আদিত্য ঘোষের লেখা ‘বিপর্যয়ের আগে ও পরে’ (১৬-৬) শীর্ষক নিবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। লেখক সুন্দরবনের দ্বীপবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। উদাহরণ দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের একটি প্রকল্পের। কিন্তু ইউরোপের এই অংশের নদী এবং ভূমি গঠনের সঙ্গে সুন্দরবনের আকাশ-পাতাল তফাত। তফাত আছে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে সুন্দরবনের বাসিন্দাদেরও। সুন্দরবনের বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্থানান্তর করা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। ঘোড়ামারার মতো ক্রমশ জমি হারানো অতি বিপন্ন দ্বীপের হাজার পাঁচেক মানুষকেই আজ দশ বছর হল নানা বাস্তব কারণে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন ভূমিরূপ গঠনের দিক থেকে নবীন, আজও তার গঠন-প্রক্রিয়া চলছে। এখানকার নদীর গতিপথ সদা পরিবর্তনশীল, হঠাৎ কোনও জায়গায় নদীর মধ্যে বিশাল চর জেগে ওঠা বা কোনও নদীর নির্দিষ্ট কোনও একটি দিকে ভাঙনের হার বেড়ে যাওয়া সুন্দরবনে খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
আমপান ঝড়ের কবলে গোসাবার রাঙাবেলিয়া গ্রামের যে অংশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে বাঁধ ভেঙে, সেখানকার মানচিত্র লক্ষ করলে বোঝা যাবে, দ্বীপটির দু’দিক থেকে বিদ্যা ও গোমোর নদী কী ভাবে গত কয়েক দশকে বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। বস্তুত, দুটি নদীর মাঝের ভূমিখণ্ড মাত্র ২৫০ মিটারে এসে ঠেকেছে।
মূল কথা হল, দীর্ঘ দিন বাঁধ দিয়ে ঘেরা থাকা দ্বীপগুলির মধ্যে জোয়ারের জল ঢুকে পলি জমা করতে পারেনি। জোয়ারের সময় জলের সঙ্গে ভেসে আসা এই সব পলি দ্বীপের মধ্যে জমতে না পেরে অধিকাংশই জমেছে নদীর তলদেশে। অগভীর নদীতে জলের চাপ বাড়ছে, সেই চাপ পড়ছে বাঁধের উপর। জোয়ারের উচ্চসীমা এবং ভাটার সময় নিম্নসীমা পর্যন্ত অঞ্চল, যেটিকে আমরা ‘ইন্টার টাইডাল স্পেস’ বলি— সেই জায়গাটি নদীর প্রবাহের জন্য ছেড়ে রাখা প্রয়োজন।
দ্বীপভিত্তিক সমীক্ষায় প্রতিটি অঞ্চলকে চিহ্নিত করে কিছু মানুষের কয়েক বছরের অস্থায়ী আবাস ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজন বিপর্যয়কে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকা শেখানো। দরকার ঘূর্ণিঝড় সহ্য করতে পারে এমন বাড়ি নির্মাণ, এবং শিশুদের ছোটবেলা থেকে বিপর্যয় মোকাবিলার শিক্ষাদান।
জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী
সম্পাদক, শুধু সুন্দরবন চর্চা
গড়ে ওঠার আগে
পঞ্চদশ শতকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর মূল প্রবাহ যখন পূর্বে পদ্মায় চলে গেল, তখন থেকে উচ্চতর অববাহিকার পলিঋদ্ধ জলপ্রবাহের হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের ব-দ্বীপ গঠনের কাজে বাধা পড়ল। বিংশ শতাব্দীর শেষে বছরের মধ্যে বর্ষাকালের মাত্র তিন মাস পদ্মার জল ভাগীরথী-হুগলিতে প্রবেশ করত। যেহেতু জলস্রোতের পলি বহন ক্ষমতা স্রোতের বেগের ওপর নির্ভরশীল, তাই জোয়ারের সময় যে পরিমাণ পলি খাঁড়িতে প্রবেশ করে, ভাটার সময় সম-পরিমাণ পলি সাগরে ফিরে যেতে পারে না। ফলে উদ্বৃত্ত পলি খাঁড়ির উভয় তীরে জমে ব-দ্বীপ গঠনে সহায়তা করে। কিন্তু জনবহুলতার চাপে নতুন জমির সন্ধানে মেদিনীপুর এবং ২৪ পরগনা জেলার উত্তর ভাগ থেকে বহু ভাগ্যান্বেষী এই অসম্পূর্ণ ব-দ্বীপ অঞ্চলে মাটির বাঁধের সাহায্যে জোয়ারের জল আটকে নিচু জমিতে কৃষিকাজ শুরু করল। ফলে জোয়ারের সাহায্যে যেটুকু ভূমি উন্নয়ন হচ্ছিল, তাও বন্ধ হয়ে গেল। ব্রিটিশ আমলে জমি বন্দোবস্তের বেগ বৃদ্ধি পেল। ফলে বিস্তীর্ণ বাদা অঞ্চলে চাষবাস শুরু হল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে মোট ১০৪টি দ্বীপের মধ্যে ৫২টিই জন-অধ্যুষিত।
কিন্তু সুন্দরবনে সমস্যা রয়ে গেল। এখানকার মাটি বাঁধ তৈরির পক্ষে উপযুক্ত নয়। সাইক্লোনের সময় জলোচ্ছাসের ধাক্কায় বাঁধ সহজেই ভেঙে পড়ে এবং নোনাজল ঢুকে সব প্লাবিত করে দেয়। খাঁড়িগুলি প্রাকৃতিক কারণেই তাদের গতিপথ ঘন ঘন পরিবর্তন করে। এ কারণেও বাঁধগুলি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই বাঁধগুলিতে নজরদারি এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার। এই সব বিবেচনা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগের অন্তর্গত নদী বিজ্ঞান-মন্দিরে ষাটের দশকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে ‘সুন্দরবন ব-দ্বীপ প্রকল্প’ শীর্ষক এক তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন তৈরি হয়। সেই প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।
সিতাংশু শেখর গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা-৯৭
প্রকৃতি ও মানুষ
আদিত্য ঘোষের প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে— বাঁধ মেরামত করে সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আমপান দেখিয়েছে, যে সব ভঙ্গুর বাঁধ আয়লা প্রকল্পে ঠিক প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় উচ্চতা ও ঢাল বজায় রেখে নির্মিত হয়েছিল, তাতে কোনও ভাঙন হয়নি বা জোয়ারের জল বাঁধ উপচে গ্রামে ঢুকতে পারেনি। যেখানে নদীবাঁধ ভেঙেছে, সেখানে অনেক দিন যাবৎ বাঁধ মেরামতের কাজ হয়নি এবং এর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মাছের ভেড়ি ও ইটভাটার মালিকদের নদীবাঁধ ও চরজমিতে ‘যা ইচ্ছে’ করার ফল ভুগতে হয়েছে গ্রামবাসীদের।
দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মধ্যে কুড়ি লক্ষের পুনর্বাসন বাস্তবে অসম্ভব। কিছু দিন আগে এই কাগজেই এক নিবন্ধে জয়ন্ত বসু মন্তব্য করেছেন, “বিপদ বেশি বলে সরিয়ে দেওয়াটাই যদি সমাধান হয়, তবে তো কয়েক দশক পরে কলকাতা শহর থেকেও মানুষ সরিয়ে ফেলতে হবে...” (‘এখনও সুন্দরবন বাঁচাতে হলে’, ২৯-৫)।
তৃতীয়ত, সুন্দরবনের বিপন্নতার আলোচনায় নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে তুলনা শোনা যায়। উল্লেখ্য— ১) সুন্দরবনে জঙ্গল হাসিল করে, দ্বীপগুলিকে বাঁধ দিয়ে ঘিরে আবাদযোগ্য করেছে ভূমিকাঙাল কৃষিজীবী, জল ও জঙ্গলজীবী মানুষ। অনেক ঘাম, রক্ত ও শ্রমের বিনিময়ে নোনাজলে ডুবে থাকা জমি তারা উদ্ধার করেছে এবং অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অধিকার কিছুটা কায়েম করেছে। তাই এই মাটির জন্য চাষিদের আবেগ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, নেদারল্যান্ডসের পোল্ডার বা যে জমি সমুদ্রের বুক থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সেগুলি পুরোপুরি সরকারি সহায়তায় ঘটেছে। তার পর সেখানে হয়েছে মানুষের অভিবাসন। এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় যদি অতি সামান্য জনঘনত্বের বাসিন্দাদের সরিয়ে পোল্ডারের কিছু অংশ পুনরায় সমুদ্রকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তাতে মানুষের সাড়া দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাও নিবন্ধকার জানিয়েছেন, এই প্রক্রিয়া সফল করতে দশ বছর যাবৎ জনসচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়েছে। ২) দেশভাগের কারণে আসা শরণার্থী পুনর্বাসনের সমস্যাটিও এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে। আশির দশকে ভয়ঙ্কর নদীবেষ্টিত মরিচঝাঁপির মতো দ্বীপকেই শরণার্থীরা পুনর্বাসনের জন্য বেছে নিয়েছিল। পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও আর্থিক সঙ্গতি যদি রাজ্যের হাতে থাকত, তা হলে কয়েক হাজার মাত্র শরণার্থীর ওই দুর্গতি হত না।
সাধারণত সুন্দরবনের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কথা মাথায় না রেখে শুধুমাত্র ভৌগোলিক অবস্থানকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুন্দরবনবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস, নদীবাঁধ যদি ঠিক প্রযুক্তি মেনে, স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে, বাঁধের অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে মেরামত ও সংস্কার করা যায়, তা হলে আমপানের মতো ঝড়কেও সামলানো সম্ভব। তার আগে প্রয়োজন, নদী ও সমুদ্রবাঁধের পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার প্রস্তুত করা এবং বিপন্নতর অংশগুলিকে চিহ্নিত করা।
সুভাষচন্দ্র আচার্য
প্রাক্তন যুগ্ম-অধিকর্তা, সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সোনারপুর, কলকাতা-১৫০
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।