Wealth

সম্পাদক সমীপেষু: তহবিল চাই না

শোনা যাচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি সম্পদের একটি বড় অংশ অসরকারি মালিকানার হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩৪
Share:

‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভাল রাখতে’ (২-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে ‘আন্তঃপ্রজন্ম সমদর্শিতার নীতি’ মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন রাহুল বসু। ইংল্যান্ড, নরওয়ের পথ অনুসরণ করে খনিজ বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তহবিল সংরক্ষণ করার কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু এই তহবিল কার হাতে থাকবে, ও তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী ভাবে নিয়োজিত হবে, জানা গেল না। উন্নত দেশগুলি তুলনায় দুর্নীতিমুক্ত, তাদের ভাবনা, ধারণাও আলাদা। ভারতের মতো দেশে আর্থিক দুর্নীতির অরাজকতায় নাগরিকদের লভ্যাংশ বিতরণ অবাস্তব পরিকল্পনা। হাতের কাছেই উদাহরণ— জঙ্গলমহল। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গ দুই রাজ্যের সম্পদ এই জঙ্গলমহল। সেখানকার নদী, পাহাড়, মালভূমি, ভূমিস্তর, জল, জঙ্গল, প্রাণী— সবই আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে। কারণ, খনিজ সম্পদ নির্বিচারে আহরণ করা হচ্ছে। ছোটনাগপুরের আদি অধিবাসী সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, খেড়িয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ভয়াবহ দশা হচ্ছে। এর থেকে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, যথাসম্ভব দেশের খনিজ সম্পদ নিরাপদ রাখা, যা আমেরিকা করে চলেছে।

Advertisement

এখন শোনা যাচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি সম্পদের একটি বড় অংশ অসরকারি মালিকানার হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। ছ’লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পদ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত অসরকারি মালিকের হাতে যাবে চার বছরের জন্য (২০২২-২৫)। তা থেকে প্রাপ্য রাজস্ব জাতীয় আয় বাড়াবে। প্রশ্ন হল, এই অসরকারি সংস্থাগুলি জাতীয় পরিবেশ নীতি কতটা মানবে? এদের লক্ষ্য হবে চার বছরে সর্বোচ্চ মুনাফা। প্রাকৃতিক সম্পদ যে নির্বিচারে আত্মসাৎ করা হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়। লেখকের পরামর্শমতো এদের মুনাফা থেকে আগামী প্রজন্মের জন্য তহবিল করার পরিকল্পনার অর্থ, সামান্য অর্থের বিনিময়ে অসরকারি মালিকদের অবাধে প্রকৃতিকে ভোগ করার ছাড়পত্র দেওয়া, যা কখনও উচিত নয়। আগামী প্রজন্মের জন্য প্রকৃতিকে যথাসম্ভব সংরক্ষণ করাই হবে যথার্থ নীতি।

শুভ্রাংশু কুমার রায়
চন্দননগর, হুগলি

Advertisement

অরণ্য জেলা
‘দুই পরগনা ভাগ নিয়ে চর্চা’ (৩-৪) শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, সুন্দরবন নামে একটি জেলা হবে, তা মোটামুটি ঠিক। পৃথক সুন্দরবন জেলার দাবি আজকের নয়। ভারতীয় সুন্দরবনের যে ১৯টি ব্লককে এখনও ‘সুন্দরবন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তার উত্তরের সীমারেখাটি নির্দিষ্ট হয়েছিল ১৮৩০ সালে ডাম্পিয়ার এবং হোজেস, দুই সাহেবের করা একটি জরিপের ভিত্তিতে। তাকে অনুসরণ করে ১৮৭৫ সালে একটি মানচিত্র তৈরি হয়। সেখানে ‘ডাম্পিয়ার-হোজেস লাইন’ নামে পরিচিত রেখার সাহায্যে তৎকালীন সুন্দরবনের উত্তরসীমা নির্ধারিত হয়। মেজর জেনারেল জেমস রেনেল (যিনি ১৭৬৪ সালে প্রথম ‘সার্ভেয়ার জেনারেল অব বেঙ্গল’ হয়েছিলেন) ১৭৬৪-১৭৭৭ সাল পর্যন্ত সময়ে গঙ্গা নদীর অববাহিকার (বিশেষত অবিভক্ত বাংলা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিম অসম ও ওড়িশার উত্তর-পূর্ব অংশের) প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপের কাজ করেছিলেন। এই জরিপের ভিত্তিতে ১৭৮০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ‘আ বেঙ্গল অ্যাটলাস’, যেখানে আমরা প্রথম বাংলার প্রামাণ্য মানচিত্র পাই। রেনেলের এই মানচিত্রে বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে শুরু করে ম্যানগ্রোভের বিস্তার দেখানো হয়েছিল কলকাতা পর্যন্ত। এর পর ‘সুন্দরবন’ অঞ্চলের মানচিত্র পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, ক্রমশই কমেছে সুন্দরবনের বনাঞ্চল। স্বাভাবিক ভাবেই ডাম্পিয়ার-হোজেস লাইন থেকে জঙ্গল সরে গিয়েছে অনেকটাই দক্ষিণে।

সাম্প্রতিক উপগ্রহ চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় সুন্দরবনের বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী ছোট বড় মিলিয়ে মোট ১০০টি দ্বীপে এখন জঙ্গল টিকে আছে। বর্তমান গবেষণায় প্রকাশ, অনেক দ্বীপ পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। আকার, আয়তন, অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এখন মানুষের বসতিযুক্ত দ্বীপের সংখ্যা ৩৫টি। সামগ্রিক ভাবে মানচিত্র পর্যালোচনা করলে জঙ্গল যে ক্রমশই কমছে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।

এ কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, ভারতীয় সুন্দরবনের খুব কাছে কয়েক লক্ষ মানুষের নিবিড় বসতি রয়েছে। এই সব মানুষ অনেকেই বেঁচে থাকার জন্য সরাসরি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। গত কয়েক দশকে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী মনুষ্যবসতিযুক্ত দ্বীপগুলিতে বহু রাস্তাঘাট, সেতু নির্মিত হয়েছে, চেষ্টা হয়েছে বাঁধকে যথাসাধ্য সুরক্ষিত করার। কিন্তু কাজ এখনও অনেক বাকি। এক দিকে যেমন দরকার জঙ্গল-ঘেঁষা মানুষদের বাঁচার জন্য নানা পরিকল্পনা, তেমনই দরকার অরণ্যের সংরক্ষণ।

জেলার ভাগের ক্ষেত্রে এই প্রসঙ্গে একটি বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করতে চাই। সুন্দরবনের যেটুকু অংশে এখনও প্রকৃত বনভূমি টিকে আছে, সেই অংশ নিয়ে তৈরি হোক একটি নতুন জেলা, নাম হোক ‘সুন্দরবন’। সুন্দরবন-সংলগ্ন লোকবসতিযুক্ত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে তৈরি হোক আর একটি জেলা, ‘প্রান্ত সুন্দরবন’।

এই ঘোষণা হতে পারে রাজ্য তথা গোটা দেশের জীব-ভূবৈচিত্র রক্ষায় এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ অরণ্য, একমাত্র ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেখানে বাঘ থাকে। সুন্দরবনের বিরল জীববৈচিত্রের সম্ভার অঞ্চলটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে। যদি আমরা তাকে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষণা করি, ক্ষতি কী? বাকি জেলাগুলি তো যথা নিয়মে রাজস্বের জোগান দেবেই।

জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী
ব্যান্ডেল, হুগলি

বনের আগুন
সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত পঞ্চকোট পাহাড়ের বনাঞ্চল-সহ পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ জঙ্গলে বার বার আগুন লাগার খবর ও ছবি দেখে শিউরে উঠতে হয়। গত বছর ওড়িশার সিমলিপাল টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্ট ও আমাদের রাজ্যের পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়েও ঘটেছিল একই রকম ‘দুর্ঘটনা’। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জঙ্গলে আগুন লাগার ও ছড়িয়ে পড়ার ধরনে বিস্তর মিল! জঙ্গলে স্বাভাবিক ভাবে আগুন লাগতে পারে মূলত তিনটি কারণে— বজ্রপাত থেকে, ঝড়ে শুকনো ডালপালার ঘষা লেগে, বা বনবাসীদের অসাবধানতায়। তবে এই সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বজ্রপাত, ঝড় ছাড়াই জঙ্গলের বন্যপ্রাণ-বিশিষ্ট ‘কোর এরিয়া’য় আগুন লাগছে বার বার, এবং তা ছোট ছোট ‘ঝাড়ি’-তে। দাবানল হলে এ রকম হওয়ার কথা নয়। তবে কি এর পিছনে শিকারিরা রয়েছেন? শিকার যত দিন অবৈধ ছিল না, শিকারিরা কিছু প্রচলিত পদ্ধতিতে শিকার করতেন। যেমন ‘সার্চ হান্টিং’, অর্থাৎ হেঁটে বা গাড়িতে করে জন্তু খুঁজে শিকার, ‘বিট হান্টিং’, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জন্তুদের তাড়িয়ে এক জায়গায় এনে শিকার, ‘মাচা শিকার’, ‘মড়ি শিকার’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও শক্ত তার দিয়ে তৈরি ফাঁস দিয়ে শিকার, ছাগল, মোরগ বা নুন-মহুল মিশিয়ে টোপ দিয়ে ‘ট্র্যাপ হান্টিং’ প্রভৃতি। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে আবার জংলি জন্তুর চলার পথে বন্দুক পেতে রেখে কল-পাতা শিকার পদ্ধতির প্রচলন ছিল। ‘ঝড়া’ শিকারও বেশ পুরনো। এখানে শিকারির দল জঙ্গলের একটা অংশে অর্ধবৃত্তাকারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উল্টো দিকের জঙ্গলে অস্ত্র নিয়ে বা ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করে। আগুনের ভয়ে জন্তুরা প্রাণ বাঁচাতে উল্টো দিকের জঙ্গলের দিকে ধাবিত হলে তাদের শিকার করা হত। জঙ্গল ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। তাই নিরন্তর নজরদারিই পারে বন্যপ্রাণ বাঁচাতে।

পলাশ মান্না
সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement