ হিসেবে খাড়া করলে আমাদের সুবিধে হবে, সেটুকুই মানব— এ কেমন মানসিকতা? সুমন ঘোষ স্বামীজির কিছু আচরণের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, তিনি সব “ভেদভেদের গোড়া ধরে উপড়ে দিতে চেয়েছিলেন” (‘তোমার রক্ত, তোমার ভাই’, ১০-১)। ভারতের হিন্দু সাধুদের মধ্যে বিবেকানন্দ বোধ হয় সবচেয়ে ভ্রান্ত ভাবে উদ্ধৃত হন। মাছি যেমন বর্জ্যতেই বসতে পছন্দ করে, কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীও তেমন সনাতন ধর্মের শিক্ষার অসারতা বা অপ্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করার জন্য তাঁর মতো মহাত্মাদের কিছু ক্রিয়াকলাপ নিয়ে অধিক আলোচনায় মগ্ন। কিন্তু এঁদের আসল শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নন। স্বামীজির নিষিদ্ধ মাংসভক্ষণ তাঁকেই সাজে, আমাদের নয়। স্বামীজি আশীর্বাদ করুন, যেন তাঁর মতো গুরুভক্তি, ব্রহ্মচর্য, বেদান্তে ব্যুৎপত্তি আমাদেরও হয়। স্বীয় গুরুমহারাজের আদর্শের প্রচার, বহু জনের হিতের জন্য প্রাণপাত যেন আমরাও করতে পারি।
অরুণাভ সেন
কলকাতা-৭৮
শুধু রাজনীতি
রাজনীতির কারবারিরা স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনকে ভোট প্রচারের হাতিয়ার করল। দলের বিজ্ঞাপন হিসেবে স্বামীজির কাটআউট ব্যবহার করল। প্রতিযোগিতা চলল, কে কত বড় মিছিল ও সমাবেশ করে স্বামীজির বাড়ি পৌঁছতে পারে! বিবেকানন্দের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে শোভাযাত্রা করে পৌঁছে রাজনীতির ভাষায় একে অপরকে বিঁধতেও ছাড়েননি। জেলাগুলিতেও বড় বড় মঞ্চে নেতা-নেত্রীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে, বড় বড় ব্যানারে বিবেকানন্দের ছবির পাশে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর ছবি শোভা পাচ্ছে। কত বড় ধৃষ্টতা! যাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এত বড় আয়োজন, তাঁকে নিয়ে সামান্য দু’চারটে কথা ভিন্ন বাকিটা রাজনীতির কচকচানি। মুখে বলা হল, স্বামীজির আদর্শ আমাদের আদর্শ। এর চেয়ে বড় দ্বিচারিতা আর কী আছে? তিনি শুধু উপদেশ দেননি, নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন, কেমন ভাবে বাঁচা উচিত। তাঁকে নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হোক।
পরেশনাথ কর্মকার
রানাঘাট, নদিয়া
স্পর্ধা
১৮৯৮-এর দুর্গাপুজো মহাষ্টমী। ক্ষীরভবানী মন্দির, কাশ্মীর। স্বামী বিবেকানন্দ এক দরিদ্র কাশ্মীরি মুসলিম নৌকা মাঝির ছোট্ট মেয়েটির চোখে মা-রূপী ঈশ্বরকে অনুধাবন করলেন। সেই পিতার অনুমতি নিয়ে বিবেকানন্দ তাঁর কন্যার পূজা করলেন, পদযুগল স্পর্শ-সহ। বর্তমানে বেলুড় মঠের কুমারী পুজোর শিকড় এই ঘটনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। যারা ধর্মকে মূলধন করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, কাশ্মীরিদের আবেগে স্বার্থে মানবাধিকারে আঘাত করে, হাথরস, উন্নাও, বদায়ূঁর কলঙ্ককে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, দরিদ্রবিরোধী পদক্ষেপ করে, তারাও কী করে এই মহাত্মার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের স্পর্ধা দেখায়?
কাজল চট্টোপাধ্যায়
পিয়ারলেস নগর, সোদপুর
শিক্ষার মুক্তি
স্বামীজি ১৮৯৯ সালে ৩ জানুয়ারি মৃণালিনী বসুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “ইংলন্ডেও একথা শুনিয়াছি— ছোটোলোকেরা লেখাপড়া শিখিলে আমাদের চাকুরি কে করিবে?” বর্তমান ভারতের পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন জাগে, এই ভাবনাই কি শাসক শ্রেণিকে গ্রাস করেছে? না হলে শিক্ষার বেসরকারিকরণ করে শুধু ধনীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কেন? আশঙ্কার প্রধান কারণ, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। দ্বিতীয় কারণ, রাজ্যে গজিয়ে ওঠা বেসরকারি বিদ্যালয়ের নামের তালিকা এবং সেই বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পরিবারের অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি। তৃতীয় কারণ, সরকারি সিলেবাসের অসারতা এবং বিষয়বস্তু নির্বাচনে রাজনীতি। যাঁরা এই সব ঘটাচ্ছেন, তাঁরাই রবীন্দ্রপ্রেমী হওয়ার চেষ্টা করছেন, নেতাজির মূর্তিতে মালা দিয়ে দেশপ্রেমের নাটক করছেন, বিবেকানন্দের বাণী আওড়ে বিবেকবান সাজার চেষ্টা করছেন।
সনাতন পাল
বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
সমবায়
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কর্মতাপস প্রফুল্লচন্দ্র’ প্রবন্ধের (পত্রিকা, ৯-১) প্রেক্ষিতে জানাই, স্বদেশ-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ১৯০৮ সালে রাড়ুলিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাড়ুলি সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। উদ্দেশ্য ছিল, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষদের সমবায় আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা। ব্যাঙ্কটি সমবায় আইনে নিবন্ধীকৃত হয়েছিল ১৯০৯ সালে। শতবর্ষ অতিক্রান্ত ব্যাঙ্কটি এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথও রাজশাহীর পতিসরে ১৯০৫ সালে কৃষি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে সরকার কৃষিঋণ মকুব করায় ব্যাঙ্কটি ঋণজর্জরিত হয়ে বিলুপ্ত হয়। জানা যায়, ব্যাঙ্কটি সমবায় আইনে নিবন্ধীকৃত ছিল না; যদিও ১৯০৪ সালে ভারতে প্রথম বিধিবদ্ধ সমবায় আইন চালু হয়েছিল।
প্রসন্নকুমার কোলে
শ্রীরামপুর, হুগলি
লেবুর সিরাপ
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আমার ঠাকুরদা পূর্ণচন্দ্র রায়চৌধুরীর আপন সেজদা ছিলেন। ঠাকুমা, বাবার কাছে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। গ্রীষ্মাবকাশে তিনি ছাত্রদের নিয়ে রাড়ুলি গ্রামে আসতেন। কখনও আনারস, কখনও লেবুর গন্ধযুক্ত সিরাপ গ্রামবাসীদের খেতে দিতেন, যেগুলি তাঁরই তৈরি। মা ভুবনমোহিনীর নামে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, পিতার নামে হরিশ্চন্দ্র ইনস্টিটিউশন হাই স্কুল স্থাপন করেন। আমার বাবা, তাঁর প্রিয় ছাত্র, আজীবন ওই স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
শিখা সেনগুপ্ত (রায়চৌধুরী)
কলকাতা-৫১