ঈশা দাশগুপ্তের ‘নিজ পদবিতে বাঁচার অধিকার’ (১২-৯)লেখাটি সম্পর্কে কিছু বলতেই এই চিঠির অবতারণা। এই আলোচনা কিছু দিন আগেও অপ্রাসঙ্গিক ছিল। বিবাহের পর ভারতীয় মেয়েদের স্বামীর পদবি গ্রহণ করাটাই চিরকাল ধ্রুব সত্য বলে জেনে এসেছি। সেই নিয়মের পরিবর্তনের প্রয়োজন যে আদৌ আছে, এখনও এই কথা অনেককে বোঝাতে রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়! বিয়ের পরে শ্বশুরকুলের পদবি নামের শেষে না জুড়লে নাকি তাঁদের উপযুক্ত সম্মান দেখানো হয় না। যাঁরা একটু স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে চান, তাঁরা নাকি সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত। ও সব সাধারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে একেবারেই চলে না— এখনও এমন যুক্তি দেখাবেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষ।
ভারতীয় আইনে কোথাও লেখা নেই যে, বিয়ের পরে স্বামীর পদবি নেওয়া ভারতীয় মহিলাদের আইনত উচিত। কিন্তু এটাই আমাদের দেশে প্র্যাকটিস এবং বেশির ভাগ মহিলা সেটাই করে থাকেন। এখনও অনেক পরিবার বিশ্বাস করে, স্বামীর পরিচয়েই স্ত্রী’র পরিচয়। আর স্বামীর পরিচয় বহন করলে তবেই একে অন্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। এ ছাড়াও দু’জনের পদবি আলাদা হলে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিতে পারে। যদিও এই সব তথ্যের কোনও গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই।
পরিচয় শুধু নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না, পরিচয় থাকে কাজে এবং ব্যক্তিত্বে। স্বামীর পদবি কখনও এক জন নারীর পরিচয় হয়ে উঠতে পারে না। বিয়ের আসরে গোত্র পরিবর্তন হওয়ার পরই ধরে নেওয়া হয় যে, মেয়েটি এ-বার তাঁর স্বামীর পদবিই ব্যবহার করবেন। এই প্রথা চালু করার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই। যেন নববধূকে সবাই এই পরিবারের সদস্য হিসেবে চিনতে পারেন। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে সেই ভাবনায় অনেক বদল এসেছে। বরং বহু মেয়ে নিজেরাই বুঝিয়ে দেন, কেন এই পদবি পরিবর্তন অপ্রয়োজনীয়।
বিবাহের পর পদবি পরিবর্তনের বেশ কতকগুলি সমস্যাও আছে। প্রথমত, আত্মপরিচয়ের সমস্যা! কাল অবধি ছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিয়ের পর হতে হল মালাকার! একে তো নিজেকে পাল্টাতে হচ্ছে, ঘরবাড়ি পাল্টাতে হচ্ছে, তার উপর নামটাও আর নিজের রইল না! এমনকি, নিজের সইটাও পাল্টে ফেলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সমস্ত সরকারি কাগজপত্রে নাম পাল্টানো একটা দীর্ঘ এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, পিপিএফ, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি যেখানে আপনি বিয়ের আগের নামে জ্বলজ্বল করছিলেন, সেখানে আবার নতুন করে নিজেকে চেনানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, বিশেষত যাঁরা চাকরিবাকরি করেন। এ ছাড়াও সমাজমাধ্যমে যদি নিজের আগের নামে প্রোফাইল খুলে থাকেন, তা হলে সেটিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। না হলে তো তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজের কাছ থেকে জ্বালাধরানো বাঁকা কথা শোনার জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে হবে। একটা প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে যে, কেন একটা ছেলে বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী’র পদবি ব্যবহার করবেন না! এই বিতর্কের শেষ নেই, কারণ সামাজিক নিয়মে এখনও বিবাহের পর ছেলেদের পাকাপাকি ভাবে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয় না। মেয়েদেরই আসতে হয় ।
শেষে বলি, বিয়ের পরে কেউ পদবি পাল্টাবেন কি পাল্টাবেন না, সেটা একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। পরিবার তো দূরের কথা, আইনও তাঁকে বাধ্য করতে পারে না।
সুশীলা মালাকার সরদার, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
নিজের শর্তে বাঁচা
‘নিজ পদবিতে বাঁচার অধিকার’ পড়ে খুব ভাল লাগল। আমিও প্রভাবতী গুপ্তের মতোই বিয়ের পরে পদবি পরিবর্তন করিনি। বাপের বাড়ির পদবিকে ছেঁটে ফেলা আমার কাছে ছিন্নমূল হওয়ার শামিল। বাপের বাড়ির সব কিছু ছেড়ে চলে আসার পর ওই পদবিটাই তো আগের জীবনের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে রাখে। জন্মসূত্রে পাওয়া পদবি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার, প্রতিষ্ঠিত হয় নিজের অধিকার। তাই এই পদবি নিজের শর্তে বাঁচার অন্যতম হাতিয়ার।
তবে বিয়ের পর বাবার পদবি ব্যবহারেরও কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। বিভিন্ন অফিসে, ব্যাঙ্কে, পোস্ট অফিসে স্বামীর পদবি বলার পর সবাই আড়চোখে তাকিয়ে দেখে। নতুন রেশন কার্ড করার সময় তো পদবি পরিবর্তন নিয়ে আধিকারিকদের সঙ্গে তর্ক করতে হয়েছিল। এমনকি দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়েও দেখেছি, পদবি পরিবর্তন করিনি বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
বাধ্যতামূলক নয়
‘নিজ পদবিতে বাঁচার অধিকার’ শিরোনামে ঈশা দাশগুপ্তের প্রবন্ধটি সম্পর্কে দু’-চার কথা বলতে চাই। প্রথমে বলি, পদবি পরিবর্তন বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে শুধু একটা প্রথামাত্র, অবশ্যই তা নারীর ক্ষমতায়নের নির্ণায়ক নয়। এখন তো বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও ক্ষয়িষ্ণু। দু’জন নারী-পুরুষ একত্রে বসবাস করলে তাঁদের সন্তানসন্ততি বৈধতা পায়। তবে সামাজিক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নারী-পুরুষ প্রচলিত আইন অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী রূপেই গণ্য হন। সেখানে নারীর পদবি পরিবর্তন বাধ্যতামূলক নয়।
অনেক সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্রের সঙ্গে সমতা রেখে অনেক নারীই দু’টি পদবি এক সঙ্গে ব্যবহার করেন। আর নামের সঙ্গে দাসী, রানি, দেবী জুড়ে দেওয়ার আমল তো ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হল, এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রীজাতির ক্ষমতায়ন আদৌ হচ্ছে কি না। ৩৯০ খ্রিস্টাব্দের উদাহরণ (প্রবন্ধে উল্লিখিত) একবিংশ শতাব্দীতে খুব প্রাসঙ্গিক নয়! অন্তত আমি বিশ্বাস করি, নারী জাতি আর অবগুণ্ঠিত অন্দরমহলের জীব নয়, অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তার কারণ নারী এখন নিজের যোগ্যতাবলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিবাহিত নারীর পদবি পরিবর্তন অত্যন্ত গৌণ একটি বিষয়!
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
দুইয়ে মিলে
‘নিজ পদবিতে বাঁচার অধিকার’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, বিয়ের পর যে আত্মত্যাগ মেয়েরা করেন, তা হল এক জমি ছেড়ে আর এক জমিতে প্রোথিত হয়ে বরের বাড়ির সবাইকে ‘আপন’ করে নেওয়া। চিরকাল এ ভাবে হয়ে আসছে। পোশাক, খাদ্য, কথা, আদবকায়দা ইত্যাদি অনেক কিছুই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তা বলে নিজ পদবিটুকুও বিসর্জন?
আজকাল অনেকে কর্মসূত্রে নিজ পদবি দিব্য সুন্দর সঙ্গে নিয়ে চলেন। এঁদের সংখ্যা নগণ্য হলেও সাড়া জাগিয়েছে। বহুসংখ্যক মহিলা শ্বশুরবাড়ির পদবি ধারণ করতে বাধ্য হন নানা অশান্তির ভয়ে। তাঁদের অনেকের মনেই আক্ষেপ আছে পদবি বিয়োগ নিয়ে।
তবে এঁদের মধ্যে কয়েক জন আরও একটি সহজ পন্থা অনুসরণ করেন— তাঁরা বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির পদবি একত্রে ব্যবহার করেন। যেমন, আমার স্ত্রীর বাপের বাড়ির পদবি রায়। তিনি আমার দিকের পদবি যোগে রায়চৌধুরী হয়েছেন। এই পন্থায় কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
বিবেকানন্দ চৌধুরী, মণ্ডলহাট, পূর্ব বর্ধমান