থমকে গিয়েছে জীবন। —নিজস্ব চিত্র।
কর্মসূত্রে টরন্টো-মন্ট্রিয়েল নিয়মিত আনাগোনা করলেও, আমরা কানাডার পূর্ব প্রান্তের বন্দর-শহর হালিফ্যাক্সের স্থায়ী বাসিন্দা। আমি কানাডিয়ান বিমা কোম্পানিতে কর্মরত আর আমার স্বামী মন্ট্রিয়েলের একটি অয়েল ট্যাঙ্কারের পদস্থ অফিসার।
হ্যালিফ্যাক্স স্থানীয় অর্থনীতি-নির্ভর, ছবির মতো সাজানো ছোট্ট বন্দর-শহর। এখানে গ্রীষ্ম আসে জাঁকজমক নিয়ে। গ্রীষ্ম মানে প্রচুর পর্যটক। আমেরিকা, ইউরোপ, মেক্সিকো থেকে যাত্রীবাহী জাহাজের আনাগোনা। রাস্তায় মানুষের ভিড়, অঢেল সামুদ্রিক মাছ, লবস্টার ফেস্টিভ্যাল, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, চেরি-স্ট্রবেরি, মানুষে ঠাসা সৈকত— সে যেন এক উৎসব-উৎসব রব চারিদিকে।
যখন শীতঘুম কাটিয়ে, আড়মোড়া ভেঙে এই শহর আস্তে-আস্তে গ্রীষ্মের জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই আচমকা সব থমকে গেল। গত দেড় মাস ধরে এখানে সব বন্ধ। স্কুল, কলেজ, অফিস, রেস্তোঁরা, পার্ক, সৈকত— সব বন্ধ। ‘স্টেট অফ ইমার্জেন্সি’। একসঙ্গে পাঁচ জনের বেশি কোনও জায়গায় দেখা গেলে পুলিশ জরিমানা করছে।
বরফ গলে গিয়েছে। গাছের ন্যাড়া ডালে পাতা আসছে। পরিবেশ নিজের মতো রং নিচ্ছে। হরিণেরাও নিয়মিত আসছে বাড়ির আশে-পাশে। কিন্তু সব যেন হচ্ছে সন্তর্পণে, সেই আড়ম্বর আর কোথাও নেই।
আরও পড়ুন: ২০২০-তে মানুষের নতুন মন্ত্র সামাজিক দূরত্ব
পেনশনভোগী, বয়স্ক কয়েকটি পড়শি আর গুটিকয় হরিণ নিয়ে আমরা থাকি। হালিফ্যাক্সে মানুষ অবসর নিয়ে এসে বাসা বাঁধে। শেষ জীবন শান্তিতে বন্দর-শহরে, পরিবেশের কাছাকাছি কাটাতে চেয়ে। তাই এই শহরের ৪০% বাসিন্দাই বয়স্ক। আর সেই জন্যই এখানকার মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধাশ্রম, ‘কেয়ার হোম’গুলি। কোথাও ১৮, ২০, ৩০ জন একসঙ্গে মারা যাচ্ছেন। একের পর এক বৃদ্ধাশ্রমগুলো থেকে পাচ্ছি মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিলের খবর। এ কী ভয়ানক পরিস্থিতি!
আমরা যতটা পারি পড়শিদের দেখে রাখার চেষ্টা করি। ফোনে খবর নেওয়া, বাজার আছে কি না খোঁজ করা, ভালো ই-বই বা গানের লিস্ট পাঠানো— দূর থেকে বলা যে তারা একা নেই, এই আর কী। একাকিত্ব, অবসাদ আর মৃত্যুর যোগাযোগ অবশ্য নিবিড়। এবং তা বোধকরি প্রমাণ করে গত সপ্তাহের শুরুতেই ঘটে যাওয়া কানাডার ইতিহাসে সবথেকে ভয়ানক হত্যালীলার ঘটনা। যা ঘটেছে আমার এই চেনা শহরেই!
আরও পড়ুন: সামুরাইদের শহরে এখন শুধুই নিস্তব্ধতা
গত শনি ও রবিবার, পুলিশের গাড়ি নকল করে, পুলিশের পোশাকে এক বন্দুকধারী আততায়ী রাতের অন্ধকারে একের পর এক হত্যালীলা চালিয়ে গেছে অবলীলায়। পুলিশের বেশে সে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেরিয়ে খুন করেছে ২২ জনকে। অবশেষে, রবিবার ভোররাতে সে পুলিশের হাতে মারা পড়ে।
অপরাধপ্রবণতা, গার্হস্থ্য হিংসা, আত্মহত্যার প্রবণতা যেন উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে এই লকডাউনের অবসাদ আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। সরকার থেকে বিভিন্ন ‘মেন্টাল হেলথ রিলেটেড হেল্প লাইনস’ খুলেছে এই দুঃসময়ে মানুষকে সাহায্য করতে।
আমার বোন আমেরিকায় সাইকোলজির স্নাতকোত্তর ছাত্রী। পড়াশোনার সুবাদে তাকে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের রোগীদের টেলি-কাউন্সেলিং করতে হয় এখন। তার কথায়, “এই উদ্বেগ, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা যে ভয়ানক মানসিক বিপর্যয় সঙ্গে করে এনেছে, তার মাশুল আমরা গুণব আরও কিছুদিনে।” হয়তো গুণতে শুরু করেও দিয়েছি। কী জানি!
পায়েল বাজপেয়ী, হালিফ্যাক্স, কানাডা
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)