জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পবোদ্ধা, তাই বেয়াড়া’ (৩-১২) সাহসী প্রবন্ধ। হ্যাঁ, এটা কঠিন সময়। এ সময়ের স্বরূপকে বোঝাতে হলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে দুটো লাইন ধার নিতে হয়— “তখন হিংসেয় জ্বলছে শহর, মানুষের হাতের ছুরি গেঁথে যাচ্ছে/ মানুষেরই বুকে/ রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম/ রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম।” এই কঠিন সময় সমস্ত রাস্তা শাসকের মগজধোলাই করা অবৈতনিক সিপাইদের দখলে। আমরা যারা চিলেকোঠায় বন্দি, তারা যত বার চিৎকার করে সত্যিটা বলতে চাই তত বার সিপাইরা ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং...’, ‘আরবান নকশাল’ বলে তেড়ে আসে।
ইজ়রায়েলের চলচ্চিত্রকার নাদাভ লাপিদ যে মুহূর্তে, শাসকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৈরি করা ছবি কাশ্মীর ফাইলস-এর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, সঙ্গে সঙ্গে লাপিদেরই যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবাণ ছোড়া শুরু করল শাসকের সিপাইরা। “ছবি দেখা আর দেখতে শেখা, দুটো এক জিনিস নয়”— প্রবন্ধের এই বাক্যটিই এই মুহূর্তে আমাদের প্রতিবাদের মূল ধ্বনি হওয়া উচিত। ছবি দেখায় উৎসাহের অভাব নেই মানুষের, অভাব ছবি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতায়। তাই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের কাজে লাগাচ্ছে শাসক ও তার অনুগতরা। যাঁরা প্রোপাগান্ডার শিকার হচ্ছেন, তাঁরাই শুধু জানতে পারছেন না যে, কী অবলীলায় তাঁদের অপরিপক্ব মনকে নাড়া দিয়ে এক মিথ্যে ইতিহাসে বিশ্বাস করানো হল।
ছবির ভাষা বা দৃশ্যের যে কোনও সীমানা হয় না, সে কথা সহজ ভাষায় প্রচার করার চেষ্টা হয়েছে বহু বার। কিন্তু মগজ ধোলাইয়ের মন্ত্র এক দল মানুষের মাথার এতই গভীরে কাজ করছে যে, তাঁরা এ সব বুঝতে অপারগ। কাজেই, আশা সত্যিই ক্ষীণ। যাঁরা অন্য ধারার ছবি তৈরির চেষ্টা করছেন, তাঁদের পথ আজ দুর্গম। বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা যেখানে হচ্ছে সেখানে আসন শূন্য রেখে নেতাদের নানা ছেঁদো মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের সভায় আসন ভরিয়ে দেওয়াতেই যেন মানুষের আনন্দ।
সৌমাল্য চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৩২
পশুর জীবন
ভয়ঙ্কর এক অর্থনৈতিক গন্তব্যের পথ নির্দেশ করেছে ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। আমাদের দেশে সমস্যাটা গভীরতর। করোনার প্রভাবে বাইরের অসুস্থতা জাঁকিয়ে ধরার আগে থেকেই অর্থনৈতিক অসুস্থতার কিছু কিছু লক্ষণ ফুটে উঠছিল। এই দেশের মূল ভাগ্যনিয়ন্তা হল নির্বাচনী রাজনীতি। সম্প্রতি বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় একাধিক স্থান অলঙ্কৃত করছেন অল্প ক’জন ভারতীয়। তাঁদের ঝুলি কিন্তু মূলত ভরেছেন নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরা। অথচ, এ দেশে সেই কর্মীদের অর্থনৈতিক দশা ক্রমশ মন্দ হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে শিল্প, শিক্ষা কি চিকিৎসা ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত। অন্য দিকে, পর পর খুলে চলেছে বেসরকারি স্কুল, নার্সিংহোম। সরকারি ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মী সঙ্কোচন চলছে। স্থায়ী পদেও অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। থোক মাইনে, কর্তাভজনায় যোগ্যতা দেখাতে পারলে আবার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি নবীকরণ হবে। এর মধ্যে কোভিড-জ্বর এসে পড়ায় পুঁজি-কর্তাদের পোয়াবারো। অফিসে আসার প্রয়োজন নেই বলে কাজের নির্দিষ্ট সময়ও নেই। এমনই কাজের চাপ যে, ঘুমের সময়টুকু মিলছে না।
এখন আমরা নানা নিদান শুনি। যেমন, সমাজকল্যাণের সমস্ত ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দিলে কাজের জোয়ার আসবে। শিল্পস্থাপন সরকারের কাজ নয়। বিলগ্নিকরণ চাই। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেচে দাও, উপচে পড়বে রাজকোষ। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্পোৎপাদন, অর্থনৈতিক পরিষেবা— সব কিছু বেসরকারি ক্ষেত্রে দ্রুত বেড়ে ওঠে। কারণ, সেখানে লাভ হয় বেশি। তাই সব চাকরির উপরে ‘অস্থায়ী’, কি ‘চুক্তিভিত্তিক’ ছাপ মেরে দেওয়া চাই। কর্মীদের কোনও রকম শিকড় গজাতে দেওয়া যাবে না, যে কোনও সময় যাতে উপড়ে ফেলে দেওয়া যায়। পেনশন কিংবা অপর কোনও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার কোনও দায় সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। শুধুই পেটের প্রয়োজন মেটাতে মধ্যরাত কি আরও দেরি পর্যন্ত কাজ করছেন কর্মীরা। তার পরেও চিন্তা, এত করেও কি ঝুলন্ত খাঁড়াটা ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
রোজগারহীনতা এক বেয়াড়া সমস্যা। ভোটবাক্সের প্রয়োজনে দেওয়া হয় প্রভূত আশ্বাস, কথার ঝকঝকে মোড়কে নানা অসার প্রতিশ্রুতি। প্রয়োজন মিটলেও সব মনে থাকে না কারও। সাম্প্রতিক রাষ্ট্র কি রাজ্যের প্রধানের হাত দিয়ে নিয়োগপত্র বণ্টিত হচ্ছে। গোছা গোছা নিয়োগ। অনেকেই চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে ফিরে আসছেন। ঘটনাগুলি কিসের ইঙ্গিতবাহী, কে জানে। বাক্যের ম্যাজিক আর তেমন কাজ করছে না বলেই কি চিঠি ধরাতে হচ্ছে? পাশাপাশি চলছে মিছিল, অবরোধ, ধর্না।
কথায় বলে, ভাড়া করা সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। অথচ, আর্থিক দায়িত্ব নেবেন না বলে আমাদের সরকার অস্থায়ী, পার্টটাইম, ক্যাজুয়াল কর্মী দিয়ে কাজ চালাতে চাইছেন। দেশের প্রতিরক্ষাতেও গালভারী নাম দিয়ে কার্যোদ্ধারের উদ্যোগ করা হয়েছে। আজকের তরুণ-তরুণীরা হয়তো এ ভাবেই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের। কিন্তু বাংলার সোঁদা মাটির মানুষের মনোজগতে সংস্কৃতির একটা আলাদা পরিসর ছিল বরাবর। অফিসফেরতা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে রাশিয়া-আমেরিকার সাম্প্রতিক কার্যকলাপ পর্যালোচনা, আগের রবিবারে অ্যাকাডেমিতে দেখে আসা নাটক নিয়ে বিতর্ক, বাড়ি ফিরে টিভির সামনে ছেলেমেয়ের সঙ্গে হুড়োহুড়ি— এ সব না করতে পারলে ভিতরের মানুষটা বাঁচে না। তাতে রাষ্ট্রনেতা বা ধনকুবেরদের বিশেষ ক্ষতি হয় না। হয় শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, চলচিত্র এবং সর্বোপরি সুস্থ সমাজজীবনের ক্ষতি, যা থেকে অবক্ষয়ের শুরু। পেটের প্রয়োজন মেটাতেই যদি দিন কাবার হয়, হৃদয় আর মাথার তবে কী হবে? জীবন তখন পশুর পর্যায়ে নেমে আসে। এ দেশের সনাতন দর্শন কোনও দিন তা মেনে নেয়নি। ভাগ্যনিয়ন্তারা যত শীঘ্র সেটা বুঝবেন ততই মঙ্গল। আপাতলাভের জন্য অন্তরসম্পদটুকু খুইয়ে ফেললে সময় কিন্তু ক্ষমা করবে না।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
বিস্মৃত মর্যাদা
‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’ (২৫-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে সুমন সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন যে, প্রযুক্তি-নির্ভর সংস্থার চাকুরেদের সঙ্গে কোভিডের সময় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের কোনও পার্থক্য নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে মনে রাখা দরকার, সমস্ত কিছুই চালিত হচ্ছে পুঁজির নিয়মে। চিকিৎসকের পেশাও ব্যতিক্রম নয়। ডাক্তারি পাশ করে অনেকেই ভাবেন, এমবিবিএস ডিগ্রি পেয়ে গিয়েছি, আর চিন্তা নেই, ভাল মাইনের চাকরি নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবন কেটে যাবে। দশ-পনেরো বছর আগে এমনটাই ভাবত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া ছেলেমেয়েরা। প্রচুর বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খোলার পর আজকে ইঞ্জিনিয়ারদের কী অবস্থা? বাজারে তো একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছে যে, ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে আর সব কিছু করে। এটাই পুঁজির নিয়ম। এই নিয়মের ফাঁদে পড়েই ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ‘নোবল প্রফেশন’-ও আজ নিছক ব্যবসা! অনেকে তাই সরাসরি বলেও দেন, “এত টাকা খরচ করে এমবিবিএস পড়লাম, তা পয়সা কামাতেই তো!” বুঝেশুনে, অথবা অজানতেই নিজের মনুষ্যত্ব, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ডাক্তারি পেশার প্রতি শ্রদ্ধা, মানুষের প্রতি দরদ— সব কিছু ভুলে গিয়ে এক জন ডাক্তারও অনেক সময় নেমে পড়েন টাকা কামানোর দৌড়ে।
সেই দিন দূরে নেই, যে দিন ডাক্তারদেরও চাকরি পেতে ঘাম ছুটে যাবে। কম বেতনে অমানুষিক খাটনি খাটতে হবে। ডাক্তাররা যে নিছক শ্রমিক ছাড়া আর কিছুই নন, তা প্রকট ভাবে বোঝা যাবে। তাই লড়াই চাই এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে।
অনুপম রায়, দত্তপুকুর, উত্তর ২৪ পরগনা