যে হোসেন শাহ সোহরাওয়ার্দিকে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তাঁকে নিয়ে শরৎ বসু ও কিরণশঙ্কর রায় মুসলিম লিগ নেতা আবুল হাসিমকে সঙ্গে নিয়ে ‘সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা’ নামক দেশ তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা বানচাল হয় শ্যামাপ্রসাদেরই প্রবল বিরোধিতায়। পরিকল্পনাটি সফল হলে বাংলার হিন্দুদের প্রভূত ক্ষতি হত।
স্বাধীনতার পর শ্যামাপ্রসাদ যোগ দেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়। সেখানে নেহরুর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানে হিন্দুদের নিরাপত্তার অভাবের বিষয়। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা ও হিন্দুনিধনের কারণে তিনি মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেন। এই সময় পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুদেরও শ্যামাপ্রসাদের প্রবল সমর্থক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের অনুপস্থিতি এবং কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর ফলে অত্যন্ত দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি সেই সুযোগ নিতে ব্যর্থ হয়। এই সাহসী মানুষটিকে প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে বামপন্থীরা রাজনৈতিক সুবিধার্থে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে।
গাঁধী ও সুভাষের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের মতবিরোধের প্রসঙ্গে দু-তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব। শ্যামাপ্রসাদের বিভিন্ন উক্তি থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, উনি গাঁধী সম্পর্কে খুব একটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না এবং গাঁধীজি যে তা জানতেন না, তা নয়। ‘দেশ’ পত্রিকার শ্যামাপ্রসাদের জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যায় (৪ জুলাই, ২০০১) প্রকাশিত সন্দীপ দাস মহাশয়ের এক লেখায় জানতে পারছি— এতৎসত্ত্বেও, গাঁধী লর্ড ওয়াভেলকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, সিমলা বৈঠকে তাঁর শ্যামাপ্রসাদকে ডাকা উচিত। পরে অন্য একটি ক্ষেত্রে গাঁধী রাধাকৃষ্ণনকেও চিঠি লিখে জানান যে, “বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্যামাপ্রসাদকে অবশ্যই যেন যুক্ত করা হয়।” কারণ “শ্যামাপ্রসাদ জ্ঞানী ও দক্ষ এবং হিন্দু মহাসভার লোক হলেও তিনি উদার মনোভাবাপন্ন।’’ মনে রাখা ভাল, মুসলিম লিগ নেতা ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি বাংলায় মন্ত্রিসভা গড়েছিলেন।
নোয়াখালির দাঙ্গার পর অনশনরত গাঁধীকে তিনি দেখতে যান। অসুস্থ শ্যামাপ্রসাদের খবর নেওয়ার পর, গাঁধী সহকর্মীদের বলেন, শ্যামাপ্রসাদ যখন বলবেন কলকাতার সংখ্যালঘুরা নিরাপদ, সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। শ্যামাপ্রসাদ গাঁধীকে পাঠানো এক চিঠিতে দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার কথা বলেন। গাঁধী অত্যন্ত খুশি হন। ১৯৪৪ সালের ২১ অক্টোবর এক দিনলিপিতে শ্যামাপ্রসাদ লেখেন, তাঁর সঙ্গে সুভাষের কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। বস্তুত সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্পর্কই রয়েছে। সুভাষের অন্তর্ধানের পর তিনি লেখেন, “আজ একথা স্বীকার করতেই হবে যে তিনি ভারতের অগ্রগণ্য নেতা, যিনি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে কোনও মূল্য দিতে রাজি।”
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৭
স্থিরচিত্ত নন?
সমরেন্দ্র প্রতিহার এবং পার্থ প্রতিম কুণ্ডুর চিঠির (১৮-০৬) প্রসঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পূর্ণাঙ্গ জীবনীকার হিসেবে কিছু কথা জানাতে চাই। চিঠি দুটি তাঁর সমালোচনায় পরিপূর্ণ— তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু অর্ধসত্যে ভরপুর— তাতে আপত্তি আছে। সমরেন্দ্রবাবুর অভিযোগ, শ্যামাপ্রসাদ তাঁর স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনে স্থিরচিত্ত ছিলেন না। শ্যামাপ্রসাদ কখনও কংগ্রেসকর্মী ছিলেন না। ১৯২৯ সালে যখন তিনি কংগ্রেসের টিকিটে প্রাদেশিক আইনসভায় দাঁড়িয়েছিলেন, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং শিক্ষাব্রতী হিসেবেই দাঁড়িয়েছিলেন, রাজনীতিক পরিচয়ে নয়। তার পর যখন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল যে পূর্ণ স্বরাজের প্রতিশ্রুতি না পেলে তারা আইনসভায় অংশ নেবে না, তখন তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করলেন, নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন এবং অনায়াসে জিতলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বয়কট না করে আইনসভায় যেটুকু বলার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তা কাজে লাগানো উচিত। এর পর ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে ছিলেন। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেসের অবিমৃশ্যকারিতার ফলে গঠিত মুসলিম লিগ সরকার যখন হিন্দুদের উপরে নির্যাতন করতে লাগল, তখন হিন্দু সমাজের কয়েক জন নেতা শ্যামাপ্রসাদকে অনুরোধ করেন রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য। কারণ, সে সময়ে যে মাপের নেতৃত্ব দরকার ছিল, তা দেওয়ার মতো বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কেউই ছিলেন না। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি হিন্দু মহাসভাতেই ছিলেন। পরে দলের সঙ্গে নীতিগত মতানৈক্যের কারণে তিনি দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ভারতীয় জনসঙ্ঘ তাঁরই সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহযোগিতায়। আজকের সেই ভারতীয় জনসঙ্ঘের উত্তরসূরি দল ভারতীয় জনতা পার্টি যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারত শাসন করছে, তা তাঁর দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক।
‘চরিত্রের যে মহত্ত্ব, স্বচ্ছতা, দৃঢ়চিত্ততা, সর্বোপরি মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকা দরকার, সবগুলির অভাব ছিল শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে’— তাঁর সম্পর্কে এমন উক্তি সত্য নয়। ১৯৪২ সালে কবি কাজি নজরুল ইসলাম যখন প্রচণ্ড আর্থিক ও শারীরিক দুর্দশায় পড়েছিলেন, তখন কবির ধার শোধ করে এবং মধুপুরে নিজেদের বাড়িতে রেখে তাঁর শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদই। আর মানুষের প্রতি ভালবাসা? ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ত্রাণের জন্য এত খেটেছিলেন যে নিজের মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। উল্লেখ্য, সেই সময় কংগ্রেস নেতারা সবাই জেলে এবং কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধে’ সমর্থন জানিয়ে ব্রিটিশের পদলেহনে ব্যস্ত।
এত কিছুর পরেও শ্যামাপ্রসাদ কেন বাঙালির ইতিহাসে এক বিস্মৃত চরিত্রে পরিণত হলেন? মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা স্মরণ করতে হয়, ‘বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি’। এই শ্যামাপ্রসাদের মরদেহই যখন কেওড়াতলা শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তাঁর শবযাত্রার যে ছবিটা দেখেছি তা কালীঘাট পোস্টঅফিস থেকে বিজলি সিনেমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
তথাগত রায়
রাজ্যপাল, মেঘালয়
ভুলে গিয়েছি
শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত (১৯৩৯-১৯৫৩)। কিন্তু, তিনি যে ভাবে তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা, অদম্য সাহসিকতা, আপসহীন মনোভাব আর বাগ্মিতা দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের নিরাপত্তা দেন, সম্পত্তি বেদখল হওয়া থেকে রক্ষা করেন, তা কোনও দিনই ভোলা উচিত নয়। অথচ, তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাই ‘অবাঙালি’ করে রেখেছে।
অসিত কুমার চক্রবর্তী
মহেশতলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অকপট স্বীকৃতি
১৯৪৪ সালে শ্যামাপ্রসাদ ইংরাজি দৈনিক ‘ন্যাশনালিস্ট’ প্রকাশ করেন। পরে তিনি ‘দৈনিক হিন্দুস্থান’ নামে একটি বাংলা সংবাদপত্রও প্রকাশ করেন। তাঁদের কলকাতার বাড়ি থেকে মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গবাণী’ প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল। ‘আবার তোরা মানুষ হ’— এই ছিল পত্রিকার বাণী। শ্যামাপ্রসাদ বিভিন্ন কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করতেন। এই পত্রিকায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’, ছোটগল্প ‘মহেশ’ ও ‘অভাগীর স্বর্গ’ প্রকাশিত হয়েছিল।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘যুক্তবঙ্গের স্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তিনি এক সময় চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের পদে ছিলেন। এক দিন শ্যামাপ্রসাদ সেখানে উপস্থিত হন। তাঁর সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে অন্নদাশঙ্করও নিমন্ত্রিত ছিলেন। অন্নদাশঙ্করের কথায়— মানুষটি পরদুঃখকাতর, তাঁর দরদের দ্বারা তিনি আমার হৃদয় জয় করেন। কিন্তু এমন হৃদয়বান মানুষ কি শুধু হিন্দুদেরই ব্যথার ব্যথী হবেন? মুসলমানদের জন্য কি তাঁর অন্তরে স্থান থাকবে না? আমি তাঁকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করি, আপনি কংগ্রেসে যোগ না দিয়ে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন কেন? শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু অকপটে স্বীকার করলেন, ‘কংগ্রেসে আগে থেকে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা কি এত সহজে এত উচ্চে উঠতে দিতেন?’
প্রসন্নকুমার কোলে
শ্রীরামপুর, হুগলি
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।