—প্রতীকী চিত্র।
‘কার কতখানি লাভ’ (২৯-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটিতে শুভময় মৈত্র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে যে সব বক্তব্য তুলে ধরেছেন, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আমার শুধু ওঁর বক্তব্যের মধ্যে একটা জায়গায় একটু খটকা লেগেছে বলেই এই চিঠির অবতারণা। উনি বলেছেন যে, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল সিপিএম শুধুমাত্র অরাজনৈতিক আন্দোলনের পিছনে কেন? এই প্রশ্ন রেখে উনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, হয় সিপিএমের সামনে থেকে আন্দোলন করার মতো লোকবলের অভাব, নাহয় তৃণমূলের আধিপত্যবাদকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, লোকসভা নির্বাচনের আগে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়দের ব্রিগেডের জনসমাবেশ দেখে মনে হয় না যে, সিপিএমের লোকবলের খুব একটা অভাব আছে। অবশ্যই ভিড়টা ভোটবাক্স অবধি পৌঁছয় না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আমার প্রশ্ন: তৃণমূলের আধিপত্যবাদ বিস্তার করিয়ে সিপিএমের রাজনৈতিক লাভ কতটা হবে? আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তারদের যে গণআন্দোলন, সেই আন্দোলনে বিজেপিকে আন্দোলনকারীরা পাত্তা দেননি। কিন্তু সিপিএমকে কিছুটা কাছে আসতে দিয়েছেন। যদি কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দল কিছুটা হলেও মানুষের সমর্থন এই আন্দোলন থেকে পায়, সেটা সিপিএম। তা হলে তৃণমূলের আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করতে সিপিএম কেন যাবে? আর বিজেপি সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয় দলটি এই আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা হলেও জমি হারিয়েছে শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদারের ডাক্তারদের আন্দোলনকে ছোট করার মধ্য দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সাধারণ মানুষ ওই নির্যাতিতা ডাক্তারের পরিবারের পাশে প্রথম থেকেই আছেন। অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আবেদন করা সত্ত্বেও তিনি পশ্চিমবঙ্গে এসে পাঁচ মিনিটের জন্য ওই শোকসন্তপ্ত পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি। এটা নিশ্চয়ই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখেননি।
সবশেষে বলি, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কোনও দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কারণ, এ রাজ্যে ৩৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বিজেপি পাবে না। ৬৫ শতাংশ ভোটের উপর নির্ভর করে কোনও দিন একটা দল কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে মনে হয় না।
কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০
বছর দখল
শুভময় মৈত্রের ‘কার কতখানি লাভ’ প্রবন্ধের শেষ অংশটিতে কালো মেঘের চারিদিকে রুপোলি রেখার ইঙ্গিত আছে। দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের সমাজজীবনে যে দুর্বৃত্তায়নের ছায়া ক্রমবর্ধমান, সেই ছায়ারই এক অংশের বিরুদ্ধে ডাক্তারদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার সুশীল সমাজের হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে জেগে ওঠাটাই সেই রুপোলি রেখা। ডাক্তারদের সমর্থনে দুর্বৃত্তায়নের সুবিধাভোগী খুব ছোট অংশ ছাড়া সুশীল সমাজ রাস্তায়, আক্ষরিক এবং মানসিক— দুই ভাবেই নেমে পড়েছিল। প্রায় অকল্পনীয় এই ঘটনাকে ভোটের লাভ-লোকসানের হিসাবে বিশ্লেষণ না করে বরং একে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখাই ভাল। সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বলেই এ রাজ্যের একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসককে তাঁর কর্মস্থলেই কেউ বা কারা ধর্ষণ, খুন করার সাহস পায়। শুধু তা-ই নয়, প্রায় সর্বসমক্ষে কিছু সরকারি কর্মচারী সেই অপরাধের প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করারও সাহস পায়। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে দুর্নীতি এখানে এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে, এ বার চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে বাধ্য। ইতিহাসের শিক্ষা বলে, সুশীল সমাজের আড়মোড়া ভাঙা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। অবস্থার উন্নতি হবে, যদি সুশীল সমাজ শুধু রাত দখল করে নয়, দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা, বারো মাসের নজরদারিটাও বজায় রাখতে পারে, সঙ্গে সামাজিক উদাসীনতাটা দূরে রাখতে পারে। সুশীল সমাজ হয়তো মূল সমাজের খুব ছোট অংশ, কিন্তু তাঁদের শিক্ষা, দীক্ষা, বোধ, বুদ্ধি, সংস্কৃতি— সমাজের সর্ব অংশকে প্রভাবিত করতে পারে, যদি তাঁরা উদ্যোগী হন।
অতনু ভট্টাচার্য কলকাতা-২
শিরদাঁড়া
শুভময় মৈত্রের উত্তর-সম্পাদকীয়টি প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত। তবে আর একটু ভাল হত প্রবন্ধকার যদি জনগণের লাভ-লোকসানের উপর আলো ফেলতেন। কারণ, শেষ কথা তো বলে ওই জনগণই। তবে এটা ঠিকই যে, সাড়ে সাত হাজার জুনিয়র চিকিৎসক বা তার সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত থাকা আশি-নব্বই হাজার চিকিৎসকের আন্দোলন সরকারি রাজনৈতিক শক্তির চেয়ারকে নাড়িয়ে দিতে পারে না। সম্ভাবনা তখনই দেখা দিত, যদি কোনও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বা শক্তিগুলো এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারত। তবু ওই ক্ষুদ্র অংশটির নেতৃত্বে কলকাতা পুলিশ কমিশনার-সহ জনা চার-পাঁচেক সর্বোচ্চ পর্যায়ের আধিকারিককে তাঁদের বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য (মতান্তরে প্রমোশন) করানো— এটাকে এক অর্থে জনগণের রাজনৈতিক জয় বলা চলে। কারণ, সরকার বুঝেছিল জনগণকে এই আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনতে হলে কিছু ভুলের (বা সচেতন অপকর্মের) মাসুল দিতে হবে।
আসলে এই আড়াই-তিন মাসে মানুষ শুধু অভয়ার ঘটনার প্রতিবাদ করেননি। আশেপাশে হয়ে চলা অন্যায় এবং রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বহু ব্যর্থতার প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা পথে নেমেছিলেন। তাঁরা এই জমানায় হয়তো খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন আর একটি বিরোধী জ্যোতি বসু কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা নিজেরা রাজ্য প্রশাসনের বহুবিধ ব্যর্থতা ও রাজ্যের পিছিয়ে পড়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন। এই উদাহরণ তাঁরা এই জমানায় বোধ হয় দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাননি। তাই দলীয় পতাকার বাইরে ওই চিকিৎসকদের পাশাপাশি প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন তাঁরা।
সবশেষে বলা চলে, অভয়ার ঠিকঠাক বিচার সিবিআইয়ের কাছে পাওয়া যাবে কি না, সে আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মানুষ প্রতিবাদে নেমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাধারণ নাগরিকদের শিরদাঁড়া এখনও ঋজু আছে।
সুদীপ মাইতি কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর
সময়ের শিক্ষা
রণবীর সমাদ্দারের ‘কোন নাগরিক, কোন জনতা’ (২৮-১০) শীর্ষক লেখায় পড়লাম, ডাক্তারদের আন্দোলন হল মধ্যবিত্ত (পড়ুন এলিট) সম্প্রদায়ের অভূতপূর্ব জাগরণ। মনে পড়ল, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের প্রতি আক্রমণ শাণিয়েছিলেন, তাঁদের আমরণ অনশনকে তীব্র ব্যঙ্গ করেছিলেন। পিছিয়ে থাকেননি দলের অন্য নেতা-মন্ত্রীরাও। মুশকিল হল, এমন সুসংগঠিত, রুচিবোধসম্পন্ন মহা-আন্দোলনকে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর বলে দাগিয়ে দিলেই সে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তার কারণ, এ আন্দোলন রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন হলেও, অ-দলীয় হয়েই বেড়ে উঠেছে। প্রথাগত বামপন্থার আন্দোলন-সংস্কৃতি দিয়ে একে বোঝা যাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে ভোট-রাজনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসমান, রাজনীতির ময়দানে বাজিমাত করতে ‘হোয়াট-অ্যাবাউটরি’ যাদের টিকে থাকার অবলম্বন, এ আন্দোলনের প্রাণকে তারা সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে না। নব উদ্যমে গড়ে ওঠা ‘অভয়া মঞ্চ’-এর কর্মসূচিগুলিও অভিনব বলা যায়। সংগঠন-ম্যাজিকের পুরনো ভাবনা আজ অচল। ডিজিটাল দুনিয়ায় সমাজমাধ্যম, নাগরিক সমাজের আন্দোলনকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছে, জনবাদী রাজনীতি দিয়ে তার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এটাই হল এ সময়ের শিক্ষা।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪