Rituals of Halkhata

সম্পাদক সমীপেষু: শরবতে আপ্যায়ন

শুধু শহর কলকাতায় নয়, অন্য শহর, শহরতলি এবং সংলগ্ন প্রতিটি এলাকায়, পাড়ায় পাড়ায় বাংলা বছরের এই প্রথম দিনটিতে ‘নতুন খাতা’র উৎসব পালিত হত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৬:৫৯
Share:

‘বাঙালির হালখাতায় হারানো-প্রাপ্তি’ (রবিবাসরীয়, ২৪-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রচেত গুপ্ত বাঙালির বিগত দিনের সামাজিক, পারিবারিক পরিবেশের কিছু কথা তুলে ধরেছেন। তার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু যোগ করতে চাই। এক সময়ে আমাদের যৌথ পারিবারিক ব্যবসা কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই হালখাতার পার্বণটিকে খুব ভাল ভাবে উপভোগ করে এসেছি। ওই দিন আমাদের দোকানে খাতাপুজো হত। আত্মীয়, পরিজন দোকানে আসতেন। পুজোর দিন খুব সকালবেলায় জেঠু ও বাবা লাল শালুতে বাঁধা নতুন খাতা নিয়ে কালীঘাটের মন্দিরে যেতেন। সেখানে গণেশ ঠাকুরের ছোট একটি মূর্তি কিনে বিধিমতো পুজো সমাপন করে দোকানে চলে আসতেন। নতুন খাতার প্রথম পাতায় রুপোর এক টাকার একটি মুদ্রায় সিঁদুর লাগিয়ে ছাপ দেওয়া হত। সেই সব খাতার আকার ছিল বেশ বড়সড়। জাবেদা খাতা, খতিয়ান, হালখাতা এমন সব নাম ছিল খাতাগুলোর। এর পর নতুন খাতার পাতায় কলম দিয়ে লাল কালিতে লেখা হত এই কথাগুলি— “সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ। শ্রীশ্রী কালীমাতার শ্রীচরণপ্রসাদে এই কারবার করিতেছি।” সারা দিন ধরে দোকানে লোকজনের আসা-যাওয়া চলত। পাশাপাশি দোকানের মানুষজনও প্রত্যেকের দোকানে যেতেন, নতুন বছরের জন্য শুভ কামনা করতেন। প্রত্যেককে শরবত ও মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। সঙ্গে থাকত আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপহার হিসেবে সুদৃশ্য একটি ক্যালেন্ডার। এ ছবি তখনকার দিনের সব বাঙালি ব্যবসাদারের বাৎসরিক উৎসবের এক সার্বিক ছবি।

Advertisement

শুধু শহর কলকাতায় নয়, অন্য শহর, শহরতলি এবং সংলগ্ন প্রতিটি এলাকায়, পাড়ায় পাড়ায় বাংলা বছরের এই প্রথম দিনটিতে ‘নতুন খাতা’র উৎসব পালিত হত। হাটবাজার থেকে শুরু করে পাড়ার মুদির দোকান, মনিহারি দোকান, খড়-বিচালি-কয়লার দোকান, কাপড়ের দোকান, সোনার গয়নার দোকান, এমন সব দোকানের ব্যবসায়ীরা হালখাতার এই অনুষ্ঠান একই ভাবে, একই নিয়মে পালন করতেন। পাড়ার দোকানগুলো ফুল-মালার সাজে সেজে উঠত। দোকানের সামনের খোলা রাস্তার একধারে সার দিয়ে তখনকার দিনের দু’ভাঁজ করা কাঠের চেয়ার পাতা থাকত অতিথি-খরিদ্দারদের জন্য। দৈনন্দিনের সাংসারিক জিনিস সরবরাহকারী দোকানগুলোতে আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে নগদ টাকা জমা রাখারও ব্যবস্থা থাকত। বিশ, ত্রিশ, বা তার কিছু বেশি নগদ টাকা আমন্ত্রিত খরিদ্দাররা জমা দিতেন ওই দোকানগুলোতে। দোকানের মালিক একটি খাতায় সে সব লিখে রাখতেন, আর পরে জিনিস কিনতে এলে জিনিসের মূল্য হিসাব করে সেই টাকা কাটাকাটি করে দিতেন।

এ ভাবেই পারস্পরিক আদানপ্রদান, মেলামেশা ও সৌজন্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে পালিত হত সে দিনের পয়লা বৈশাখ। নতুন খাতার উৎসব পালনের ধারা আশির দশকের শেষ পর্যন্ত তুলনায় কিছুটা কম হলেও বজায় ছিল, কিন্তু তার পর সেটি তেমন ভাবে আর লক্ষিত হয়নি। এটা পরিতাপের বিষয়। এখন অবশ্য বিশেষ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এই রীতিটা একটু আলাদা ভাবে অনুসরণ করার ব্যবস্থা চলছে। তবে সেগুলি সংখ্যায় খুব কম।

Advertisement

অমলকুমার মজুমদার, শিবপুর, হাওড়া

পয়লার স্বাদ

বাঙালির হালহকিকত নিয়ে প্রচেত গুপ্ত তাঁর প্রবন্ধে গল্প-কথায় যে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের ভাবনা ও চালচলনেও বদল আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই পরিবর্তন যদি শুধুমাত্র মানুষকে একমুখীই করে তোলে, সেটা কোনও মতেই কাম্য হতে পারে না। বংশপরম্পরাগত ভাবে যে ঘরবাড়ি, জমিজমা বা জলাশয়ের অধিকার আমরা পেয়েছি, শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের অপারগতার অজুহাতে ও নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের প্রলোভনে সেগুলোকে ধ্বংস করে সেই স্থানে আমরা যে ভাবে একের পর এক আবাসন নির্মাণে ব্রতী হচ্ছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এড়িয়ে যাওয়া যেত বলেই আমার মনে হয়। বাস্তুতন্ত্রের এই বিপরীতমুখিতায় পরবর্তী সময়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি কিন্তু ব্যাহতই হয়, যাতে চিড় ধরে আমাদের বাঙালিয়ানাতে।

অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা পাড়ার দোকান বা বাড়ির সামনে আসা আনাজ বা মাছ বিক্রেতার থেকে বাজার করার জন্য প্রায় কোনও পরিশ্রমই হয় না, এ কথা ঠিক। কিন্তু বাজারে গিয়ে নিজের পছন্দের আনাজ বা মাছ দরাদরি করে অপেক্ষাকৃত কম দামে কেনা এবং নিজে হাতে বেছে সেরা জিনিস কেনার মধ্যে যে রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে, সেই মানসিক শান্তি বাজারু বাঙালিকে খানিক বাড়তি অক্সিজেন জোগায়, যা সব দিক থেকেই স্বাস্থ্যকর। ক্যালরি মেপে খাওয়া শরীরকে ভাল রাখতে সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু ফুলকো লুচির সঙ্গে বেগুন ভাজা বা আলুর দম, কিংবা রবিবারের অলস দুপুরে খাসির মাংস-ভাত, বা বিভিন্ন মিষ্টির সঙ্গে দই, এই স্বাদ বা অনুভূতির কোনও তুলনা হবে না। খাদ্যরসিক বাঙালির এই অভ্যাসগুলি মাঝে মাঝে ঝালিয়ে নিতে পারলে মানসিক যে শান্তি মিলবে, তা শারীরিক অনেক প্রতিবন্ধকতাকেই দূরে সরিয়ে দিতে পারে, চিকিৎসাবিজ্ঞানেও যার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।

আমরা চিরকাল জেনে এসেছি, সব খেলার সেরা বাঙালির ফুটবল, যা নিয়ে নস্টালজিয়ায় আমরা কমবেশি প্রায় সবাই আক্রান্ত। যতই আমরা ঘরে বসে বিশ্বের আধুনিক ফুটবল নিয়ে মাতি না কেন, প্রতি বছরই কিন্তু পয়লা বৈশাখের দিনে ফুটবলের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ত প্রতিটি ফুটবলপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে। ক’দিন পরেই তা চরমে উঠত দলবদলের মুচমুচে খবরে। বাংলা ও বাঙালি খেলোয়াড়ের সেই আধিপত্য নিয়ে যে গর্ব ছিল আমাদের, তা অবশ্য আজ অনেকটাই ম্রিয়মাণ। পরিশেষে প্রবন্ধকারের কথার রেশ টেনে বলতেই হয়, যে মিষ্ট স্বভাবের জন্য বাঙালি এত সমাদৃত, তা অক্ষুণ্ণ রাখতে গেলে একটু নস্টালজিক হলে মন্দ কী!

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

আরও গাছ

আবহাওয়া দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে গত কয়েক বছর ধরে। ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে ক’দিন আগেই তাপমাত্রার নিরিখে রাজস্থানকে ছাপিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সুরক্ষা কমিটিগুলির রিপোর্ট অনুযায়ী, আগামী দিনে তাপমাত্রা এ ভাবেই বাড়তে থাকবে, ফলে অদূর ভবিষ্যতে মানব জীবনে নেমে আসতে চলেছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে বিনষ্ট বনভূমির অন্তত ৭০ শতাংশ অঞ্চলে বনসৃজন না হলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এই তাপমাত্রা চরম আকার ধারণ করতে পারে। তখন গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যেতে পারে, ফলে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। দেখা দেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর মারণব্যাধি। হারিয়ে যেতে পারে বহু প্রজাতির প্রাণী, ফলে সমগ্র খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়তে পারে। সুন্দরবন তথা বিভিন্ন উপকূলীয় ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে। ফলে বাস্তুসঙ্কট চরম আকার ধারণ করতে পারে। ঘন ঘন বন্যা ও ধ্বংসাত্মক গতিসম্পন্ন ঝড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে, ইতিমধ্যেই যা টের পাওয়া যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদের প্রত্যেক বছর অসংখ্য বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। নদী-উপকূলবর্তী অঞ্চলে গড়ে তুলতে হবে বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি। সরকারি ভাবে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করতে হবে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এ বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যৌথ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের সঙ্কল্প হোক আগামীর প্রজন্মের কাছে একটি দূষণমুক্ত এবং রোগমুক্ত পৃথিবী রেখে যাওয়া।

শংকর নাইয়া, মথুরাপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement