শেক্সপিয়র।
‘প্রতিভার স্ফুরণ গৃহবন্দি দশাতেও’ (১৭-৩) লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে শেক্সপিয়রের প্রবেশ— অর্থাৎ জন্ম— ১৫৬৪ সালের এপ্রিল মাসে, প্লেগের প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর আবহে।
আবার ১৫৮৫ থেকে ১৫৮৭ সাল পর্যন্ত বিউবোনিক প্লেগ যখন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অংশে ক্রিয়াশীল থেকেছে, ঠিক সেই সময়েই লন্ডনের নাট্যজগতে তাঁর আবির্ভাব। সেখানে তখন ক্রিস্টোফার মার্লো, রবার্ট গ্রিন, জর্জ পিল, টমাস ন্যাশ-এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তা সত্ত্বেও শেক্সপিয়রের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির পারদ ক্রমশ হচ্ছিল ঊর্ধ্বমুখী।
এমন সময় বাদ সাধে প্লেগ। ফলে ১৫৯৩ সালে লন্ডনে প্লেগের কারণে রোজ় থিয়েটারে ‘হেনরি দ্য সিক্সথ’-এর পঞ্চদশ অভিনয়ের পর, সমস্ত থিয়েটার হলগুলি যখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধের মুখে, নাটকের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা যখন আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন, অধিকাংশ লন্ডনবাসী যখন প্রাণভয়ে পল্লিমুখী, ঠিক তখন স্ট্রাটফোর্ডে কবি রূপে শেক্সপিয়রের আত্মপ্রকাশ। যার ফল ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডোনিস’(প্লেগের উল্লেখ মাত্র এক বার)।
অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে, ২৪-১-১৫৯৪ তারিখে রোজ় থিয়েটারে ‘টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস’-এর প্রথম অভিনয়ের পর সমস্ত থিয়েটার হলগুলি একে একে খুলতে শুরু করে। এ ভাবে লন্ডনের নাট্যবৃত্তে তাঁর প্রত্যাবর্তন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চেম্বারলিনের থিয়েটার দলে তাঁর যোগদান।
খ্যাতি ছিলই, এ বার তার সঙ্গে আরও যুক্ত হল প্রতিষ্ঠা ও অর্থভাগ্য। নতুন নাটক লেখা, অভিনয়, আর অবসরে ‘মারমেড ট্যাভার্ন’-এ গিয়ে, বেন জনসন, জন ডান, ফ্লেচার ও বোমন্টের সঙ্গে দুরন্ত সৃষ্টিশীল আড্ডা। চলছিল ভালই। কিন্ত ১৬০৩-এ আবার প্লেগ। আবার স্ট্রাটফোর্ড ফিরে যাওয়া।
শেক্সপিয়রের জীবদ্দশায় শেষ বার ইংল্যান্ডে বিউবোনিক প্লেগ মহামারি রূপে দেখা দেয় ১৬০৯ সালে। শেক্সপিয়র শেষ বারের মতো আশ্রয় নেন আভন নদীর তীরে। কোনও দিন লন্ডনে ফিরে না আসার সঙ্কল্প করেন।
তাঁর কবিতা ও নাটকে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে প্লেগের প্রসঙ্গ। ‘রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর পরিণতিতে প্লেগের ভূমিকা হয়ে ওঠে নির্ণায়ক। ফ্রায়ার লরেন্সের প্রশ্নের উত্তরে ফ্রায়ার জনের উক্তি স্মরণীয়:
"the searchers of the town,
Suspecting that we both were in a house
Where the infectious pestilence did reign,
Seal’d up the doors, and would not let us forth"
(Act- V Scene-II)
এ ভাবে জন্ম থেকে ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত বার বার প্লেগ শেক্সপিয়রের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বন্ধু, সহকর্মী, নিকটাত্মীয়দের হারিয়েছেন। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভাবে পর্যুদস্ত হয়েও শেষ পর্যন্ত জেগে উঠেছেন এক ফিনিক্স পাখির মতো।
কৃষ্ণা মাহাতো
হাওড়া-৯
বদল চাই
‘ফাঁসি হল, কিন্তু ইনসাফ?’ শীর্ষক নিবন্ধে (২১-৩) সোনালী দত্ত যথার্থই বলেছেন, ‘দরকার সমাজ বদল’। কাঙ্ক্ষিত ইনসাফ আসবে সমাজ বদলের মধ্য দিয়ে; সমাজ-মানসিকতা বদলের মধ্য দিয়ে। অপরাধীদের শাস্তি বহু জায়গায় হচ্ছে না, এও যেমন সত্য, তেমনি বহু ক্ষেত্রে শাস্তি হচ্ছেও। নির্ভয়া হত্যাকাণ্ডের জেরে দেরিতে হলেও চার অপরাধীর ফাঁসি হল। এর আগে এমন অপরাধে বহু মানুষের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তো সমাজ মানসিকতার সেই পরিবর্তন আসছে না, যা নারীকে মানুষ হিসাবে দেখতে শেখায়; বুদ্ধি, মেধা, স্বার্থত্যাগ, শ্রমের নিরিখে দেখতে শেখায়।
নির্ভয়ার মৃত্যুর পরবর্তী পাঁচ বছরে শুধু দিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে বহু শতাংশ। তিন বছরের শিশুও আছে সে তালিকায়। দেখা যাচ্ছে, কেবল ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর মধ্য দিয়ে নারীদের দুরবস্থার অবসান হচ্ছে না। এ জন্য ছেলেদের যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। কোনও শিশু সন্তান ধর্ষক বা অপরাধী হিসাবে এই সমাজে আসে না। এই সমাজ তাকে ধীরে ধীরে অপরাধী করে তোলে, নারীকে বিশেষ এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার মধ্য দিয়ে ধর্ষক করে তোলে। সে জন্যই চাই সমাজ পরিবর্তন। সমস্যা কত গভীরে গেলে এ দেশে প্রতি ১৫ মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিতা হন, প্রত্যহ কমবেশি ৯৫ জন নারী ধর্ষিতা হন!
আজ দেশের যুবসমাজের এক বিরাট অংশ বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত, দিশেহারা, হতাশাগ্রস্ত, মাদকাসক্ত। কোনও উন্নত আদর্শকে তারা তাদের সঙ্গী করার কথা ভাবছে না। আবার দেশনেতারাও অনেকেই আদর্শচ্যুত; ক্ষমতা করায়ত্ত করার লক্ষ্যে যুবসমাজের আদর্শচ্যুতিকে মদত দিতে, হাতিয়ার করতে তৎপর। সরকারি বদান্যতায় মদ সহ যাবতীয় নেশার সামগ্রী মিলছে হাতের কাছেই। এই সমাজ, এই সমাজ মানসিকতার আমূল পরিবর্তন চাই, যা সমগ্র রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন ব্যতিরেকে আদৌ সম্ভব নয়।
বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কবে বলেছিলেন, ‘‘এদেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এদেশের ভাল হয়।’’
গৌরীশঙ্কর দাস
সাঁজোয়াল, খড়্গপুর
ডাক্তার ও অসুখ
“এ বার তো শহরেও করোনা ঢুকে গেল।’’ এক অটোযাত্রী স্বগতোক্তির মতন জানালেন। বিজ্ঞ অটোচালক মাথা নাড়িয়ে বললেন, “সে তো কবেই ঢুকেছে। আমার পাড়াতেই দু-তিনটে হয়ে গেছে।”
আমি অসহায় চিকিৎসক বোবা হয়ে বসে রইলাম পিছনের সিটে। গত কয়েক সপ্তাহে এই অসুখ নিয়ে হাজার প্রশ্ন সামলাতে সামলাতে, আমি কতটুকু জানি, কোনটা বাস্তব কোনটা কল্পনা, কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, এই হিতাহিতজ্ঞানটাই প্রায় হারিয়ে ফেলেছি।
সচেতনতার মত ভাল জিনিস হয় না। কিন্তু সচেতন হতে গিয়ে অনেকেই বাড়াবাড়ি রকমের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। প্যানিকগ্রস্ত মানুষ জানা সহজ কাজটুকুও করে উঠতে পারে না।
“আমার অসুখটা হয়নি তো?’’ এর উত্তরে আমি বলি, “হয়নি, কারণ আপনার পাশে বা তার পাশে কোনও করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী নেই।” এই উত্তরে অনেকেই সন্তুষ্ট হন না। তাঁাদের বলতেই হয়, “প্রথমে তো আমাদের হবে— যারা হাজার হাজার হাঁচিকাশির উৎসের সাথে রোজ ঘর করছি। আমাদের হলে তার পর আপনার ভয় পাওয়ার প্রশ্ন।”
চেম্বারে ঢুকে অনেকে আঁতকে ওঠেন: “সে কী, আপনি মাস্ক পরেননি?” বোকার মতন হেসে বলি, “কী আর হবে? লিলি আউট করতে না পারলে টমো করবে—কটা অসুখ আটকাব? সারা জীবন মাস্ক পরতে হবে তা হলে।”
বলি বটে, কিন্তু ভালই বুঝি, সারা জীবন মুখোশে ঢেকে রাখা উচিত মুখকে— পুরনো থিতিয়ে যাওয়া অসুখেরা জাগছে— নতুন অসুখ তো আছেই। লোকে করোনাভাইরাস ছাড়া এখন আর কিছুই বুঝছে না বটে, কিন্তু যে জানে সে জানে: যে কেউ, যে কোনও রোগ, যখন-তখন আমাদের আউট করে দিতে পারে— সে কোভিড-১৯ বা নতুন করে ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে আসা টিউবারকিউলোসিস। বা অন্য কেউ!
ইভান তুর্গেনেভের অমর চরিত্র বাজারভ ছিল ডাক্তারির ছাত্র। টাইফাস আক্রান্ত গ্রামে চিকিৎসা করতে গিয়ে বেচারাকে টাইফাস রোগটিই কেড়ে নেয় (বাস্তবের টাইফাসের আবিষ্কারক ডা. রিকেটসও একই ভাবে চলে যান)। ডাক্তারদের জীবনটাই এ রকম। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ— অথচ যোদ্ধার সম্মানটুকু নেই কোথাও। শঙ্খ ঘোষের কবিতাটা মনে পড়ে, “এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন/ শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !”
অরিজিৎ সেন
কলকাতা-৪৭