Bengalis and Nationality

সম্পাদক সমীপেষু: বাঙালির বৈশিষ্ট্য

বাঙালি সমাজের একাংশ আজ যে রামনবমীর মিছিলে শামিল হয়ে যাচ্ছে, ধর্মগত পরিচয় ঘোষণার ক্ষেত্রে যে কোনও কুণ্ঠাবোধ নেই, তার জন্য ‘গেল গেল’ রব তুলে লাভ নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ০৬:১৫
Share:

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য তাঁর ‘বিরোধ মানে বিদ্বেষ নয়’ (২৬-৫) প্রবন্ধে তথ্যসহযোগে দেখিয়েছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকল্পটি বঙ্কিমি আমল থেকে কোন পথে এগিয়েছে। আজ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া জোর হয়েছে, আর বাঙালি যে তাতে শামিল হয়েছে, তা-ও উল্লেখ করেছেন। ধর্মান্ধবাদী রাজনীতির যুগে বাঙালি জাতিসত্তার এ রূপ দেখে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বিচলিত বোধ করতে পারেন, কিন্তু এ সময় এই উন্মাদনা অনিবার্য ছিল বলেই মনে হয়। ধর্ম নয়, বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটতে পারত ভাষাগত চেতনায়। অতীতে তেমন ঘটেওছে। কিন্তু আজ আর তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। মাতৃভাষার প্রতি প্রেম তলানিতে ঠেকেছে। উপরন্তু শিক্ষা আজ আর বাঙালির অভিজ্ঞান নয়, সাংস্কৃতিক চেতনাও ক্ষয়িষ্ণু বলা যায়। শুধুমাত্র অতীতগর্বী হয়ে দিন কাটালে কি আর সাংস্কৃতিক চেতনার মানোন্নয়ন ঘটে?

Advertisement

বাঙালি সমাজের একাংশ আজ যে রামনবমীর মিছিলে শামিল হয়ে যাচ্ছে, ধর্মগত পরিচয় ঘোষণার ক্ষেত্রে যে কোনও কুণ্ঠাবোধ নেই, তার জন্য ‘গেল গেল’ রব তুলে লাভ নেই। ভরসা এই যে, বাঙালির হিন্দুধর্ম-কেন্দ্রিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো আগাগোড়াই স্বতন্ত্র। দুর্গাপুজো যত না ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তার চেয়ে শতগুণে সাংস্কৃতিক উৎসব। বঙ্গসমাজ স্বভাববৈশিষ্ট্যে বিবিধগ্রাহী, কোনও একবগ্গা সাংস্কৃতিক চেতনায় এ সমাজকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের বঙ্কিমি ভাষ্যে যুগপৎ সমর্থন ও বিরোধিতাকে বাঙালি আজও লালন করে। বঙ্গসমাজ কখনও জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে শামিল হয়, আবার তাদেরই একাংশ প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার কথা বলে, রাবীন্দ্রিক জাতীয়তার চর্চায় মন দেয়। ‘মনুষ্যত্বকে ন্যাশনালত্বের চেয়ে বড় বলিয়া জানিতে হইবে’— রবীন্দ্রনাথের এ বাণীকে শিরোধার্য করে বুদ্ধিজীবী বাঙালির অনেকে আজও বিশ্বমানবতা বোধে শামিল হতে চান। বাঙালি মনের এই দ্বিবিধ রূপকে না বুঝলে বাঙালির বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যাবে না। তবে কবি-লেখকরা অতীতে লালন-চৈতন্য-রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য জুড়ে দিয়ে বাঙালিসমাজের যে গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন, তা যে অতিরঞ্জিত ছিল, আজ তা প্রতীয়মান হয়। সে গৌরব অস্তমিত, আমরা এখন ভাবনাচিন্তা-বর্জিত সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছি।

শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪

Advertisement

শ্রদ্ধার ঐতিহ্য

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই চিঠির অবতারণা। বিবেকানন্দ বলেছেন, মানবজাতিকে সেই স্থানে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে বেদ, বাইবেল বা কোরান নেই, অথচ সে কাজ করতে হবে বেদ বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় সাধনে। “আমরা শুধু সব ধর্মকে সহ্য করি না, সব ধর্মকে আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, তৃতীয় খণ্ড)। বিজেপি নেতারা বাবরি মসজিদ ভাঙলেন, যেটা একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধ, যেমন আফগানিস্তানের তালিবানরা বুদ্ধের মূর্তি ভেঙেছিল। স্রেফ ভোটের জন্য পৌরাণিক চরিত্র রামচন্দ্রের নামে আবেগ জাগিয়ে তাঁরা মসজিদ ভাঙলেন। তাই প্রশ্ন, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ কিংবা বিবেকানন্দ কি হিন্দু ছিলেন না? তাঁরা তো হিন্দুদের বলেননি যে, মসজিদ ভেঙে রামমন্দির করো। স্বামী বিবেকানন্দ বার বার মনে করিয়েছেন, পুজো মানে মানুষের সেবা। মানুষকে ক্ষুধার্ত, শিক্ষাহীন রেখে মন্দিরে কোটি কোটি টাকা খরচ করাকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন। অথচ আমরা দেখছি, বহু কোটি টাকা খরচ করে রামমন্দির বানানো হল, রামনবমী উপলক্ষে তরোয়াল নিয়ে আস্ফালন হল। কারণ কী? ‘হিন্দুত্ব’ জাগাতে হবে, হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ জাগাতে হবে। নিজেদের শক্তি জাহির করা আর উত্তেজনা সৃষ্টি করা— এ-ই কি যথার্থ ধর্মের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন?

কোনও ধর্মপ্রচারকই অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে শেখাননি, এক ধর্মাবলম্বীদের শেখাননি অন্য ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণ করতে। বুদ্ধ ও মহাবীর দু’জনেই অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। হজরত মহম্মদ তাঁর পূর্ববর্তী তিন জন ধর্মপ্রচারককেও শ্রদ্ধা করতে বলেছেন, যদিও তাঁদের প্রচারিত ধর্মের সঙ্গে হজরত মহম্মদের মতপার্থক্য ছিল। তিনি নিজে কাউকে আক্রমণ করেননি। আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধে লড়াই করেছিলেন। এবং তিনি কোনও যুদ্ধবন্দিকে হত্যাও করতে দেননি।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— এঁদের চিন্তাও শিক্ষণীয়। আদর্শগত দিক থেকে গান্ধীজির মতের সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনেক তফাত ছিল, কিন্তু কখনও তাঁরা একে অপরকে অশ্রদ্ধা করেননি। নজরুলের নানা চিন্তার থেকে রবীন্দ্রনাথের তফাত ছিল যথেষ্ট, কিন্তু একে অন্যের প্রশংসা করেছেন। বরং ইতিহাস বলে, আরএসএস নেতারা এ দেশের বিপ্লবীদের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন। এমনকি বিপ্লবীদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা বাংলায় জায়গা করতে পারেননি। দুঃখের হলেও এ কথা সত্য যে, সেই সব শক্তি আজ দেশের মানুষের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাতে পারছে। দেশের মধ্যে ফ্যাসিবাদের প্রতিধ্বনি শুনতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

ভোটের ফল

এ বারের লোকসভার ফল বিজেপির কাছে অপ্রত্যাশিত। তাদের ভোটকুশলীরা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, সমগ্র উত্তর ভারতে বিজেপিকে উতরে দেবে রামমন্দির। বাস্তবে তা হয়নি। খাস উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির আসন কমেছে। অর্থাৎ, একটি বড় অংশের ভারতবাসী ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চাইছেন, মনোযোগী হচ্ছেন জীবনযাপনের বাস্তব সমস্যাগুলির প্রতি। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দারিদ্র, অপুষ্টির মতো দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত সমস্যাগুলি নিয়ে দশ বছরের বিজেপি সরকারের কাছ থেকে দেশবাসীর যে তুমুল প্রত্যাশা ছিল তা পূরণে দল অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। শুধু মুখের কথায় আর চিঁড়ে ভিজছে না।

মহারাষ্ট্র-সহ একাধিক রাজ্যে, যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে অন্য দল ভাঙিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে বিজেপি সরকার গঠন করার অভিযোগ উঠেছে, সেখানে তারা অপেক্ষাকৃত খারাপ ফল করেছে। দেওয়াল লিখন স্পষ্ট— এই অনৈতিকতা ভারতবাসী পছন্দ করছেন না। এ বারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যেই দলবদলকারী নেতারা পরাজিত হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এটাও বড় শিক্ষা। শুধু আবেগ তৈরি করে যে নির্বাচনী বৈতরণি পার করা যায় না, বিজেপির কাছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে বিজেপির তৃণমূল স্তরে সংগঠনের যা হাল, তা আর কহতব্য নয়। ভিড়কে ভোটের বাক্সে টেনে আনার জন্য যে সংগঠন প্রয়োজন, তা বিজেপি এখনও করে উঠতে পারেনি। বামফ্রন্টেরও ব্রিগেডের ভিড় পরিণতি পায়নি ভোটে। কিন্তু একই কাজ কংগ্রেস করতে পেরেছে কেরল, ও কিছুটা রাজস্থান, পঞ্জাবে।

বিশেষ কোনও মুখ-নির্ভর রাজনীতি বেশি দিন লাভজনক থাকে না। বিজেপির অতিরিক্ত মোদী-নির্ভরতা এ বার কাজে দেয়নি। বিজেপির অবস্থা অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে! ভারতের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক শিক্ষা ও বোধ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলতেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ধারণা বদলাবেন।

পলাশ মান্না, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement