সেমন্তী ঘোষের ‘শাসকের চোখে চোখ রেখে’ (৮-৬) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ১৯৭৭ সালের পর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন আরও এক বার প্রমাণ করল, ভারতের জনগণ স্বৈরতন্ত্রকে সঠিক সময়ে রুখে দিতে পারে। রামমন্দিরের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ জুড়ে ‘মাস হিস্টিরিয়া’ তৈরি করে নির্বাচনে বাজিমাত করার চেষ্টা হয়েছিল। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে সেই অযোধ্যাতেই শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিজেপিকে। ‘অব কি বার চারসো পার’ এই স্লোগান ভারতের প্রান্তিক মানুষেরা স্বৈরতন্ত্রের পদধ্বনি বলে মনে করেছে, সেই কারণেই সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেলের জনমত সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করে বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা দেয়নি তারা।
এই প্রথম নরেন্দ্র মোদী জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে আশা করা যায়, গত পাঁচ বছর আমরা যে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি’ দেখেছি, আগামী লোকসভায় তার পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে না। প্রবন্ধে সঠিক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত দেশটাই হচ্ছে একটা ‘কোয়ালিশন’ বা ‘ফেডারেশন’। সুতরাং আমাদের দেশে জোট সরকার হওয়াটাই স্বাভাবিক। গত ১০ বছরে এক দেশ, এক ভাষা, এক নেতার নাম করে ভারতের স্বাভাবিক সত্তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। আগামী দিনে দেশে হয়তো আবার নানা ভাষা নানা মতের রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হবে। এ বারের নির্বাচনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই গুণগত পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন অল্প কিছু নির্ভীক সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম ও ইউটিউবের কিছু সাংবাদিক। এঁরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গরিব ও খেটে-খাওয়া মানুষদের ‘রাজার কাপড়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছেন।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
ঘৃণার বিরুদ্ধে
সেমন্তী ঘোষ তাঁর প্রবন্ধে সাম্প্রতিক নির্বাচনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সার্থক ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। এই নির্বাচনে গণদেবতার রায় আমাদের লুপ্তপ্রায় নাগরিক অধিকারকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবে বলেছেন, দারিদ্র, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অনধিকারে জর্জরিত দেশে শাসকদের সীমার হদিসটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন দেশের মানুষ। অপপ্রচার, ঘৃণাভাষণ, চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে মানুষ তাঁদের সাংবিধানিক পবিত্র অধিকার প্রয়োগ করে একটি অশুভ সম্প্রসারণবাদী শক্তির বিস্তারকে বন্ধ করেছেন। এই নির্বাচন তাই এই শিক্ষাবঞ্চিত, মূর্ছিত, পীড়িত দেশের জনমতের জাগ্রত সত্তাকে উজ্জ্বল ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, শাসক তাঁর ক্ষমতাকে আরও কুক্ষিগত করতে চেয়ে সংবিধানের মৌলিক রীতিগুলি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী সেই অপচেষ্টাকে রুখে দিয়েছে। ১৯৭৭ সালেও এই জাগ্রত গণদেবতা দেশের একনায়কতন্ত্রকে পরাজিত করে আবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ভারত একটি বহুত্ববাদী দেশ। এখানে ‘শক-হুন-দল পাঠান মোগল’ এক দেহে লীন হওয়ার জীবনচর্যা বহু প্রাচীন কাল থেকে। মেকি হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে ঐতিহাসিক জায়গার নাম পরিবর্তন করে, ইতিহাস পাল্টানোর অপচেষ্টা করে, শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেবাস পরিবর্তন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে একটা বিরূপ বাতাবরণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। নির্বাচনী প্রচারে সেই বাতাবরণকে আরও সংগঠিত করার অপচেষ্টাকে নির্বাচকমণ্ডলী ব্যর্থ করে দিয়েছে।
চারশো আসন চাওয়ার লক্ষ্যে একটি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার বাতাবরণ তৈরি করতে চাওয়া হয়েছিল, জনতা জনার্দন তাতে জল ঢেলে দিয়েছে। নতুন সরকার হয়েছে জোট সঙ্গীদের সাহায্যে। নোটবন্দি, ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি চালু প্রভৃতি তুঘলকি নীতিগুলি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকে আলোচনা না করেই রাতারাতি জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতে ক্ষতি হয়েছে আমজনতার স্বার্থের। কত ব্যবসা উঠে গিয়েছে, হাজার হাজার লোক হয়েছে কর্মহীন। এই কর্মহীনতা বিষয়ে কোনও আলোচনা আমরা সরকারের কাছে শুনিনি। সরকারি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি অপ্রতিহত, জ্বালানির দাম বাড়ায় অসুবিধা বেড়েছে। সরকার শুধু কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করতে কর মকুব, ঋণ মকুব বিষয়ে সচেষ্ট হয়েছে।
যৌথ সরকারে সিদ্ধান্ত সকলকে সঙ্গে নিয়ে নিতে হবে। যৌথ সরকার ভারতে ১৯৯১ সাল থেকেই ধারাবাহিক ভাবে চলছে। সেই আর্থিক সংস্কার থেকে শুরু করে নানান গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ভারতের জাতীয় আয়, সঞ্চয়, নিয়োগ, বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করেছে এই জোট সরকারগুলির আমলেই। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই বলেছেন, ভারত একটি নানা ভাষা নানা মতের বিভিন্নতা সমৃদ্ধ বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। এই নির্বাচন সেই ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করল। আশা করা যায়, সহমতের ভিত্তিতেই এই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, কোনও একনায়কের খেয়ালখুশিতে নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজ়ভেল্ট বলেছিলেন, “আমাদের গণতন্ত্রের শাসক প্রেসিডেন্ট, সেনেটর বা কংগ্রেসম্যান বা সরকারি অফিসাররা নন, আমাদের আসল শাসক হচ্ছেন আমাদের দেশের ভোটাররা, এ কথা যেন কখনও আমরা না ভুলি।”
সরোজ উপাধ্যায়, কলকাতা-৫০
দুর্নীতির দৌড়
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমাজমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের বড় অংশ একটা প্রশ্নকে সামনে টেনে আনছে: দুর্নীতির মতো এমন এক জ্বলন্ত বিষয় কেন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারছে না? পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যা আসন পেয়েছে, তার বেশির ভাগটাই গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস শহর এবং গ্রাম, উভয় জায়গাতেই খুব ভাল ফল করেছে। দক্ষিণ কলকাতার মতো জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেস ৪৯ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে, যেখানে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩৪ শতাংশ। উত্তর কলকাতায় এই হার যথাক্রমে ৪৭ শতাংশ এবং ৩৮ শতাংশ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার করেই কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালে এসে এ বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে কাজ করল না। শহরের মানুষও ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপরে স্থান দিয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রভাব। এই সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলি আজকের রাষ্ট্রকাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই প্রয়োজনীয়। একটা স্থূল হিসাব কষলে দেখা যাবে যে, প্রতি এক লক্ষ পশ্চিমবঙ্গবাসীর মধ্যে প্রায় কুড়ি হাজার জন শুধুমাত্র কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উপকৃত। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিত বাসোলের নেতৃত্বে স্টেট অব ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া-২০১৮ রিপোর্টে খুব পরিষ্কার করে দেখানো আছে যে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হারের সঙ্গে কাজের সুযোগ তৈরির হারের কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং, মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করতেই হয়।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মাসিক গড় আয় মোটামুটি ১২০০০ টাকার কাছাকাছি। সব পরিবারের আয় এই টাকা ধরে নিলে শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডারের ১০০০ টাকা পারিবারিক আয় মাসে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি তৃণমূল নেতৃত্ব খুব সুচারু ভাবে ১০০ দিনের কাজের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখেছে বলে প্রচারটি এই প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এই টাকা আটকে যাওয়ায় এই মানুষদের মাসিক আয় প্রায় ২০০০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলের ভোটে এই সমস্ত বিষয় প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে হয়।
প্রতীপ কুমার দত্ত, বোলপুর, বীরভূম