প্রতীকী ছবি।
সন্দীপন নন্দী ‘শিশু যে স্কুলবাজারের পুঁজি’ (২২-১০) লেখাটিতে শিশুশিক্ষার বর্তমান অবস্থা চমৎকার তুলে ধরেছেন। ১৯৬৯-২০১১ পর্যন্ত টানা ৪২ বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথমে সহকারী শিক্ষক এবং পরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করার সুবাদে এই বিষয়ে কিছু কথা বলি। আমাদের সময়ে স্কুল তৈরি করতেন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে খুঁজে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হত, পাড়ার শিক্ষিতদের খুঁজে খুঁজে শিক্ষক/শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করা হত। বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির সদস্যরা নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন, কে কেমন পড়াচ্ছেন, ছাত্রদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না।
ইদানীং এ দেশে টাকার জন্য নিজেদের বাড়িতে বা ভাড়া-বাড়িতে স্কুল খোলা শুরু হয়েছে। নানা কারণে এখন আর সরকারি স্কুলগুলি অভিভাবকদের পছন্দের তালিকায় থাকছে না। তাঁরা তাঁদের পকেটের শক্তি বুঝে শিশুশিক্ষার জন্য স্কুল খুঁজে বার করেন। সে স্কুলের শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ বা পরিকাঠামো কতটুকু আছে, তা বুঝে নেওয়ার সামর্থ্য বা ইচ্ছা কোনওটাই তাঁদের নেই। যেখানে ভিড় বেশি, সেখানে শিশুকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। এক দমবন্ধ করা পরিবেশে শিশুরা বড় হয়। মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে এরাই কিছু দিন পরে অনেকে জেদি, একগুঁয়ে, অবাধ্য বা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। পরিবারে, স্কুলে, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে শুরু করে দেয়। সে সব খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ শিরোনামে এসে সমাজের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে।
ভিড় বাড়ে মনোচিকিৎসকদের চেম্বারে। এ বিষয়ে আগেভাগে সচেতন করতে অনেক সংগঠনই এখন কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু এখনকার মা-বাবারা বেশির ভাগই সে-সব কথাকে ঠিক সময়ে মান্যতা দিতে চান না। পরে সমস্যা দেখা দিলে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখান।
আসলে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য উভয় সরকারই স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো শিক্ষাকেও বেসরকারি উদ্যোগের হাতে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে চায়। তাই তারা ৯৭ দফা চেকলিস্ট মিলিয়ে প্লে-স্কুলকে ছাড়পত্র প্রদান করাটা খুব জরুরি বিষয় মনে করে না। আর বাজার শুধুমাত্র মুনাফার পরিমাণ নিয়ে চিন্তা করে। এ ভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্মের একটা বৃহৎ অংশই এ দেশের নাগরিক দায়িত্ব পালনে অক্ষম হবে, সে কথা কে-ই বা ভাবছে?
রতন রায়চৌধুরী
কলকাতা-১১৪
বিভাজন
আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অর্থনীতি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়াশোনা করেছিলেন। কলকাতা শহরে ও প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি চর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে— ভবতোষ দত্ত, ধীরেশ ভট্টাচার্য, মিহির রক্ষিত, অমিয় বাগচী প্রভৃতি— ভারতীয় অর্থনীতির চর্চাকে পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে আনতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
আমাদের সময়ে, সম্ভবত এখনও, অর্থনীতি অনার্স পঠনপাঠনে পাশ্চাত্য অর্থনীতির জন্য তৈরি মডেলেরই রমরমা। তাত্ত্বিক অর্থনীতিতে, যেমন মাইক্রো-ইকনমিক্স এবং ম্যাক্রো-ইকনমিক্স পড়ানোর বইগুলিতে, আমেরিকা ও ব্রিটিশ দেশের উদাহরণই বেশি থাকে। অতএব সেই সব দেশের মানুষের চোখ দিয়েই ‘অর্থনীতি’ বিষয়টা চেনা, জানা ও বিশ্লেষণ করার শিক্ষা ছেলেমেয়েরা পায়। ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় (আমাদের ছাত্রাবস্থায় আবার রাশিয়া ও ব্রিটেনের অর্থনৈতিক জাগরণের বৃত্তান্ত পড়ানো হত, এখন আর তা হয় না) এই তাত্ত্বিক শিক্ষার আলোতেই বিশ্লেষণ করা হয়।
এর পাশে আবার, ভারতীয় অর্থনীতির পেপারটি যাঁরা পড়ান তাঁরা তুলনায় কম গুরুত্ব পান। পাঠ্যক্রমের মধ্যেই একটা অদৃশ্য এলিটিজ়ম-এর বিভাজন রেখা আছে। আসলে, এক সময়ে ভারতীয় অর্থনীতির আলোচনায় যুক্তিগ্রাহ্য মডেল (বিশ্লেষণের কাঠামো) কম ছিল, তথ্যের ভিড় ছিল বেশি।
আনন্দের কথা, অভিজিৎবাবুদের মতো শিক্ষকদের চেষ্টায়, ‘অর্থনীতি’ বিষয়টা অনুন্নত দেশের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পক্ষে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দারিদ্র দূরীকরণ ল্যাবরেটরি (পরীক্ষাগার) নামটি গালভরা মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁরা এখানে কাজের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন, শ্রেণিকক্ষের বাইরে অর্থনীতি বিষয়টিকে নিয়ে আসতে। অভিজিৎবাবুর পূর্বসূরি, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের দারিদ্র-সূচক (poverty index) পৃথিবীর সব অর্থনীতি বিভাগে পড়ানো হয়ে থাকে। অভিজিৎবাবু ও তাঁর সহযোগীদের কাজ তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে গেল, হাতেনাতে গরিবদের মধ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনার মূলস্রোতে নিয়ে এল।
স্বামী ত্যাগরূপানন্দ
রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, মালদহ
নিয়ন্ত্রণ ভাল
2 ‘রাহুমুক্তি বিলগ্নিতে, বার্তা অভিজিতের’ (২৩-১০) প্রতিবেদন সম্পর্কে এই চিঠি। অভিজিৎবাবুর যুক্তি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ না সরলে ভিজিল্যান্স কমিশনের আতঙ্ক থাকছে। যার ফলে ব্যাঙ্ক কর্তারা ঋণ শোধ না হওয়ার তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রাখছেন, আর এ ভাবে বিপদ ঠেকিয়ে রাখা যখন অসম্ভব হয়ে উঠছে, তখনই ভেঙে পড়ছে ব্যাঙ্ক।
শুধু তা-ই নয়, ব্যাঙ্কে সরকারি অংশীদারি ৫০ শতাংশের নীচে নামানোরও সওয়াল তিনি করেছেন। আবার তিনিই পরে বলছেন, ‘‘ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিটে যথেষ্ট তথ্য মিলছে না। আজকে ব্যাঙ্ক ভাল অবস্থায়, তো পরের দিন সঙ্কটে। তাই আরও নজরদারি জরুরি।’’ এই দু’টি পর্যবেক্ষণ তো সাদা চোখে পরস্পরবিরোধী বলেই মনে হচ্ছে।
সাধারণ এক জন ব্যাঙ্ককর্মী হিসেবে আমার মনে হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই কিন্তু ২০০৮ সালের দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও আমাদের দেশে তার প্ৰভাব পড়তে পারেনি। এ ছাড়া সামাজিক যে সব দায়-দায়িত্ব ব্যাঙ্কগুলি গত ৫০ বছর ধরে পালন করে আসছে, তাও কি সম্ভব হত, তাদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকলে? জনধন প্রকল্পের মতো এত বড় মাপের সামাজিক কর্মকাণ্ডও কি দিনের আলো দেখতে পেত? নিশ্চয়ই না। বর্তমান ব্যাঙ্কশিল্পে যেটা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন: এক দিকে পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান, অন্য দিকে ঋণদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা আর অনাদায়ী ঋণ আদায়ের ব্যাপারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্যোগ।
গৌতম নারায়ণ দেব
কলকাতা-৭৪
স্বীকৃতির মূল্য
2 বিজ্ঞান মহলে কঠিন পরিশ্রম, গভীর অনুধাবন, প্রাণঢালা গবেষণা, বিস্তর লেখালিখি চলে বছরের পর বছর। সবাই যে গবেষণা করেন শুধু নোবেল প্রাইজ় লাভের ইচ্ছাতেই, তা কখনওই নয়। সবাই কিন্তু স্বীকৃতি পেতে চান। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও বলেছেন, মাস তিনেক আগেও কলকাতায় এসেছিলেন। তখন কেউই অপেক্ষায় ছিল না। এ বার বদলে গিয়েছে ছবিটা। (‘আপাতত কথা নয়...’, ২৩-১০)। কথাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, শুধু ভাল কাজই যথেষ্ট নয়, স্বীকৃতিও চাই। সেখানেই প্রশ্ন ওঠে, মেধা মূল্যায়নে, মেধা বিকাশে, আমরা কোনও বেড়া দিচ্ছি না তো? খোলা মনের ভাবনাকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলতে চাইছি না তো? সর্ব স্তরে অনুগামীদের জায়গা করে দিতে দিতে যোগ্যদের দিনের পর দিন হতাশ করে দিচ্ছি না তো? ভাল প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো কাজ করতে না দিয়ে, যা খুশি তাই বানাতে চাইছি না তো? আর এই প্রশ্নগুলোর যদি সদুত্তর না থাকে, তা হলে, আমাদের সন্তানদের বিদেশে গিয়ে খেটে কাজ করেই স্বীকৃতি পেতে হবে। তখন আমরা বরণ করতে এয়ারপোর্টে যাব, ফুলের মালা দেব, শাল দেব, মিষ্টি খাওয়াব। আর নেচে বলব, ‘‘এ তো আমাদের, আমার পাড়ার।’’ নীরবে কাঁদতে থাকবে হাজারো মেধা।
সুকুমার বারিক
কলকাতা-২৯