‘এক নিঃসঙ্গ পথযাত্রী’ (২৮-১) শীর্ষক প্রবন্ধে সুরঞ্জন দাস স্বাধীন ভারতে জওহরলাল নেহরুর ভূমিকা সম্পর্কে নির্মোহ আলোচনা করেছেন। নেহরুর নিঃসঙ্গতার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। যে প্রবল সাম্প্রদায়িক চাপকে ঘরে-বাইরে অতিক্রম করে, একটা আধুনিক ভারতের জন্য পণ্ডিত নেহরু আমৃত্যু লড়াই করে গিয়েছেন, সেই লড়াইয়ের ফলেই কিন্তু শত ষড়যন্ত্রকে অস্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষতা এখনও টিকে আছে ভারতের বুকে।
সর্দার বল্লভভাই পটেলের জীবদ্দশায় মন্ত্রিসভার ভিতরে পণ্ডিত নেহরুকে কী ধরনের রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীলদের চাপ সহ্য করতে হয়েছিল, তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তকে অতিক্রম করার জন্যই নেহরুকে মেনে নিতে হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ঝোঁককে। নেহরু নিজে ভারতের সমন্বয়বাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রসঙ্গত, শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী দর্শন এক অর্থে তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করেছিল। তাঁর পত্নী কমলা নেহরু ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী সন্তান স্বামী শিবানন্দের (মহাপুরুষ মহারাজ) মন্ত্রদীক্ষিত। শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়বাদী দর্শন নেহরুর বহুত্ববাদী ভারতকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টার একটা প্রেরণা ছিল। সেই সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব।
দেশভাগের অব্যবহিত পরেই কিন্তু সেই সমন্বয়বাদী চেতনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য নেহরুর উপরে তাঁর দলের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের চাপ আসে। তার নেতৃত্বে ছিলেন বল্লভভাই পটেল। ছিলেন গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, রাজেন্দ্র প্রসাদ, বসন্ত শ্রীহরি আনের মতো ব্যক্তিত্ব। পটেলের চাপে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাজেন্দ্র প্রসাদকে মেনে নিতে হয় নেহরুকে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও। নেহরু দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে চেয়েছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীকে। মনে রাখা যেতে পারে, ক্রমে যে এই ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়া দেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের দ্বার আবার উন্মুক্ত হল, তার পিছনে রাজেন্দ্র প্রসাদের একটা ভূমিকা ছিল। সোমনাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নেহরুর পরামর্শ উপেক্ষা করেই। কেন পঞ্চাশের দশকে নেহরু বাধ্য হয়েছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নিজের কাঁধে বহন করতে, তা সুরঞ্জনবাবু স্বল্প পরিসরে অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে তুলে ধরেছেন।
আজকের ভারতে যখন আরএসএস-বিজেপি নেহরুকে মুছে দিতে চাইছে, ঠিক তখনই বাঙালির শভিনিজ়ম-কে জাগিয়ে দিতে নেহরুর জায়গায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসুর কথা তুলে ধরার কথাও শোনা যাচ্ছে। নেহরুর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়াইকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
গৌতম রায়
ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
নিঃসঙ্গ সুভাষ
‘এক নিঃসঙ্গ পথযাত্রী’ শিরোনামে যদি কারও জীবন বর্ণিত করা যায় তবে তিনি সুভাষচন্দ্র বসু, যাঁর সমস্ত রাজনৈতিক জীবনটি একাকী সংগ্রামের আখ্যান। সুরঞ্জন দাস অবশ্য ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেই বেছে নিয়েছেন। যদিও তিনি প্রথমেই তাঁর বক্তব্যকে ‘নেহরুপন্থার রক্ষণশীল বিচার’ ভাবতে নিষেধ করেছেন, তবুও এই লেখার প্রতিটি ছত্রেই নেহরু বর্ণিত হয়েছেন এক সৎ, বামপন্থী মনোভাবাপন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে, সময় ও পরিস্থিতি যাঁকে তাঁর আদর্শের প্রতি স্থির থাকতে দেয়নি। অনেকেই জানেন, নেহরুর বামপন্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাত্ত্বিক আনুগত্য ছিল, কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রগঠন ও চালনার ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেননি। লেখকও তার কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কারণ হিসাবে লেখক বলেছেন পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পরিস্থিতি, পার্টি নেতৃত্বের প্রতিবন্ধকতা। আমরা জানি, তাত্ত্বিক ভাবে কোনও আদর্শকে সমর্থন করা এক বিষয়, আর জীবনে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাকে প্রয়োগ করা ভিন্ন। যাঁরা করতে পারেন, ইতিহাস তাঁদেরই মনে রাখে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুধু নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামকালেও নেহরু তাঁর প্রচারিত আদর্শ মানেননি। কংগ্রেসের ভিতর দক্ষিণপন্থী মনোভাবাপন্নদের আধিপত্য স্বাধীনতার আগে থেকেই, গান্ধীবাদী চিন্তার প্রভাব প্রথম থেকেই, তা তার শ্রেণিচরিত্রের জন্যেই। স্বাধীনতা আন্দোলনের নীতিগত ও কৌশলগত প্রশ্নে কংগ্রেস সব সময়ই আপসের রাস্তাতে চলেছে। আপস ও আপসহীনতার দ্বন্দ্বে নেহরু আপসের রাস্তা বেছে নিয়েছেন সর্বদা। অন্য দিকে, পার্টির মধ্যেই নেতাজির নেতৃত্বে যে আপসহীন বামপন্থীরা ছিলেন, তাঁদের বিরোধিতা করেছেন।
নেহরু কি জানতেন না যে, নেতাজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গান্ধীবাদীদের সমর্থন করা আসলে বামপন্থার বিরোধিতা? তিনি কি বোঝেননি, গান্ধীবাদের আপসমুখী পথ দেশের ধনিক শ্রেণির হিতসাধন করবে, গরিব কৃষকের নয়? তা-ও তিনি কখনও কংগ্রেসের মধ্যে চলতে থাকা দক্ষিণপন্থার ষড়যন্ত্রকে রোধ করার চেষ্টা করেননি। তাই পরবর্তী কালে নেহরুর আদর্শ বিচ্যুতি আকস্মিক নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপ নয়, এ তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কংগ্রেসের মধ্যেই বামপন্থী মনোভাবাপন্নদের একত্রিত করা নেতাজির উদ্যোগ, নেহরুর নয়। হরিপুরা অধিবেশনে নেতাজির ভাষণ ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলিতে নেতাজিকে কার্যত অপসারিত করায় গান্ধীবাদীদের যে কার্যক্রম, সেখানে নেহরুর অবস্থান থেকেছে সর্বদা নেতাজি-বিরোধী, তাঁর মতে, “কংগ্রেসের মধ্যে এই সমস্যার জন্য নেতাজিই দায়ী।” কুখ্যাত পন্থ প্রস্তাবকে সমর্থন করে নেতাজিকে কংগ্রেসে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলাকে সমর্থন করেছেন, ও সামগ্রিক ভাবে কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থার চর্চাকে এগিয়ে যেতে দেননি। কংগ্রেস থেকে কার্যত বিতাড়িত হয়ে নেতাজি তাঁর অনুসৃত বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যেই দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে এগিয়েছেন। ত্রিপুরি অধিবেশনের এক মাসের মধ্যে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন, গোটা দেশের বামপন্থী শক্তিগুলিকে একত্রিত করে ‘লেফট কনসলিডেশন’ গড়ার আহ্বান, দেশ জুড়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দান, রামপুরায় অধিবেশন, তাঁর কথা ও কাজেও তিনি সোভিয়েট ইউনিয়ন-সহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন করে গিয়েছেন। অন্য দিকে, নেহরুর বক্তব্য ও রচনায় বহু স্থানে আমরা সমাজতন্ত্রের সমর্থন পেলেও, দেশীয় সংগ্রামে তার প্রয়োগযোগ্যতা অস্বীকার করেছেন, তার নিদর্শন আমরা নেহরু-রচিত গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি বইয়ে পাই।
নেহরু যতই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, রাজনীতির প্রবক্তা হন, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বা বাইরে রাজনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়ার সংগ্রামে যোগ দেননি। যার কুফল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ ও তৎপরবর্তী দাঙ্গা। অন্য দিকে, নেতাজি শুধু কথাতেই নয়, কাজেও অবিরাম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন, হিন্দু মহাসভা-সহ সমস্ত উগ্র ধর্মীয় সংগঠনকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দেওয়ার প্রত্যক্ষ আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, আজাদ হিন্দ ফৌজে আবিদ হাসান ও অন্যান্যরা সর্বধর্মসমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে গান রচনা করতে চাইলে নেতাজি বাধা দিয়ে বলেন, তাঁদের লড়াইয়ে ঐক্যের ভিত্তি ধর্মীয় সমন্বয় নয়, একবর্ণী জাতীয়তাবাদ।
নেতাজির সঙ্গে নেহরু বা গান্ধীজির যে সংঘাত, তাকে ব্যক্তিগত বা ক্ষমতার সংঘাত ভাবলে ভুল হবে, তা প্রকৃতার্থেই আদর্শগত বিরোধ। নেতাজির কথায়, “কংগ্রেসের মধ্যে চলা এই সংগ্রামের পিছনে রয়েছে শ্রেণিসংগ্রাম।” তাই প্রবন্ধের শেষে লেখক যে আহ্বান রেখেছেন, যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ফিরে তাকাতে বলেছেন, সেই অনুসারেই নেহরুর পরিবর্তে নেতাজি সুভাষের জীবন ও আদর্শ স্মরণ করতে হয়।
নয়ন পাঠক
কলকাতা-৯১
দৃষ্টিহীনদের জন্য
২০২০ সালের মার্চ থেকে সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির পাশাপাশি দৃষ্টিহীনদের প্রাথমিক বিদ্যালয়েও অফলাইনে পঠনপাঠন বন্ধ। দৃষ্টিহীন শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত ব্রেল পদ্ধতি। শিক্ষকগণ তাদের হাতে ধরে এই পদ্ধতি শেখান। পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক পড়ানো চলে। এই শিক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে প্রদান করা সম্ভব নয়। তাই এই ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না করলে অশিক্ষার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে অনেক শিশু।
মনোজিৎ মণ্ডল
রঘুনাথপুর, নদিয়া