‘অবহেলার চিকিৎসা’ (১৫-১০) নিবন্ধে কুমার রাণা রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার বিশ্লেষণ করেছেন। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও ভারতে জনস্বাস্থ্যের ভিত দুর্বল। গ্ৰামাঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই অপুষ্টির কারণে দুর্বলতা। আমরা বুঝতে পারি, অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী রক্তাল্পতায় ভুগছে। তাদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির অন্যতম কারণ যেমন তাদের মায়েদের অসুস্থ হয়ে পড়া, তেমনই তাদের নিজেদের অসুস্থতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত চেক আপ করা হয় খুবই দায়সারা ভাবে, শুধু নিয়মরক্ষার জন্য। তাদের চিকিৎসা বা ওষুধ-পথ্যের কোনও ব্যবস্থাই নেই। স্থানীয় সাহায্যকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি ‘নেই নেই’-এর পীঠস্থান। এই কেন্দ্রগুলিকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন আছে। সরকার মনে করে শুধু ঝাঁ চকচকে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের বিল্ডিং করলেই জনস্বাস্থ্য উন্নত হবে। যথেষ্ট ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, উন্নত যন্ত্রপাতি না থাকলে, শুধু বিল্ডিং করলে ঠিকাদার ও তোলাবাজদেরই উন্নতি হয়। সাধারণ মানুষের কাজে লাগে না।
এ কথা ঠিক যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ খুবই কম। তথাপি একই দেশের মধ্যে, একই ‘বঞ্চনা’র মধ্যে থেকেও তামিলনাড়ু, কেরল প্রভৃতি দক্ষিণের রাজ্যগুলি কী ভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে, তা কি পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা ভেবে দেখেছেন? হাজার হাজার মানুষ প্রতি দিন এ রাজ্য থেকে চিকিৎসার জন্য দক্ষিণে কেন ছুটছেন, তা দেখেও কি রাজ্য সরকারের টনক নড়েছে? বরং তাঁরা বিশ্বাস রেখেছেন জনমোহিনী চমক ও ধমকের নীতিতে।
অমর্ত্য সেন এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার তিন প্রধান ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন— ১) প্রাথমিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অযত্ন; ২) বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর নির্ভরতা; ৩) স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে প্রচারমাধ্যমের ক্ষমাহীন নীরবতা। আর জি কর কাণ্ডের পর থেকে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কিছুটা বদলেছে। আশা করি, আগামী দিনেও স্বাস্থ্য পরিষেবার দুর্বলতা, সরকারের গাফিলতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
অনিয়ম
‘অবহেলার চিকিৎসা’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমাদের রাজ্যের অসংগঠিত শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। চিকিৎসা তাঁদের অনেকের কাছে নাগালের বাইরে। গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষ শুগার, প্রেশার আছে কি না, এটাই পরীক্ষা করতে পারেননি সারা জীবনে। বিগত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে অসামান্য উন্নতি ঘটেছে তার সুবিধে এঁদের কাছে অধরা। আবার, নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেকেই যত্নবান নন। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে অনেকেই যান না। কেউ আবার শরীর সামান্য সুস্থ হয়ে গেলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন, ফলে সমস্যা বাড়তে থাকে। বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষ সারা জীবনের জমানো টাকা, ভিটেবাড়ি বিক্রি করেও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অনেকে তাবিজ, মাদুলি, ঝাড়ফুঁকের উপর ভরসা করছেন এখনও। এর সমাধান করতে হলে গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা শিবির করতে হবে। সেই সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার চালাতে হবে। ওষুধের উপর অবিলম্বে জিএসটি প্রত্যাহার করা দরকার। বিশেষ করে নিয়মিত খাওয়ার ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা উচিত।
সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
হাতুড়ের ভরসা
কুমার রাণার প্রবন্ধটি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক যথার্থ সমালোচনা। করোনার ক্রান্তিকালে চিকিৎসাব্যবস্থার কঙ্কালসার দশা রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। ভাগ্যিস গ্ৰামাঞ্চলে করোনার প্রকোপ ততটা মারাত্মক হয়নি! তা না হলে গ্ৰামবাংলা উজাড় হয়ে যেত। জনস্বাস্থ্যের মূল কথা পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টি, পানীয় জল, সাফাই ব্যবস্থা, যেগুলো গ্ৰামের মানুষের কাছে এখনও দুর্লভ। সাধারণ অসুস্থতায় এখনও ৭০ শতাংশ মানুষের ভরসা হাতুড়ে চিকিৎসক। আমি তমলুক থেকে দু’কিলোমিটার দূরে একটি গ্ৰামে থাকি। তমলুকে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে, রয়েছে প্রায় ৮০টি নার্সিংহোম। তবু আমার গ্ৰামের এক হাতুড়ে চিকিৎসকের উপর এখানকার ২০-৩০টা গ্রামের মানুষ নির্ভরশীল। ভোর থেকে রাত অবধি তাঁর চেম্বারে রোগীর লাইন দেখে অবাক হই।
তমলুকে অনেক নামকরা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় রক্ত পরীক্ষার ফলাফলে একটির সঙ্গে অন্যটির অনেক পার্থক্য দেখা যায়, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এ রাজ্যে এখন সরকারি, বেসরকারি মিলে প্রায় ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজ। প্রতি বছর পাঁচ হাজারের বেশি ডাক্তার পাশ করে বেরোচ্ছেন। তবু প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো মূলত নার্সরাই চালু রেখেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্প করে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি সফল করছেন। নার্স এবং আশা কর্মী প্রসূতি মায়ের খবরাখবর রাখছেন এবং ডেলিভারির সুব্যবস্থা করছেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারের অভাব রয়েছে। এখনও গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে থাকা, এবং চিকিৎসার ব্যাপারে অনেক ডাক্তারের প্রচণ্ড অনীহা রয়েছে। লক্ষ করে দেখেছি, গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারদের সঙ্গে শহরের নার্সিংহোমের যোগসাজশ রয়েছে। সঙ্কটাপন্ন রোগীরা হাতুড়ে ডাক্তারের পরামর্শে নার্সিংহোমে ভর্তি হন। এর পর সেই পরিবারের সর্বস্বান্ত হতে সময় লাগে না। প্রবন্ধকার ঠিক কথা বলেছেন, স্কুলে যেমন ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক না থাকলে ঠিকমতো লেখাপড়া হয় না, তেমনই গ্ৰাম বা শহরে জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসাকেন্দ্র ও ডাক্তার, নার্স না থাকলে রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থার দৈন্যদশা কাটবে না।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
ওষুধের দাম
পয়লা অক্টোবর দিনটিতে ঘটা করে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করা হল, আবার এই মাসেই হাঁপানি, গ্লুকোমা, থ্যালাসেমিয়া, মানসিক অসুস্থতার ওষুধ-সহ আটটি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম অন্তত ৫০ শতাংশ বৃদ্ধিতে সরকার অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে এ বছরই এপ্রিল মাসে ৮০০টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়, যদিও পরে ৪১টির দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওষুধের এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবীণ নাগরিক। আর্থিক দুর্বলতা ও শারীরিক ভাবে অশক্ত এই নাগরিকদের ভাল থাকার জন্য সরকারের যে ব্যবস্থাগুলি করা প্রয়োজন, তার অন্যতম উন্নত চিকিৎসা। ইপিএফ-এর সামান্য পেনশন আজও বর্ধিত করা যায়নি, রেল ভ্রমণে ছাড় ফিরে আসেনি, ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে জমানো টাকার সুদ তেমন বাড়েনি। প্রবীণ মানুষের কথা চিন্তা করে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হোক।
সোমেশ সরকার, শেওড়াফুলি, হুগলি
অভূতপূর্ব
১৫ অক্টোবর কলকাতা এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হল— পুজো-কার্নিভাল ও দ্রোহ-উৎসব। চড়া আলোর নীচে বিশাল প্যান্ডেল, নৃত্য, এ সবের মধ্যেই প্রতি মুহূর্তে অভয়ার অদৃশ্য উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ২০১৬ সাল থেকে কার্নিভাল আরম্ভ হলেও এতে বাঙালির প্রাণের টান তেমন চোখে পড়েনি। অপর দিকে দ্রোহ মানে বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ। এখানে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা কেউ মন্ত্রীসান্ত্রি নন। তাঁরা ‘কমন ম্যান’, যাঁদের মধ্যে অনেকেই সিনিয়র সিটিজ়েন। প্রশাসন যদি একটু সংবেদনশীল হত, যদি জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিপক্ষ বলে মনে না করত, তবে রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এত দিনে অনেকখানি ঘুরে দাঁড়াত।
শিল্পী মুখোপাধ্যায় চক্রবর্ত, পাটুলি, কলকাতা