মন্দারমণিতে পর্যটকদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র।
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘সিন্ধুসৈকতের ঘাতক’ (৪-২) প্রবন্ধটি পড়ে ম্যাথু আর্নল্ডের ‘ডোভার বিচ’ কবিতার নগ্ন সমুদ্রসৈকতের কথা মনে এল। এখানে সৈকত তো রূপক। পরিবেশ বাঁচানোর দায় আমাদের সবার। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলছে, শুধুমাত্র পরিবেশজনিত কারণে আজ দশ কোটিরও অধিক মানুষ ভিটেছাড়া। রাজস্থানের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে, নগরায়ণ এবং খননকার্য যদি অব্যাহত থাকে, তবে ২০৫৯ সালের মধ্যে আরাবল্লি পর্বতের ২২ শতাংশই উধাও হয়ে যাবে, যা দেশের রাজধানীর দিকে থর মরুভূমিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করে তুলবে। অর্থাৎ, ওই অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি রুক্ষতর হবে, দূষণমাত্রা বাড়বে, বাড়বে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাও। অন্য দিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই ধস নামছে উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠ-সহ বিভিন্ন জায়গায়। নিরাপদে নেই আমাদের দার্জিলিংও। নাগরিক সচেতনতারও বড্ড অভাব। কলকাতা পুরসভার তথ্য বলছে, ৩০-৪০ শতাংশ জলের অপচয় হচ্ছে, তাই জলের জোগান বাড়িয়েও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। সংবিধানের ৪৮এ ও ৫১এ (জি) ধারাতে সরকার ও নাগরিকদের পরিবেশ নিয়ে তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করেছে। এম সি মেহতা বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় মহামান্য আদালত বলেছিল, মানুষকে সজাগ করতে সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা করে পরিবেশ নিয়ে ক্লাস করা উচিত। তবু মানুষ সজাগ হচ্ছে কই? মানুষ সচেতন না হলে এ ঘাতকের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব।
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
আগ্রাসন
‘সিন্ধুসৈকতের ঘাতক’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। দিঘার সমুদ্রের ‘আগ্রাসন’ তো আজকের ঘটনা নয়। উষ্ণায়ন তখনও বিজ্ঞানীদের ভাবায়নি, এমন সময়ে সমুদ্র স্থলভাগের দিকে এগোতে শুরু করেছে। আজ উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বাড়ছে বছরে ০.০১৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হারে। আর সমুদ্রের জলতলের বার্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৩ মিমি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টিপাত। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালে সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বেড়ে হতে পারে ৫০ সেমি। এর ফলে শুধু দিঘা নয়, ভারতের উপকূলে অবস্থিত শহরগুলির বহু অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে চলে যাবে। এর সঙ্গে আর একটি প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। উপকূলকে রক্ষা করার জন্য ‘কোস্টাল রেগুলেটরি জ়োন’ বা সিআরজ়েড আইন না মানা। এ ছাড়া ভারতে গত ১২০ বছরে ‘সাইক্লোনিক অ্যাক্টিভিটি’ বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। বার বার সিডার, বিজলি, আয়লা, হুদহুদ, আমপান, ইয়াসের মতো বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ উপকূল। স্থানীয়দের দুর্ভাগ্য, বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের আশ্চর্য নীরবতা। নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পাবে তো?
নন্দগোপাল পাত্র, সটিলাপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
খবরদারি
‘সিন্ধুসৈকতের ঘাতক’ সময়োপযোগী। বাস্তবিকই উদয়পুরের সমুদ্রসৈকতে ঠিক বারো বছর আগে গিয়ে যেন এক মুক্তির আনন্দ উপলব্ধি করেছিলাম, দিঘার জনঅরণ্য থেকে পালিয়ে। বছর দুয়েক আগে সেই একই জায়গা থেকে পালাতে হল, তীব্র বিবমিষার উদ্রেক হওয়ায়। এ কোন সংস্কৃতি! সাগরের জলে পা ডুবিয়ে মদ্যপানের আয়োজনই কি উন্নয়ন? কেবল সামান্য কিছু লোকের রুজি-রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেওয়াই যদি উন্নয়নের অভিমুখ হয়, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় কি?
একই কথা প্রযোজ্য বকখালির প্রসঙ্গে। চাঁদনি রাতে যেখানে সমুদ্রের সঙ্গে কথা কওয়া যেত, অন্ধকারের এক নিজস্ব আলো জ্বলে উঠত তটভূমিতে, আজ সেখানে হাই-মাস্ট বাতির চোখ ধাঁধানো আলো আর বাঁধানো রাস্তার ধারে শয়ে শয়ে দোকান সমুদ্রটাকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে। পরিবেশের উপর খবরদারি করে পর্যটনের একটি নির্দিষ্ট জনমোহিনী নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। যে লামাহাটায় এক নির্জন পাইনের বন হাতছানি দিয়ে ডাকত, আজ সেখানে নীল-সাদা পার্ক, আর দোকানের সারি।
নির্মাল্য চট্টোপাধ্যায়, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
স্মৃতির সৈকত
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পড়ে স্মৃতিচারণের ইচ্ছা প্রকাশ পেল। আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগেকার কথা। বিয়ের পরই দিঘার সমুদ্রসৈকতে মধুচন্দ্রিমা কাটানোর অছিলায় অর্ধাঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে এক সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে রওনা হয়েছিলাম। মেচেদা স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বাস ধরে সোজা দিঘায় পৌঁছেছিলাম বিকেলবেলায়। পুরনো দিঘাই সেই সময় জমজমাট ছিল। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই সরকারি ‘দিঘা টুরিস্ট লজ’। সেখানেই উপরতলায় একটা ভাল ঘর নিলাম। সেই ঘরের জানলা থেকে সমুদ্র পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দু’জনে মিলে সমুদ্র দেখার পাশাপাশি সমুদ্রের বুকে সূর্য ডোবার দৃশ্য চাক্ষুষ করলাম। সে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য। পরের দিন সকালে ঝাউবন দেখতে যাওয়া। ঝাউবনের ভিতর দিয়ে দু’জনের পথ চলা শুরু হল।
তার পরে দিঘার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বছর চারেক আগে আবার পরিবার নিয়ে দিঘায় গিয়েছিলাম। এ বার নতুন দিঘায়, নতুন ঠিকানায়। কিন্তু এ বার দিঘায় পা রেখেই মনে হল, এ কোন দিঘায় এসেছি? কোথায় সেই ঝাউবন, আর কোথায় সেই নিরিবিলি সমুদ্রসৈকত? সব পাল্টে গেছে। কথায় আছে, ‘পুরাতনকে সরিয়ে নতুন তার জায়গা করে নেয়’। এই নতুন কি আর পাঁচটা জায়গার মতো পরিবেশের ভারসাম্য উপেক্ষা করেই গড়ে উঠেছে? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সরিয়ে সেখানে কৃত্রিম সব রকম কর্মকাণ্ড চলছে। সমগ্র সৈকত জুড়ে এখন যেন দূষণের সাম্রাজ্য। এর শেষ কোথায়? কেউ কি দিঘার পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে দিতে পারবে, না কি মানুষ পুরনো বালুকাবেলার স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে থাকবে?
সন্তোষ কুমার দে, হাওড়া
বেলাভূমি
‘সিন্ধুসৈকতের ঘাতক’ পড়ে ত্রিশ বছর আগের দিঘা ভ্রমণের কথা মনে পড়ে গেল। ওল্ড দিঘা থেকে সৈকত বরাবর হেঁটে ঝাউবন পেরিয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী ছোট সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে যেতাম নিউ দিঘার শান্ত পরিচ্ছন্ন বালুকাবেলায়। গত বছর সেই নিউ দিঘা সৈকতে দেখে এলাম সমুদ্র আড়াল করা দোকানপাট, প্লাস্টিক ও অন্যান্য দূষিত বর্জ্য ও মানুষের থিকথিকে ভিড়। সবচেয়ে আশ্চর্য, এখানে সরকারের উদ্যোগেই ধ্বংস হয়েছে ঝাউবন আর গড়ে উঠেছে কংক্রিটের জঙ্গল। বছর পঁচিশ আগে বকখালিও ছিল এ রকমই সাদামাঠা গ্রাম, যার সাগরবেলায় বিকেলে দেখা যেত সূর্যাস্তের অপরূপ রঙের খেলা। চাই কি সাগরের কাছে গিয়ে দুটো মনের কথা বলা যেত। সন্ধে হতেই আমরা ফিরে আসতাম, কারণ তখন বেলাভূমিতে আলোর ব্যবস্থা ছিল না। এখন সেই বকখালির সৈকত জমজমাট বাজার।
মকরসংক্রান্তির মেলার সময় বাদ দিয়ে বছরের অন্য সময় এখন হয়তো গঙ্গাসাগরে যাওয়া যায়। তবে সেই যে আমরা কপিলমুনির মন্দির থেকে বিস্তৃত বালির তটভূমি দিয়ে হেঁটে সোজা সাগরে যেতাম, সেখানে এখন সিমেন্টের বাঁধানো রাস্তা, পাকা ঘরবাড়ি, সরকারেরই বদান্যতায়। খুঁজে খুঁজে এখনও সাগরবেলায় মনের কথা কইতে যাই।
মন্দারমণির কাছেই দক্ষিণ পুরুষোত্তমপুর গ্রামের নির্জন লাল কাঁকড়া বিচ-এ। তবে এখানেও হোটেল ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি পড়েছে, প্রবন্ধকারের ভাষায় বেলাভূমি ‘খুন’ হওয়ার অপেক্ষায়। আর একটি একেবারেই পর্যটকশূন্য, অবারিত বিস্তৃত সাগরবেলা, সম্ভবত দুর্গমতার কারণে, সুন্দরবনের জি প্লট গোবর্ধনপুর গ্রামে। সেখানে এখনও সমুদ্র হাতছানি দেয়।
শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা