সম্পাদক সমীপেষু: প্রতিবাদী ঋত্বিক

শ্রীমুখোপাধ্যায় এই আবহেই কলম ধরেছেন। তাঁর লেখায় তিনি ‘দোহাই আলি’-কে হতদরিদ্র অতিসামান্য মুসলমান জেলের গান বলে চিহ্নিত করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ‘‘দোহাই আলি!’ কাঁদছে দেশ’’ (৩-১) শীর্ষক প্রবন্ধটির সূত্রেই দু’এক কথা সংযোজন করতে এই চিঠি। গেরুয়া শিবির দিন কয়েক আগে জানিয়েছে, নাগরিকত্ব আইনের প্রচারে তারা ঋত্বিক ঘটকের ছবির অংশ ব্যবহার করবে। তারা প্রমাণ করতে চাইছে ঋত্বিক ছিলেন ‘হিন্দু উদ্বাস্তুদরদি’। এর কড়া নিন্দা করা হয়েছে ঋত্বিকের পরিবারের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি উঠে এসেছে আর একটি ভাবনার স্রোত, এক দল বলতে শুরু করেছেন, ঋত্বিক দেশভাগ এবং তার ফল হিসেবে মুসলমান সমাজের দুর্দশা চিহ্নিত করতে চাননি, হয়ে উঠেছেন মধ্যবিত্ত হিন্দু ইন্টেলেকচুয়াল।

Advertisement

শ্রীমুখোপাধ্যায় এই আবহেই কলম ধরেছেন। তাঁর লেখায় তিনি ‘দোহাই আলি’-কে হতদরিদ্র অতিসামান্য মুসলমান জেলের গান বলে চিহ্নিত করেছেন। তুলে এনেছেন ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ গানটির প্রসঙ্গও। আমার মনে হয়, এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শুধু এটুকু উল্লেখ যথেষ্ট নয়। এই (দোহাই আলি) শব্দবন্ধ বা ‘নামাজ আমার’ গানটি বাছাইয়ের কার্যকারণ, প্রয়োগের কৌশল আরও গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি।

‘দোহাই আলি’ প্রসঙ্গে বলি, শরিয়তি মুসলমানের পূজ্য হজরত আলি কখনও মাঝিমাল্লাদের ঈশ্বর না। দরিয়ায় জেলেরা পাঁচ পিরের সাধক কয়েক শতক ধরে। পিরানি বিশ্বাস, যা সততই শরিয়তের থেকে আলাদা, তা-ই এই পির সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। পাঁচ পির কারা, তাই নিয়ে মতভেদ আছে। গিয়াসউদ্দিন, তৎপুত্র শামসুদ্দিন, তৎপুত্র সেকেন্দার এবং সেকেন্দারের পুত্র বরখান গাজি ও কালুকে অনেকে পাঁচ পির বলে মেনে নেন। আবার মানিক পির, পাঁচ পিরের উপাসনাও দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলাতেও পাঁচ পিরের উল্লেখ আছে। পাঁচ পিরের প্রতীক হিসেবে হাতের পাঞ্জা পুজোরও চল আছে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বহু জায়গায়। এই পাঁচ পিরের উপাসক স্পষ্টতই সেই জেলেসমাজ শিয়া মূলস্রোতের অংশ নন। তাঁরা নিম্নবর্গের মুসলমান। আচারে বিশ্বাসে তাঁরা শরিয়তিদের থেকে আলাদা। তাঁরা সহজিয়া, মারফতিমার্গের।

Advertisement

জেলেদের আরাধ্য এই পাঁচ পির একত্রে অলি। অলি শব্দের অর্থ বন্ধু বা ঈশ্বর। অলি আরবি শব্দ। অলি থেকেই অপভ্রংশ আলি। যেমন বীরভূমের পাথরচাপুড়ি মাজারটি গড়েছিলেন মেহেবুব শাহ অলি/আলি। তাঁর মাজারে হিন্দু মুসলিম শিখ খ্রিস্টান সবাই যান। দোহাই আলি বলতে আসলে এই পাঁচ ঈশ্বরকেই ডাকা। আলি এ ক্ষেত্রে যেন অনেকটা সত্যপিরের ভূমিকা নিচ্ছেন। দরিয়ার পাঁচ পিরের সঙ্গে হিন্দু নিম্নবর্গ সরাসরি সম্পর্কিত। মারফতি মুসলমানই শুধু মাছ ধরতে যান না, হিন্দু নিম্নবর্গের জেলে/জলদাস সম্প্রদায়ভুক্তেরাও যান। যেমন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে ঋত্বিক মালোদের তুলে এনেছেন। এঁদের সকলেরই ঈশ্বর আলি তথা পাঁচ পির।

তাই আলিকে ডাকলে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভেঙে, ডাকটা নিপীড়িত অসহায়ের আর্তনাদ হয়ে ওঠে। বলা ভাল, দেশভাগ, রাতের আঁধারে সীমান্ত পেরোতে বাধ্য হওয়া, ধর্ষকের সামনে দাঁড়ানো, অথবা ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে রেলপথ পার হওয়া মেয়ের-মায়ের আর জাত থাকে না। তাঁরা হয়ে যান নিপীড়িত, অকূল পাথারে পড়া শোষিত, রিক্ত মানুষ। তাই তাঁদের কান্নার অনুরণন ছবিতে এঁকে ঋত্বিক ধর্মের ধূসরাঞ্চল মুছে দিয়ে হয়ে যান আবিশ্ব প্রত্যেক দেশ-হারানো মানুষের প্রতিনিধি।

‘নামাজ আমার’ গানটির কথা বলেছেন সঞ্জয়বাবু। এটি মরমিয়া সাধক দূরবিন শাহের গান। বাড়ির চাল ফুরিয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়ে বাড়িতে খিদের জ্বালায় কাঁদছে। তাই দূরবিন শাহ পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ আদায় করতে পারছেন না। অর্থাৎ ফের ক্ষুধিত নিপীড়িত, নিম্নবর্গের পক্ষেই গানটি সওয়াল করছে, ভাতের কথা বলছে, ক্ষুধার কথা বলছে, ধর্মচিহ্ন নয়।

কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল চাইলেই ঋত্বিক ঘটক তাদের হয়ে যাবেন না, প্রক্ষেপণের এই গভীরতার জেরেই। একই সঙ্গে আজকের ভারতে যখন দলিত-মুসলমান সম্প্রদায়েয় অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে, ঋত্বিক তখন আরও প্রাসঙ্গিক তথা ক্রান্তদর্শী হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের অন্যতম মুখ।

অর্ক দেব

সোদপুর, পানশিলা

কিছু প্রশ্ন

‘‘দোহাই আলি! কাঁদছে দেশ’’ (৩-১) নিবন্ধের প্রেক্ষিতে এই চিঠি।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ঋত্বিকের উদ্বাস্তুকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রগুলোর আলোচনায় অতিরিক্ত সূক্ষ্ম তত্ত্বের চাপে মূল কাঠামোটি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ঘটতে পারে। নীতার (‘মেঘে ঢাকা তারা’) পরিবার উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে যে সব অকল্পনীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়, তা কি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে পাওয়া যাবে? উদ্বাস্তু থিমটাকে সরালে অনেক সূক্ষ্ম ন্যারেটিভ কি বাঙ্‌ময় হয়ে উঠবে? একটি ভূখণ্ড থেকে ‘মাস এক্সোডাস’ (যা ছিল একদা ২৮%, এখন ৮%-এরও কম), যা পৃথিবীর আধুনিক ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা— তাকে অস্বীকার করতে গিয়ে, গোপন করতে গিয়ে, অবৈধ করতে গিয়ে আমরা বাঙালিরা বারুদের স্তূপ করে ফেলেছি। আর কে না জানে, বারুদ থাকলে কেউ না কেউ অচেতনে আগুন ছোঁয়াবে।

আর একটি কথা—অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ স্থান স্থানচ্যুতি প্রাকৃতিক। ইতিহাসের পরিহাস, অদ্বৈত মারা যাওয়ার আগে কলকাতার কাছে কয়েক ঘর উদ্বাস্তু মালো পরিবারের কাছে নাকি দেখা করতে যেতেন। এই জলের মাছগুলিকে দণ্ডকারণ্যের রুক্ষ প্রান্তরে আছড়ে ফেলা হয়েছে। অবিশ্যি ৭০ বছরেও সে স্থানচ্যুতির ইতিহাস কেউ লেখেনি।

সন্ধ্যাকর কয়াল

কলকাতা-১৪৪

সংবিধান শিক্ষা

দীপেশ চক্রবর্তীর ‘সাংবিধানিকতার ক্ষয়কাল’ (৫-১) নিবন্ধ পড়ে এই চিঠি। লেখক উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে ‘শিক্ষিত ভারতীয়দের’ মধ্যে ফোনালাপে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে সংবিধান বোঝবার জন্য এক উদ্দীপ্ত চর্চা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই অল্পসংখ্যক শিক্ষিত ভারতীয় ব্যতীত, যে বিরাট সংখ্যক সাধারণ ভারতীয় রয়েছেন, তাঁরা কোথায় যাবেন? কার কাছে সংবিধান বুঝবেন? স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও ভারতের বেশির ভাগ জনগণ সংবিধানের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে অজ্ঞাত। এই অজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস, অনাস্থা।

প্রয়োজন সর্বজনীন সংবিধান শিক্ষা। আবশ্যিক বিষয় হিসেবে সংবিধানকেও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

অনিমেষ দেবনাথ

বেতপুকুর, পূর্ব বর্ধমান

বিস্ফোরণ

নৈহাটিতে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পর থেকে বাজেয়াপ্ত বাজির মশলা নৈহাটির রামঘাটে মজুত করে প্রশাসনের তরফে প্রায় প্রতি দিন মশলা নিষ্ক্রিয় করার নামে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। প্রচণ্ড শব্দে বাড়ির জানালা-দরজা কেঁপে উঠল, ছাদ থেকে দেখলাম হিরোশিমা নাগাসাকির মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠছে। আমার সাড়ে চার মাস বয়সের নাতনি বিকট শব্দে চমকে গিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ানো হলেও, ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠতে লাগল। প্রশ্ন: বাজির মশলা নিষ্ক্রিয় করার এটাই কি পদ্ধতি? যা বয়স্ক এবং বাচ্চাদের পক্ষে ক্ষতিকর?

যদি তা-ই হয়, তা হলে প্রতি বিস্ফোরণে মশলার পরিমাণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হল না কেন? এ রকম কাজ করা হবে, আগে public address system-এ মানুষকে জানানো হল না কেন?

বলা হচ্ছে যাদের বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যাদের শারীরিক ক্ষতি হল তার নিরূপণ কী ভাবে হবে এবং কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে?

প্রদীপ বসু

নৈহাটি

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement