UK General Election 2024

সম্পাদক সমীপেষু: বিলেতে ক্ষমতাবদল

ব্রিটেনে ১৪ বছর পর কনজ়ারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতার লাগাম নিতে যাচ্ছে লেবার পার্টি। তারা ৪১২টি আসন জিতেছে ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৪ ০৪:৫৫
Share:

ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যা করে দেখাতে পারেননি, তা করে দেখালেন ব্রিটেনের লেবার পার্টির কিয়ের স্টার্মার। লেবার পার্টি এ বারের ভোটে ৪০০-র বেশি আসনে জয় লাভ করেছে। তড়িঘড়ি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট যখন এগিয়ে এনেছিলেন সদ্যপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, তাঁর নিজের দলের বহু নেতাই সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। খবরের কাগজের রিপোর্টে প্রকাশিত, কনজ়ারভেটিভ নেতাদের একাংশের দাবি ছিল, চলতি বছরের বদলে সামনের বছর ব্রিটেনে ভোট হলে তাঁদের দলের ফলাফল অনেক ভাল হতে পারত। কিন্তু সুনক সে সবে পাত্তা না দিয়ে নির্বাচন পিছোনোর বদলে আরও তিন মাস এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন। যার ফল আজ সবার নজরে। ব্রিটেনে ১৪ বছর পর কনজ়ারভেটিভ পার্টিকে হারিয়ে ক্ষমতার লাগাম নিতে যাচ্ছে লেবার পার্টি। তারা ৪১২টি আসন জিতেছে ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন কিয়ের স্টার্মার। ১৯৯৭-এ টোনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে ২৭ বছর আগে লেবার পার্টি সরকার গঠন করেছিল। সে সময় তারা পেয়েছিল ৪১৮টি আসন।

Advertisement

কনজ়ারভেটিভ পার্টির প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছিল। ব্রিটেনে দীর্ঘকাল ধরে মুদ্রাস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, জনগণের উপর করের বোঝা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, জনস্বাস্থ্যের সুবিধাগুলি ভেঙে পড়েছে এবং অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। যদিও ঋষি সুনক অর্থনীতির যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।

তবে লেবার পার্টির পক্ষেও তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন সহজ নয়। ব্রিটেনের অর্থনীতি পরিচালনা করা স্টার্মারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। একটি খালি কোষাগার দিয়ে করের বোঝা কমানো এবং সরকারি সুবিধার উন্নতি করা সহজ হবে না। এমতাবস্থায় অভিবাসন নীতি কঠোর করা হলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে কতটা সফল হবে তারা, তা দেখার বিষয়।

Advertisement

অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর

অ-কাজের ভাষা?

বাংলা বিদ্যাচর্চা এই মুহূর্তে এক সঙ্কটকালে দাঁড়িয়ে। যাকে বলে ‘ডিলিঙ্ক’ হয়ে যাওয়া— বাংলা বিদ্যাচর্চাটা ঠিক সে ভাবে চলতি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। তার উপর নতুন রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি। আজকের বাংলা বিদ্যাচর্চার খোলনলচে এই শিক্ষানীতির উপযুক্তই নয়। তাই সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

বাংলা বিদ্যাচর্চা বলতে বাংলায় কথা বলা, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখা, বাংলা বই-ম্যাগাজ়িন ছাপানো ও বিক্রি করা বোঝায় না। এই চর্চা উচ্চশিক্ষায় বাংলা বিদ্যাচর্চা। যে শিক্ষা শেষ করার পর কাজের বাজারে ঢোকা যায়। বাংলা নিয়ে স্নাতক স্তর থেকে পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শুধু নয়, গবেষণাও করা যায়। এর পর বিভিন্ন রাজ্যে নানা রকম ব্যবস্থার ঘাট পেরিয়ে শিক্ষায়তনে চাকরিও পাওয়া যায়। অর্থাৎ, শিক্ষকতার (বনিয়াদি থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত) চাকরি। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে এ রকম চাকরি পাওয়াটা সহজ ছিল। কারণ, চাকরি অনুপাতে উপযুক্ত ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যাটা কম ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যোগ্য লোকের সংখ্যা বেড়েছে, আর শিক্ষায়তনের সংখ্যা কমেছে। ইংরেজি মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের দিনে অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলার শিক্ষকের কদর হয়তো বা এখনও আছে, কিন্তু ভারতের অন্যত্র যেখানে বাঙালিরা আছে, তাদের ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ খুবই সীমিত। যেখানে হাতেগোনা স্কুলে বাংলা বিষয়টা আছে, সেখানে দু’-চার জন বাংলা পড়ানোর শিক্ষকও রয়েছেন। আর যা আছে ওই কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোট কথা, বাংলায় উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর ওই শিক্ষক-অধ্যাপকের চাকরিটা ধরাবাঁধা। নয়তো গৃহশিক্ষকতা। আর যাঁরা শিক্ষক-অধ্যাপকের চাকরি জোটাতে পারলেন না, সমীক্ষা করলে দেখা যাবে তাঁদের অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত যে চাকরিতে ঢুকলেন তার সঙ্গে বাংলা পড়াশোনার কোনও যোগাযোগই নেই। এরই মাঝে শোনা যায়, বিদেশে নাকি বাংলা ভাষা-শিক্ষকের চাকরির চাহিদা আছে। সেই চাহিদাটা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন করে বেরোনো ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে কতটা, তা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে ফেলে দেখতে পারেন প্রাজ্ঞজনেরা।

এ বার দেখা যাক রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতির কাঠামোটা। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করবে শিশুরা, কিন্তু সেটাও রাজ্যভিত্তিক। এই বেড়া ডিঙিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ছাড়া আর কেউ কি বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করার জন্য উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছবেন? আগেই বলেছি, বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর বাজারে কাজের জায়গা খুবই সীমিত। কাজের সুযোগ যখন খুব কম তখন উচ্চ মাধ্যমিকের পর স্নাতক স্তরে এমআইএল-টা আবশ্যিক থেকে ঐচ্ছিক স্তরে সরে যাওয়ার পর কে আর ভালবেসে বাংলা পড়বে? হ্যাঁ, এখন থেকে ‘কোর’ আর ‘ইলেকটিভ’-এর ধারণাটা বদলে যাচ্ছে। তার বদলে এসেছে ‘মেজর’ আর ‘মাইনর’। আসছে সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, গ্র্যাজুয়েট উইথ বা উইদাউট অনার্স ইত্যাদির ধারণা। এই অবস্থায় কাজের বাজারে একটি ‘অবাঞ্ছিত’ ভাষাকে ছেলেমেয়েরা কি শুধু ভালবাসার টানে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা স্তরে পড়তে চাইবে? যদি কোনও রাজ্য সরকার আশ্বাস দেয় যে, রাজ্যভাষা জানা থাকলে চাকরি পেতে সুবিধে হবে, সে ক্ষেত্রে সেই রাজ্যভাষা ছেলেমেয়েরা পড়বে। পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কিছু নির্দেশ জারি থাকলে হয়তো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো ‘বাংলা খুব কম সংখ্যক পড়ছে’ এই অজুহাতে বাংলার শিক্ষক ছাঁটাই করবে না।

আমাদের ভাবা প্রয়োজন, কী ভাবে ভাষাকে বাজারমুখী করে তোলা যায় বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাকে উৎপাদনক্ষম করে তোলা যায়। এখনও পর্যন্ত বাংলা ভাষা সাহিত্যের যে পাঠক্রম চলছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা মোটেই বৃত্তিমুখী নয়, বা এতে কোনও স্বনির্ভরতাও তৈরি হয় না। আজকে এক জন পরিবেশবিদ দরকার যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো অধ্যয়ন করে সেগুলো সমাধানের জন্য পুঁজি বিনিয়োগে সাহায্য করবেন, সেটা বাংলা ভাষায় সম্ভব কেন হবে না? কেন তাঁর অধ্যয়নের ভিত্তি গড়ে দিতে বাংলা সহায়ক হতে পারবে না? এক জন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ দরকার, যিনি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’কে বাংলা ভাষায় ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলতে পারবেন, বাংলা বিদ্যাচর্চার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এটা সম্ভব করে তোলার মতো পাঠক্রমের কথা কেন ভাবা হবে না? পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত অনুবাদ চর্চা কেনই বা শুধু কয়েকটা পাঠের পড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? কেন সেটা অনুবাদকের চাকরি পাওয়ার উপযুক্ত হবে না? বর্তমানে ‘মিডিয়া’ একটা কাজের জায়গা। এখানে সংবাদপাঠ, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা বা সঞ্চালনা ইত্যাদিকে বৃত্তি হিসাবে নিতে পারে শিক্ষার্থীরা। তবে এর জন্য ‘মাস কমিউনিকেশন’-এর ডিগ্রিধারীরাই কেন যোগ্য বিবেচিত হবেন? বাংলার পাঠক্রম কি তার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায় না?

এখন যা অবস্থা, তাতে পঞ্চম শ্রেণির পর আর কোনও বাঙালি অভিভাবকই বাংলা ভাষার দিকে মুখ ফেরাবেন না। তাই প্রয়োজন পাঠক্রমের পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে, বাঙালির চাকরি করা আর বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে চাকরি পাওয়া— এই দু’টির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। সুতরাং, আজকের দিনে বেশি প্রয়োজন মানসিকতা বদলের— পাঠক্রম তৈরিতে, তার উপযুক্ত বই প্রকাশে এবং বাজারের। এত কাল ধরে বাংলা ভাষা-সাহিত্য শেখানোর পদ্ধতিকে সংশোধন করতে হবে। সদিচ্ছা সব মহল থেকেই কাম্য। নচেৎ বাংলা বিদ্যাচর্চার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি আসন্ন— কোথাও আগে কোথাও পরে।

জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, গুয়াহাটি, অসম

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement