শুনশান রাস্তাঘাট।
কয়েক বছর হল চাকরিসূত্রে নিউজিল্যান্ডে রয়েছি। গত ২৬শে মার্চ থেকে চার সপ্তাহের লকডাউন চলছে এখানে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ খুব ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌছে যাওয়ার আগেই, এই দেশের সরকার চতুর্থ স্তরে লক ডাউনের সিদ্ধান্ত নেন। এখনও পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৬৬ জন।মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। ৬২৮ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যানে নতুন করে করোনা আক্রান্তের গ্রাফও নিম্নমুখী।
দ্রুত চতুর্থ স্তরের লকডাউন ডেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এখনও খুব বেশি চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পায়নি কোভিড-১৯। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল সাংবাদিক বৈঠক করে প্রতিদিন করোনার আপডেট দেন । জেসিন্ডা দু তিনদিন অন্তর ফেসবুক লাইভে দেশবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। প্রশ্নের উত্তর দেন। ভয় পেতে নিষেধ করেন। খুব সুন্দর একটি শব্দ ব্যবহার করেন উনি , ‘বাবল’। সকলকে অনুরোধ করেন, এই কয়েক সপ্তাহ যেন সকলে প্রত্যেকে নিজের নিজের বাড়িতে থাকেন, নিজস্ব ‘স্পেস বাবল’-এ । পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ স্থান এখন নিজস্ব এই ‘স্পেস বাবল’। বরাবরই স্পষ্টবক্তা হিসেবে পরিচিত এই নেত্রী। এ ভাবে মানুষকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য এই ক’দিনে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।
অন্যান্য দেশের মতো এখানকার রাস্তাঘাটও জনশূন্য। শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো খোলা রয়েছে । সুপারমার্কেটে কেনাকাটা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। ছোট কনভেনিয়েন্স স্টোর-ও খোলা। একই সময়ে একজনের বেশি ক্রেতা দোকানে ঢুকতে পারবেন না। স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পড়াশোনা চলছে নিয়ম মতোই, তবে অনলাইনে । যে সব পড়ুয়ার বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তাদের বাড়িতে আগামী ছ’মাস বিনামূল্যে ইন্টারনেট পরিষেবা দেবে দেশের শিক্ষামন্ত্রক। টেলিভিশনের মাধ্যমেও পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুন: প্লিজ কিছু করুন! লকডাউন বেড়ে যাওয়ার পর নতুন করে মরিয়া আকুতি আটকে পড়াদের
নিউজিল্যান্ডের মানুষ অত্যন্ত খেলাধুলো প্রিয়। দৈনন্দিন জীবনে শরীরচর্চা, খাওয়া বা ঘুমোনোর মতোই আর একটি কাজ। বাড়ি থেকে খুব দূরে না গিয়ে, নিজেদের বাবল-মেটদের সঙ্গে তাই ছোটাছুটি করায় কোনো নিষেধ নেই এখনও। রাস্তায় মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে, লোকজন ছুটছেন বা সাইকেল চালাচ্ছেন । তবে নিয়ম ভাঙার ঘটনা এখানেও ঘটে। লকডাউনের নিয়ম ভেঙে গত সপ্তাহে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজের বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে একটি সমুদ্রতটে গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। শাস্তিস্বরূপ ওঁকে ক্যাবিনেটের নিম্নতম পদে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিদিন বিকেল ৫টার সময় বাড়ির বাইরে বেরিয়ে হাততালি দেওয়ার রীতি এখানেও শুরু হয়েছে। মানুষের সঙ্গে শুধুমাত্র এইটুকু যোগাযোগ দিনের সেরা মুহূর্ত। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো এদেশেও টেডি বেয়ার হান্ট চলছে। জানালায় পুতুল সাজিয়ে রাখা হচ্ছে, যাতে বাইরে বেরোলে বিভিন্ন বাড়ির জানালায় এই টেডি বেয়ার দেখে ছোটরা একটু আনন্দ পায় । লকডাউনে নিজেদের ভাল রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন মজার ভিডিয়ো আপলোড করছেন অনেকে। এক বাড়ির বারান্দা থেকে অন্য বাড়ির বারান্দায় সন্ধ্যালাপও চলছে।
আরও পড়ুন: সেই উবের ড্রাইভারের কথা মনে পড়ছে যাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম!
এর মধ্যেও রয়েছে প্রচুর অনিশ্চয়তা। লকডাউন-এ চাকরি গিয়েছে বহু মানুষের, বিশেষ করে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা। ছোট ব্যবসা, রেস্তরাঁ, কফি শপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে । সরকার কিছুটা সাহায্য ঘোষণা করেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে অনেকের বাড়ি ভাড়াটাও কুলোবে না। আমি অকল্যান্ডে একটি টেলিকম সংস্থার মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত। আমার চাকরি প্রয়োজনীয় পরিষেবার অন্তর্গত। কিন্তু সপ্তাহে পাঁচ দিনের পরিবর্তে, এখন তিন দিন কাজ আমার । খরচ চালানোর জন্য একটি ছোট ফুড প্রসেসিং ইউনিট-এ সাময়িক একটা কাজ নিয়েছি । প্ল্যান করা জীবনটা হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে গেছে আমাদের সবার। এই প্রস্তুতি তো আমাদের কারোরই ছিলনা। মাঝেমধ্যে খুব ভয় লাগে যখন ভাবি দেশে প্রিয়জনদের কারও কিছু হলে এখন ছুটে যাওয়ার উপায়টুকুও নেই। আমার কিছু হলেও কেউ দেখতে আসতে পারবে না । পরমুহূর্তে আবার নিজেকে পজিটিভ চিন্তা করতে বাধ্য করি। দুদিন আগে নিজেই নিজের চুল কাটলাম, কয়েকদিন টুপি পরে থাকতে হবে, এই যা।
মৌমিতা দাস রায় , অকল্যান্ড (নিউ জিল্যান্ড)
পেশায় মার্কেটিং কনসালটেন্ট, মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে
ইমেল: mo@traveltorebound.com
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)